ইউটিউব দুনিয়ার সবচেয়ে বড় তারকা তিনি

2 weeks ago 18

ফাহিম হাসনাত

জিমি ডোনাল্ডসন—নামটি হয়তো অনেকের কাছে অপরিচিত। কিন্তু তার ইউটিউব চ্যানেল ‘মিস্টারবিস্ট’ আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে আবেগ, অনুভূতি, ভালো লাগা ও ভালোবাসার নাম। বিশাল অঙ্কের পুরস্কার, দান, মানবিক উদ্যোগ আর বিশাল বাজেটের চ্যালেঞ্জিং ভিডিও—সব মিলিয়ে তিনি আজ ইউটিউব দুনিয়ার সবচেয়ে বড় তারকা।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা

১৯৯৮ সালের ৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস অঙ্গরাজ্যের উইচিটা শহরে জন্ম ডোনাল্ডসনের। তিন ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়, আর মা সু ডোনাল্ডসন সেনাবাহিনীর সাবেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মায়ের চাকরির কারণে পরিবারকে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করতে হতো। ছোটবেলা থেকেই জিমির ছিল অদ্ভুত একগুয়ে স্বভাব। যে কাজে মন দিতেন; তাতেই সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন। শৈশবে লেগো খেলনা ও বেসবল ছিল তার দুনিয়া। ১৩ বছর বয়সে পুরোনো ল্যাপটপে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করা শুরু করেন। ২০১২ সালে তৈরি করা সেই চ্যানেলের নাম দেন মি.বিস্ট৬০০০, যেটি তার এক্সবক্স গেমার ট্যাগ থেকে অনুপ্রাণিত।

শিক্ষাজীবন থেকে ইউটিউব যাত্রা

প্রথমদিকে তিনি ‘লেটস প্লে’ ধরনের ভিডিও বানাতেন। অর্থাৎ গেম খেলতে খেলতে নিজের মন্তব্যসহ ভিডিও প্রকাশ করতেন। মূলত ‘মাইনক্রাফট’ ও ‘কল অব ডিউটি’ ছিল তার প্রিয় গেম। ২০১৬ সালে নর্থ ক্যারোলিনার গ্রিনভিল ক্রিশ্চিয়ান একাডেমি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন ডোনাল্ডসন। এরপর মায়ের ইচ্ছায় ভর্তি হন ইস্ট ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু ক্লাসের চেয়ে বেশি সময় কাটাতেন গাড়ির ভেতর ভিডিও বানিয়ে।

দুই সপ্তাহের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন পুরোপুরি ইউটিউব ক্যারিয়ারে মন দেওয়ার জন্য। সেই বছর জুলাই মাসে তার চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলে এক লাখ। তখন থেকেই তিনি ভিডিও থেকে আয়ের পথ খুলে ফেলেন। যা ছিল তার জীবনের এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।

ভাইরাল হওয়ার শুরু

২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘আই কাউন্টেড টু ১০০,০০০!’ ভিডিও দিয়ে প্রথমবারের মতো ভাইরাল হন মিস্টারবিস্ট। এরপর থেকেই শুরু হয় তার অসাধারণ সাফল্যের যাত্রা। ইউটিউবে অন্য নির্মাতার আয় নিয়ে বিশ্লেষণ, বড় অঙ্কের চ্যালেঞ্জ ও পুরস্কার—সবকিছু মিলিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।

একসময় তার ভিডিওর ধরনই বদলে যায়। মানুষকে অবাক করা পুরস্কার, বিশাল চ্যালেঞ্জ আর মানবিক উদ্যোগে ভরপুর ভিডিও। যেমন- অন্ধত্ব নিরাময়ে এক হাজার মানুষের চোখের অপারেশন খরচ বহন করা, আফ্রিকার পানিশূন্য এলাকায় টিউবওয়েল স্থাপন ইত্যাদি ভিডিওগুলো তাকে আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

২০২১ সালে তিনি ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টি তালিকায় স্থান পান। ২০২৪ সালের মধ্যে তার দান ও পুরস্কারের পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় ৩০ মিলিয়ন ডলার! কেউ চাকরি ছেড়ে দিলে দিচ্ছেন এক লাখ ডলার, কেউ দরিদ্র হলে হাতে তুলে দিচ্ছেন নগদ অর্থভর্তি ব্যাগ! এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষকে সাহায্য করতে আমার ভালো লাগে। তাদের মুখে আনন্দ দেখি, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।’

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইউটিউব চ্যানেল

২০২৪ সালের জুলাই মাসে ইতিহাস সৃষ্টি করেন মিস্টারবিস্ট। তার চ্যানেলই প্রথম ইউটিউবে ৩০০ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার অতিক্রম করে। ‘আমি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইউটিউব চ্যানেল হতে চাই’, ২০২২ সালে রোলিং স্টোনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলা তার সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় দুই বছরের মধ্যেই। বর্তমানে তার ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৪৪৭ মিলিয়ন বা ৪৪.৭ কোটি! যা ইউটিউব ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

আরও পড়ুন
অনলাইনের সেরা ৫ শিক্ষক
ফেসবুক ট্রেন্ডে গা ভাসাচ্ছেন, বিপদ ডেকে আনছেন না তো?

তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিওগুলোর একটি ‘$456,000 Squid Game in Real Life!’—যেখানে তিনি নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় সিরিজ স্কুইড গেমের চ্যালেঞ্জগুলো বাস্তবে আয়োজন করেন। প্রজেক্টটির খরচ হয়েছিল প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালের অক্টোবার মাস পর্যন্ত ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় ৮৮২ মিলিয়ন বার!

টিকটক কেনার প্রস্তাব

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার গুঞ্জন ছড়ায়; তখন মিস্টারবিস্ট ঘোষণা দেন—তিনি নিজেই টিকটক কিনে ফেলবেন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (আগের টুইটার)-এ পোস্ট করে জানান, ‘যদি টিকটক বন্ধ হয়, আমি এটি কিনবো।’ পরে টিকটকে ভিডিও দিয়েও তিনি বলেন, প্রস্তাবটি সিরিয়াস—তার আইনজীবীর সাথে অফার প্রস্তুতও আছে। তবে অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত তার এ উদ্যোগের কোনো আনুষ্ঠানিক অগ্রগতি জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টিকটক নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কয়েকবার পিছিয়ে দেন। সর্বশেষ সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত।

মিস্টারবিস্ট একজন সফল উদ্যোক্তাও

২০২২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দুটি কোম্পানি—ফিস্টট্যাবলস এবং মিস্টারবিস্ট বার্গার। ফিস্টট্যাবলস উৎপাদন করে চকোলেট বার, আর মিস্টারবিস্ট বার্গার একটি ভার্চুয়াল রেস্টুরেন্ট চেইন। যেখানে অনলাইন অর্ডার করে স্থানীয় রেস্টুরেন্ট থেকেই খাবার সরবরাহ করা হয়।

২০২৩ সালে তিনি লগান পল ও কেএসআইয়ের সঙ্গে মিলে বাজারে আনেন লাঞ্চলি, যা স্বাস্থ্যকর খাবারের প্যাকেজড কিট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ২০২৪ সালে তিনি অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওর সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেন বিস্ট গেমস—বিশাল গেম শো, যেখানে প্রতিযোগীরা ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এটি অ্যামাজন প্রাইমের সবচেয়ে বেশি দেখা আনস্ক্রিপটেড শো হয়ে ওঠে।

মাত্র ২৬ বছর বয়সে মিস্টারবিস্ট ২০২৪-এর জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলিয়নিয়ারের তালিকায় যুক্ত হন। শুধু ইউটিউব ও এসব ব্যবসা থেকেই ২০২৪ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার!

মজার বিষয় হলো, কাগজে-কলমে কোটিপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, তার কাছে মাত্র প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার বা তার কম নগদ অর্থ আছে। কারণ তিনি সব অর্থ পুনঃবিনিয়োগ করেন এবং সেখান থেকে সাধারণত কর্মীর মতোই মাসিক বেতন নেন। আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সম্পদ জমা করে রাখার কোনো পরিকল্পনাই তার নেই।’

আজ মিস্টারবিস্ট শুধু একজন ইউটিউবার নন; বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের আইডল। তার ভিডিওগুলোয় বিনোদনের সঙ্গে জুড়ে আছে মানবিকতা ও উদারতা। ভিডিওগুলোয় যেমন আছে প্রতিযোগিতা, উত্তেজনা ও বিনোদন; তেমনই আছে অনুপ্রেরণার বার্তা। তিনি বিশ্বকে বার্তা দেন—দানে আছে আনন্দ, আনন্দে আছে সাফল্য।

সূত্র: বিবিসি, এনডিটিভি, রোলিং স্টোন।

লেখক: দপ্তর সম্পাদক, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার কলাম অ্যান্ড কনটেন্ট রাইটার্স।

এসইউ/এমএস

Read Entire Article