‘হাতে ধইরা-পায়ে ধইরা কই, আমার ঘুমন্ত ভাইডারে যারা আগুনে পুইড়ালছে (পুড়িয়েছে), তাগর (তাদের) ধরুন, বিচার করুন। যদি আন্নেরা (আপনারা) বিচার করবার না পারুন (পারেন), তইলে ধরে আমার হাতে তুইল্লা দেন। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার করবাম (করবো)।’
এভাবেই আজাহারি করছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে অঙ্গার হয়ে মারা যাওয়া বাসের চালক জুলহাস মিয়ার বোন ময়না আক্তার।
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) বিকেলে উপজেলার ভালুকজান গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জুলহাসের মা সাজেদা খাতুন কান্না করতে করতে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পর পর চোখ খুলছেন। এসময় কান্না করে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে বলেন, সংসারটা জুলহাস চালাতেন। কারও সঙ্গে কখনো বিরোধ নেই জুলহাসের। রাজনীতির উত্তাপে বাসে আগুন দিয়ে তার ছেলেকে মর্মান্তিকভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। ছেলে হত্যার উপযুক্ত বিচার দাবি করছেন মা সাজেদা খাতুন।
পাশে বসে প্রতিবেশী ও স্বজনরা সাজেদাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু কোনোভাবেই তার কান্না থামানো যাচ্ছিল না।

পাশেই মাটিতে বসে সজোরে বিলাপ করছিলেন নিহত জুলহাস মিয়ার বোন ময়না আক্তার। তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার ভাই আমগর সংসারের একমাত্র ভরসা। আমার ভাই তিনটা কিস্তি চালাইতো। এহন কিস্তি চালানো টাকা কই পাইয়্যাম? সংসারই বা কেমনে চলবো? আমার ভাইডারতো কোনো অন্যায় ছিল না। তাহলে মারলো কেন? যারা আমার ভাইডারে পুড়ে মারছে, তাগর আমি দেখবার চাই। তাগর বিচার চাই।’
নিহত জুলহাস মিয়া উপজেলার ভালুকজান গ্রামের আবদুল বারেক ও সাজেদা খাতুন দম্পতির ছেলে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জুলহাস বিবাহিত। তবে তার সন্তান নেই। পরিবারে যত খরচ, সব জুলহাস দিতেন। তার মৃত্যুতে পরিবারটির সামনের দিনগুলো তিনবেলা খেয়ে-পরে বেচে থাকাই কষ্টকর হয়ে যাবে।
স্থানীয় স্বপন নামের একজন বলেন, ‘জুলহাস এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। হঠাৎ তার এমন মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।’
স্থানীয় বাক্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফজলুল হক মাখন জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলহাস খুব ভালো ছেলে ছিল। সে কখনো কারও সঙ্গে বিবাদে জড়ায়নি। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই।’
আরও পড়ুন:
ময়মনসিংহে থেমে থাকা বাসে দুর্বৃত্তের আগুন, নিহত ১
এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘বাসে দেওয়া আগুনে দগ্ধ নারীকে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

এর আগে সোমবার (১০ নভেম্বর) ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আলম এশিয়া পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আসে। রাত ২টা ৪৫ মিনিটে বাসটি তেল নেওয়ার জন্য পেট্রোল পাম্পের সামনে এলে সব যাত্রী নেমে যান। এসময় বাসটি এখানেই বন্ধ রখা হয়। রাত বেশি হওয়ার কারণে ভোরে নামবেন এমন চিন্তা করে একই উপজেলার চর রাধাকানাই গ্রামের বাবুল হোসেনের স্ত্রী শারমিন সুলতানা রুমকি ও তার ছেলে শহিদুল ইসলাম বাদশা বাসের ভেতরেই থেকে যান।
বাসের ভেতরে সিটে ঘুমিয়ে পড়েন চালক জুলহাস। এসময় তিনজন দুর্বৃত্ত এসে বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায়। বাসটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকা অবস্থায় শহিদুল ইসলাম বাদশা সুস্থভাবে বের হতে পারলেও তার মা শারমিন সুলতানা রুমকি আহত অবস্থায় বের হন। এসময় ভেতরে থাকা জুলহাস অগ্নিদগ্ধ হয়ে অঙ্গার হয়ে বাসেই মারা যান।
বাসে আগুন দেওয়ার ওই ঘটনা ইসলাম ফিলিং স্টেশনের বিপরীত দিকে একটি ইলেকট্রনিকস পণ্যের শোরুমের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। এতে দেখা যায়, রাত ৩টা ১৩ মিনিট ১৩ সেকেন্ডে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আলম এশিয়া পরিবহনের বাসের সামনে যান দুজন ব্যক্তি। একজনের মাথায় ছিল টুপি, অন্যজনের মুখ ও মাথা কাপড় দিয়ে বাঁধা।
এর ৩১ সেকেন্ড পর পেছন দিক থেকে আসেন আরও এক ব্যক্তি। তাদের সঙ্গে ছিল একটি বোতল। ওই বোতলের তরল দাহ্য পদার্থ বাসটির সামনে ও ভেতরে চালকের আসনে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে বাসের সামনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর একটি লাঠিতে আগুন ধরিয়ে সেটি বাসের ভেতরেও দেওয়া হয়। পরে দ্রুত ওই তিনজন চলে যান।
এসআর/এমএস

2 hours ago
5









English (US) ·