ইরাক যুদ্ধের অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি মারা গেছেন। সোমবার (৩ নভেম্বর) নিউমোনিয়া ও হৃদরোগজনিত জটিলতায় ৮৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। পরিবারের দেওয়া বিবৃতিতে মঙ্গলবার এ তথ্য জানানো হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রিপাবলিকান নেতা চেনি। তাকে আধুনিক আমেরিকান রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ভাইস প্রেসিডেন্টদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পেছনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান কৌশলবিদ ও সমর্থক। চেনি দৃঢ়ভাবে দাবি করেছিলেন, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এবং দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। তবে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তে এমন কোনো অস্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন>>
ইরাক যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে বুশকে হত্যার ষড়যন্ত্র
গাজায় শান্তি আনবেন ‘হাতে লাখো ইরাকির রক্ত’ লেগে থাকা টনি ব্লেয়ার?
ট্রাম্পকে নয়, কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন রিপাবলিকান নেতা ডিক চেনি
চেনি মার্কিন প্রশাসনের ভেতরেও বেশ বিতর্কিত ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ও কনডোলিজা রাইসসহ একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে তার মতবিরোধ ছিল। তিনি সন্ত্রাসবাদের সন্দেহভাজনদের ওপর ‘এনহান্সড ইন্টারোগেশন’ (যন্ত্রণা-ভিত্তিক জিজ্ঞাসাবাদ) সমর্থন করেছিলেন, যার মধ্যে ‘ওয়াটারবোর্ডিং’ ও ‘স্লিপ ডিপ্রাইভেশন’-এর মতো পদ্ধতি ছিল। আন্তর্জাতিক মহল এগুলোকে ‘নির্যাতন’ বলে অভিহিত করেছিল।
ডিক চেনির মেয়ে লিজ চেনি রিপাবলিকান দলের প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হামলার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেওয়ায় তিনি দলের অভ্যন্তরে সমালোচনার মুখে পড়েন ও পরে আসন হারান। ডিক চেনি মেয়ের অবস্থানকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিপজ্জনক ব্যক্তি আর কেউ ছিল না।’
চেনির জীবনের বড় অংশ জুড়ে ছিল হৃদ্রোগের সমস্যা। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। পরে বহুবার হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয় এবং ২০১২ সালে তিনি হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করান।
ইরাক যুদ্ধের মূল পরিকল্পনাকারী
রক্ষণশীল রিপাবলিকান রাজনীতিক চেনি ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড ২০০৩ সালের মার্চে ইরাক আক্রমণের জন্য সবচেয়ে জোরালোভাবে সওয়াল করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, ইরাকের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ রয়েছে এবং ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে—যা পরে তদন্তে অসত্য প্রমাণিত হয়।
চেনি মনে করেছিলেন, মার্কিন সেনাদের ইরাকে ‘মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানানো হবে’ এবং যুদ্ধ ‘কয়েক সপ্তাহেই শেষ হবে।’ বাস্তবে সেই যুদ্ধ চলে প্রায় এক দশক এবং প্রাণহানির পরিমাণ ছিল বিশাল।
ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব
ডিক চেনি ছিলেন ওয়াইওমিং থেকে নির্বাচিত সাবেক কংগ্রেসম্যান ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশের সময় তিনি কুয়েত মুক্ত করার জন্য প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন বাহিনী পরিচালনা করেছিলেন।
রাজনীতিতে ফেরার আগে তিনি তেল-সম্পর্কিত কোম্পানি হ্যালিবার্টন-এর প্রধান নির্বাহী ছিলেন। কোম্পানিটি পরে ইরাক যুদ্ধের সময় অন্যতম বড় সরকারি ঠিকাদার হয়, যা তাকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
ব্যক্তিজীবন
ডিক চেনি ১৯৪১ সালের ৩০ জানুয়ারি নেব্রাস্কার লিঙ্কনে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরে পরিবারের সঙ্গে ওয়াইওমিংয়ে চলে যান। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেন, পরে ওয়াইওমিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
তার স্ত্রী লিন চেনি একজন রক্ষণশীল লেখিকা ও ভাষ্যকার ছিলেন। তাদের দুই মেয়ে লিজ ও মেরি দুজনই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়।
বিতর্ক ও উত্তরাধিকার
২০০৬ সালে এক শিকার অভিযানে দুর্ঘটনাবশত নিজের এক বন্ধুকে গুলি করে আহত করে তিনি আলোচনায় আসেন।
২০১৮ সালে তার জীবন নিয়ে নির্মিত জীবনীমূলক চলচ্চিত্র ‘ভাইস’-এ ক্রিশ্চিয়ান বেল তার চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য গোল্ডেন গ্লোব জিতে বেল মজা করে বলেন, এই চরিত্রের অনুপ্রেরণার জন্য আমি শয়তানকে ধন্যবাদ জানাই।
ডিক চেনি শেষ জীবনে বলেছিলেন, আমার কাজ হয়তো অনেকের মাথা ঘুরিয়ে দেবে, কিন্তু ইতিহাস বিচার করবে আমরা যা করেছি তা দেশের স্বার্থে ছিল।
সূত্র: রয়টার্স
কেএএ/

2 days ago
7









English (US) ·