কৃষি নির্ভর জেলা ঝিনাইদহ। জেলায় দিনদিন আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা। সিরামিক, পাটজাতপণ্য, খাদ্যপণ্য, এগ্রো কেমিকেল সহ নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঝিনাইদহে। একটি কৃষি নির্ভর জেলা হিসেবে ঝিনাইদহের দারুণ শিল্প সম্ভাবনাও রয়েছে। পাশাপাশি জেলায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারেও রয়েছে সম্ভাবনা ও সংকটের গল্প। এসব নিয়ে ঝিনাইদহে কাজ করছেন জেলার উদীয়মান ব্যবসায় উদ্যোক্তা ও শিল্প বিনিয়োগকারীরা। জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজেও এসেছে নতুন মাত্রা। জেলার সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প সম্ভাবনা, বিনিয়োগ, সরকারের করণীয় ও উদ্যোক্তাদের মনোভাব নিয়ে ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।
সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
জাগো নিউজ: জাগো নিউজের পক্ষ থেকে হেমন্তের শুভেচ্ছা, কেমন আছেন?
মোয়াজ্জেম হোসেন: আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। ঝিনাইদহবাসীর পক্ষ থেকে জাগো নিউজের সাংবাদিকবৃন্দ, পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও কলাকুশলীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
জাগো নিউজ: ঝিনাইদহ চেম্বারের দায়িত্ব পেয়েছেন। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি চেম্বারের এই দায়িত্ব কেমন উপভোগ করছেন?
মোয়াজ্জেম হোসেন: নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ততারতো শেষ নেই। এখন চেম্বারের দায়িত্ব পেয়েছি। এটা অনেক বড় একটা দায়িত্ব। জেলার ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, শ্রমিক, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কাজ করছি। তরুণ উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে। তাদের সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনার কথাগুলো শুনছি, তাদের কাছাকাছি গিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, চেম্বারের দায়িত্ব নিয়ে কেবল চেয়ারে বসে থাকলেই হবে না। ব্যবসায়ীদের দুঃখ, দুর্দশা ও ভালোমন্দের খবর রাখা উচিত। যাইহোক, সবমিলিয়ে ভালো উপভোগ করছি আমার নতুন দায়িত্ব।
আরও পড়ুন-
তুরস্কে সুন্দর ক্যারিয়ার ছেড়ে এসেছি গাজীপুরকে সাজাতে
‘সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে ব্যবসা স্থবির চুয়াডাঙ্গায়’
‘আম-চিংড়ির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দরকার প্রসেসিং জোন’
জাগো নিউজ: ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিজের ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে?
মোয়াজ্জেম হোসেন: আমার ব্যবসা-বাণিজ্য আগের মতোই চলছে। আলহামদুলিল্লাহ ভালো চলছে। তবে আগের চেয়ে ব্যস্ততা বেড়েছে। আমার দায়িত্ব এখন কেবল নিজের ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, আমি এখন জেলার সকল ব্যবসায়ীর অভিভাবক, মুখপাত্র বা প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতে চাই। কতটুকু পারছি জানি না, তবে আমার চেষ্টার কোনো কমতি নেই।
জাগো নিউজ: জেলার বর্তমান উৎপাদনমুখী ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিবেশ কেমন?
মোয়াজ্জেম হোসেন: দেখুন, ঝিনাইদহ একটি কৃষিনির্ভর জেলা। ঝিনাইদহের কৃষি বৈচিত্র্য দেশের অন্য কোনো জেলার সঙ্গে মিলবে না। এমন কোনো ফসল নেই, যা এই জেলার মাটিতে আবাদ করা যায় না। বিগত ১৬ বছর ধরে জেলার কৃষিখাতের সম্ভাবনা ও সংকটের কথা তৎকালীন সরকারের দৃষ্টিতে দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। কৃষকদের জন্য গতানুগতিক সেবা ছাড়া বিশেষ কোনো পরিকল্পনা সাবেক সরকারের ছিল না। বর্তমানে জেলায় ব্যবসা বাণিজ্যের দারুণ একটি সময় বিরাজ করছে। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকবেই। তবে আর্থিক সংকট ছাড়া বাকি সবকিছু ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ অনুকূলেই আছে।
জাগো নিউজ: ঝিনাইদহের কৃষিভিত্তিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। এই খাতের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
মোয়াজ্জেম হোসেন: আমাদের ঝিনাইদহ নানা ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীল একটি এলাকা। এই জেলায় সচরাচর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তীব্র খরা, নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা কম। যে কারণে নির্বিঘ্নে জেলার কৃষকরা তাদের কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারে। এই জেলায় প্রতিবছর যে পরিমাণ সাদা (কার্প জাতীয়) মাছ, সবজি, ধান, পাট, পান, কলা, তুলা, দেশি-বিদেশি ফলের আবাদ হয়, তা অন্য কোনো জেলায় হয় না। এসব কৃষিপণ্য স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পর সারাদেশে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে ঝিনাইদহের কৃষি সারাদেশে আলোড়ন ফেলেছে। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক বাজারজাতকরণ সম্ভব হলে ও কাঁচামাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। কৃষি ও কৃষিপণ্যকে যদি আধুনিক প্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে দারুণ সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
জাগো নিউজ: ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পরে ঝিনাইদহের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন? রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কোনো প্রভাব ব্যবসায়ীদের মাঝে পড়েছে কিনা?
মোয়াজ্জেম হোসেন: ৫ আগস্টের জুলাই বিপ্লবের পর জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। যারা ব্যবসা আগে করতেন, এখনো নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারছেন। হাতেগোনা দু’একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থাকতে পারে। সেটিও ৫ আগস্টের পরপরই হয়েছিল। বর্তমানে জেলার সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ সন্তোষজনক।
তবে ব্যবসায়ীরা ৫ আগস্টের পর তারল্য সংকটে পড়েছেন। এটি অবশ্য বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা বলবো না, কারণ বিগত সময়ে দেশের ব্যাংকিং খাত ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। যে কারণে অনেক ব্যাংক কিন্তু ফ্রিজ হয়ে গেছে। তারা গ্রাহকের জমাকৃত আমানত সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা তারল্য সংকটে বিপাকে পড়েছেন। এছাড়া ব্যবসায়ীদের মাঝেও কিছুটা আতঙ্ক থাকতেও পারে।
জাগো নিউজ: নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী গত এক বছরে ঝিনাইদহে কার্যক্রম শুরু করেনি। এমনটা কেন হচ্ছে, সমাধান কী?
মোয়াজ্জেম হোসেন: দেখুন, জুলাই বিপ্লবের পরে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছে। এই সরকারের ওপর অনেক ব্যবসায়ী হয়ত আস্থা রাখতে পারছেন না। মূলধন বিনিয়োগ করতে গেলে বিনিয়োগকারীরা দেশের স্থিতিশীলতাকে আমলে নেন। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান সংকট ও নাটকীয়তা চলছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে হয়ত ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা আর নতুন কোনো বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে এই সমস্যা চলে যাবে। দেশে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার পর রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা চলে এলে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরবে। বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ মূলত নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের ওপরই বেশি আস্থা রাখতে চায়। আমার মনে হয়, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থানও বাড়বে।
জাগো নিউজ: ঝিনাইদহ বিসিক শিল্পনগরী নিয়ে ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের কোনো পরিকল্পনা বা প্রত্যাশা আছে কি না?
মোয়াজ্জেম হোসেন: ঝিনাইদহ বিসিক শিল্পনগরী খুবই সীমিত জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই শিল্প নগরীর বয়স প্রায় ৩৫ বছর। ঝিনাইদহ কৃষি নির্ভর এলাকা। কাজেই, আমি মনে করি ঝিনাইদহ বিসিক নিয়ে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা করা দরকার। যেহেতু এই অঞ্চলে কৃষিপণ্য, মৎস্য, গবাদিপশু, ফুল ও ফলের ব্যাপক উৎপাদন হয়, সেহেতু এখানে বিশেষ বিসিক গড়ে তোলা যেতে পারে। যেখানে আধুনিক কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন হাব তৈরি হবে। এমন একটি বিশেষ অঞ্চল তৈরি করা গেলে কৃষক বাঁচবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। এজন্য প্রয়োজন বিসিকের সম্প্রসারণ। আমরা এটা নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রতিনিধি দল এরইমধ্যে ঝিনাইদহ বিসিক পরিদর্শন করেছেন। আমরা ঝিনাইদহ চেম্বারের পক্ষ থেকে বিসিকের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে সার্বিক সহযোগিতা দেবো। যেখানে যা করার, আমরা চেম্বারের পক্ষ থেকে সেটি করবো।
জাগো নিউজ: ঝিনাইদহে শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও শিল্প বিনিয়োগের প্রসার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। আপনারা এ নিয়ে কী ভাবছেন?
মোয়াজ্জেম হোসেন: ঝিনাইদহ বা অন্য কোনো জেলা শহরে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি ও শিল্প বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। সরকার চাইলে এটি সম্ভব। কারণ, সরকার কেবল বড় বড় শহর বা বিভাগীয় শহরগুলোকে টার্গেট করে ৫% থেকে ৭% সুদের হারে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়। এই ঋণ সুবিধা ছোট শহরগুলোর শিল্প উদ্যোক্তাদের ৯% থেকে ১৪% হারে দেয়। এটাতো বৈষম্য। এই বৈষম্য কমিয়ে যদি জেলার মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের ৫% থেকে ৭% সুদের হারে সরকার ঋণ দেয়, তাহলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়বে। এতে করে শিল্পের বিকাশ হবে, বেকারত্ব কমবে। সেইসঙ্গে জেলায় কর্মসংস্থান বাড়বে। বড় বড় বিনিয়োগকারীরাও ব্যবসায় আগ্রহ পাবে।
জাগো নিউজ: তরুণ উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও কৃষি উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী?
মোয়াজ্জেম হোসেন: আসলে, জনশক্তি বা মানুষের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর কিছু হয় না। দেশের জনসংখ্যাকে যদি জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তরুণদের যদি কর্মদক্ষতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে দেশে বেকারত্ব কমবে। তরুণরা এখন অনেকেই কৃষিসহ অন্যান্য ব্যবসায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। আমি মনে করি, চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়া জরুরি। চাকরি করলে কেবল আপনি নিজের জন্যই কিছু করতে পারবেন। কিন্তু আপনি উদ্যোক্তা হলে অন্য মানুষকে চাকরি দিতে পারবেন। মানুষের কর্মের ব্যবস্থা করে দেওয়াও একটা প্রশান্তির কাজ। শিক্ষিত যুবক-তরুণরা সুপরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। তারা চাইলে, ছোট পরিসরে উদ্যোক্তা হতে পারেন। এজন্য ঝিনাইদহে যদি কারো কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হয়, আমরা ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষ থেকে তাকে বা তাদেরকে সহযোগিতা করবো।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ায় জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
মোয়াজ্জেম হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। সেইসঙ্গে জাগো নিউজকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, কারণ তারা জেলা পর্যায়ে অবদান রাখা ব্যবসায়ীদের ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
এফএ/জেআইএম

4 days ago
9









English (US) ·