আমিনুল ইসলাম
সদ্য অতীত হয়ে আসা ঘনঘন বদলির পথ ধরে হাঁটতে থাকা পেশাগত জীবনে অচিন্ত্য চয়নের সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত ২০০৪ সালে। আমার প্রথমবারের মতো বগুড়া লেখক চক্র সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে। তখন সে বগুড়া লেখক চক্রের একজন উৎসাহী সক্রিয় কর্মী। তারপর থেকে প্রায় নিয়মিত যেতাম বগুড়া লেখক চক্র সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে। দেখা হতো। কথা হতো। দিন দিন সে ইসলাম রফিকের প্রিয়পাত্র এবং নির্ভরযোগ্য সহযাত্রী হয়ে ওঠে। আমি ২০১১ সালে কবিতায় ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার’ পেলে সে তার সম্পাদিত ‘অদ্রি’ লিটল ম্যাগাজিনে আমাকে নিয়ে প্রায় শত পৃষ্ঠার এবং একইভাবে ফারুক সিদ্দিকীকে নিয়ে শত পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্রসহ প্রায় সাড়ে চারশ পৃষ্ঠার বয়েল আকৃতির ঢাউস সংখ্যা প্রকাশ করে।
অচিন্ত্য চয়নের নামের কারণে আমরা প্রথমে বিভ্রাটে পড়ি। লীনা প্রথমে ওকে ‘অচিন্ত্য দাদা’ সম্বোধন করেছিল। পরে তার ছদ্মনামের বিষয়টি জেনে যাই আমরা। উত্তর-আধুনিকতার হিড়িকে তখন ‘অনার্য’ শোনাবে এমনতর লেখক নাম নেওয়ার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করা তরুণ কবিদের মাঝে। সেই প্রবণতা দ্রুত পুরাঘটিত অতীত হয়ে যায়। অচিন্ত্য চয়নকে আমি, লীনা এবং আমার দুই ছেলে-মেয়ে সবাই ভালোবাসি। আমি তো তাকে বড় ভাইয়ের অধিকার ও ভালোবাসা নিয়ে অনেক সময় বকাঝকাও করি। সব অবস্থায় সে আমাকে তার হিতাকাঙ্ক্ষী বড় জ্ঞান করে। এর কোনো ব্যতিক্রম আজ অবধি ঘটেনি। সব অবস্থায় ওর হাসিমাখা মুখ আমাদের সুখ দেয়। বজলুল করিম বাহার-ইসলাম রফিক-খৈয়াম কাদেরদের বগুড়ায় আমার অন্তরঙ্গ মানুষের অভাব নেই। কিন্তু তারপরও যে-বার বা যখন বগুড়া গিয়ে অচিন্ত্য চয়নকে দেখতে পাইনি, আমাদের আনন্দে খানিকটা ঘাটতি থেকে গেছে।
আমার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অচিন্ত্য চয়ন সেই তখন থেকেই একজন অক্লান্ত সুহৃদ। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে ফিচার সম্পাদক-সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছে। এখনো একই ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করছে দৈনিক মানবকণ্ঠ নামক বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে। সে সব সময় এবং সব অবস্থায় আমার লেখা চেয়ে নিয়ে ছেপেছে। আমার জন্মদিন এলে আমার কবিতার ওপর অন্যদের লেখা অন্তত একটি প্রবন্ধ ছেপেছে। অথবা আমার সাক্ষাৎকার। সে নিজেও কয়েকবার সাক্ষাৎকার নিয়েছে আমার। ছেপেছে বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্যপাতায়। তার নেওয়া একটি বিশাল আকারের সাক্ষাৎকার ২০১৩ সালের ১৯ এপ্রিল দৈনিক ভোরের কাগজের সাহিত্য বিভাগের প্রথম পাতায় লিড স্টোরি আকারে ছাপা হয়েছিল। তার নেওয়া আরেকটি সাক্ষাৎকার দৈনিক অর্থনীতি প্রতিদিনের সাহিত্য বিভাগে প্রথম পাতায় লিড স্টোরির ভঙ্গিমায় ছাপা হয়েছিল। এমন আরও দু-তিনটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। অচিন্ত্য চয়ন সাধারণত প্রবন্ধ ধরনের কিছু লেখে না। অথচ সে আমার কবিতা নিয়ে ‘আমিনুল ইসলামের কবিতা: নানা দৃশ্য ও চিত্রকল্পের উঠোন’ শিরোনামে একটি মধ্যম আকৃতির সমৃদ্ধ নিবন্ধ লিখেছিল। সেটি ছাপা হয়েছিল একটি দৈনিকের সাহিত্যপাতায়। পড়ে পছন্দ হয়েছিল আমারও। সেটি আমার সংগ্রহে আছে কিন্তু এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না। বয়সের চাপে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে আসার কারণে।
অচিন্ত্য চয়ন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে অহংবোধ থেকে মুক্ত। সে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে বরাবরই আপসহীন ব্যঞ্জনায় ইনক্লুসিভ মাইন্ডের অধিকারী বলে আমি লক্ষ্য করে এসেছি এবং আসছি বছরের পর বছর। অমুকের লেখা ছাপবো না, অমুককে দাবিয়ে রাখতে হবে, এমনতর অন্ধতা তার ভাবনায় স্থান পায়নি কোনোদিন। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে অচিন্ত্য চয়ন লেখা ছাপে, লেখক ছাপে না। অচিন্ত্য চয়নের ব্যক্তিগত আচরণে কোনো ঔদ্ধত্যপনা নেই, নেই কোনো সবজান্তা হামবড়া ভাব। সে পত্রিকার চাকরিটাকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেনি কোনোদিন। আজও নয়। এককথায় তিনি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে লেখকদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চায়নি কোনোদিন। এখনও করে না সেটা। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে নির্লোভ সাধু-সন্ন্যাসী, এ কথা বলছি না। তবে কোনো লোভই তাকে অকৃতজ্ঞ করে তোলেনি কখনো।
সারা বিশ্বেই মালিকের হয়ে কাজ করা সংবাদকর্মীদের কাজের স্বাধীনতাও নিদারুণভাবে সঙ্কুচিত। নানাবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই দু’চারজন সংবাদকর্মী সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে কাজ করে যান। ঝুঁকি তো থাকেই। কাউকে জীবনের বিনিময়ে শোধ করে যেতে হয় সেই ঝুঁকির দাম। আর যারা লোভের যাত্রার ধ্বনি শুনে তার নিত্য উধাও রথের যাত্রী হন, তারা নানা রকমের নগদ লাভের মুখ দেখেন। অচিন্ত্য চয়নকে এমন বৈশ্বিক ভূগোলের এক কোণে বসে কাজ করতে হয়।
যে ভুলের ঊর্ধ্বে; সে তো মানুষ নয়। অচিন্ত্য চয়ন একজন মানুষ। ‘To err is human, to forgive is divine’. আমরা সুনির্দিষ্টভাবে না জানলেও অনুমান করে নিতে পারি—আরদশজন মানুষের মতো তার জীবনেও ভুলত্রুটি আছে। সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন। তার ব্যক্তিজীবনকে আমি তার পেশাগত জীবনে টেনে আনতে চাই না। তার ভাগ বা দায়ভার লেখক বা বন্ধুদের বইতে হয় না। সাহিত্যাঙ্গনে কারও ব্যক্তিগত জীবনের হালখাতা অন্যদের মিলিয়ে দেখার কোনো সৎ যুক্তি নেই। যদি না তা দেশের বা জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যঞ্জনায় ও মাত্রায় স্পর্শ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিদের ব্যক্তিগত জীবন এবং কবিজীবনকে একাকার করে না দেখার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘মানুষ-আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে,/ ভূমিতে লুটায় প্রতি নিমেষের ভরে,/ যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে,/ কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে।’
আমার বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের এই বিবেচনাবোধ আরও অনেক পেশার মনুষের জীবনেও কম-বেশি প্রযোজ্য। কিন্তু এটি কবিসহ কোনো পেশার মানুষকেই অপরাধপ্রবণ কিংবা জাতির বিপক্ষগামী কিংবা দেশদ্রোহী হওয়ার অুনমোদন দেয় না। অচিন্ত্য চয়ন সামাজের কোনো হোমড়া চোমড়া হয়ে ওঠেনি কিংবা সে কোনো সেলিব্রেটিও নয়। সে পেটের ভাতের জন্য একটা চাকরি করে। সংবাদপত্রে। সেই পেশাগত জীবনের পাশাপাশি সে আমাদের মতোই সাধারণ শিল্প-সাহিত্যকর্মীদের একজন।
অনেক দিন হয়, অচিন্ত্য চয়নের সাথে দেখা নেই। অবশ্যই কথা হয়। তবে তা সেলফোনে। আজ বিলম্বিত সকালে ফেসবুক চোখে আলো ফেলে জানিয়ে দিলো ‘আজ অচিন্ত্য চয়নের জন্মদিন! তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে না কবি?’ অবশ্যই জানাবো। অতএব শুভ জন্মদিন কবি, সাহিত্য সম্পাদক ও মানুষ অচিন্ত্য চয়ন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/জিকেএস

5 months ago
66









English (US) ·