কর্মসংস্থান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক: শ্রমবাজার বিপর্যস্ত

6 hours ago 4

বিভিন্ন কারণে মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। অনেক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। শুধু কল-কারখানাই নয়, ব্যাংক, বীমা, এনজিও, স্কুল, মিডিয়া, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ বহু প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে, বেতন কমিয়ে দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থির না হওয়া ও বিনিয়োগ সচল না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থার উন্নতি হবে না। এদিকে কাজ হারানো মানুষের কষ্ট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের সংকট সীমাহীন। 

অন্য খাতগুলোর তুলনায় বিপজ্জনক অবস্থায় আছে দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী প্রতিষ্ঠান গার্মেন্টস শিল্প। গত দেড় বছরে কয়েকশো কারখানা বন্ধ ও লাখো শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে বলে দাবি করছেন উদ্যোক্তারা। বিজিএমইএ বলছে ৩৫৩ কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং বেকার হয়েছে সোয়া লাখ শ্রমিক।

বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যান্য পেশাজীবীদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন শ্রমিকরা। এই কথা সবাই বলে এবং জানে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির জন্য ন্যূনতম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা আমাদের অনেকের মধ্যেই নাই। বিশেষ করে মালিক গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ শ্রমিকদের আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন কিন্তু তাদের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিতে চান না। শুধু মে দিবস কেন্দ্রিক সংগ্রামী চেতনার কোনো মূল্য নেই শ্রমিকদের কাছে। যারা প্রতিদিন রুটি-রুজির জন্য সংগ্রাম করছেন, তারা চান সঠিক মজুরি, যথাসময়ে মজুরি, সম্মান, নিরাপত্তা ও একটু ভালবাসা।

দেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় ৩২ শতাংশ ন্যূনতম মজুরির কম আয় করেন এবং ৭৮ শতাংশ শ্রমিক পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না। প্রতি আটজনের একজন শ্রমিক ঋণের জালে আটকা পড়েছেন। বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের (বিএলএফ) ‘বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে জবরদস্তিমূলক শ্রম ও শিশুশ্রম : ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ ও সমাধানে দিকনির্দেশনা' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়৷

সবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। ছোট ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মালিকরা দায় টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারছেন না। এছাড়া বাড়ছিল শ্রমিক অসন্তোষ। পোশাকশিল্পে সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী পণ্যের ক্রয়াদেশ হ্রাস পাওয়া, আর্থিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মালিকদের অনুপস্থিতির কারণে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের বেকার হওয়ার পাশাপাশি তাদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

যারা কাজ হারাচ্ছেন, তারা নতুন কোথাও কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে অধিকাংশই গ্রামে ফিরে গেছেন বা যাচ্ছেন, কেউ কেউ তরিতরকারি বা অন্যকিছু বিক্রি বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। এমনও কেউ কেউ আছেন ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন। খুব সামান্য আয় কিন্তু দু’মুঠো খাবার জোগাড় করার জন্য আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। যতোদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হবে, ততোদিন এই বেকারত্বের মিছিল বাড়বেই।

পোশাক শিল্প ছাড়াও সম্প্রতি আরো কয়েকটি কারখানা বন্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চাকরি হারাচ্ছেন সেসব কারখানার শ্রমিকরাও। দেশের গোটা অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার উপর এর প্রভাব পড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় গার্মেন্টস ও বিভিন্ন কলকারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আরো কিছু ব্যবসা। যেমন- আবাসন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানপাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, মনিহারি দোকান ইত্যাদি। ফ্যাক্টরি বন্ধের সাথে সাথে এগুলোর ঝাঁপি বন্ধ হওয়ার পথে।

এবার আসি কলকারখানা ও গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ায় নারীর উপর কী প্রভাব পড়ছে এই আলোচনায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৩০ লাখ নারী কাজ করেন। অন্যান্য কারখানাতেও নারী কর্মরত আছেন। গার্মেন্টস ও কারখানা বন্ধ হওয়ায় বহু নারী চাকরি হারিয়েছেন। এসব শিল্পে কর্মরত নারীরা অধিকাংশই পরিবারের অন্যতম চালিকা শক্তি। কেউ কেউ একক নারী। ফলে চাকরি চলে যাওয়ায় খুব অসহায় হয়ে পড়ছেন তারা। সহজে কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না, পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে আবার বাসাবাড়ির কাজে গৃহশ্রমিক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ পানবিড়ি বা পিঠা বিক্রি করছেন। নারী যদি শ্রমবাজার থেকে ছিটকে পড়ে, তাহলে দেশের অর্থনীতির উপর তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে প্রায় ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ লাখই নারী। অর্থাৎ চাকরি হারানো মানুষের ৮৫ শতাংশের বেশি নারী, যা শ্রমবাজারে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত মে মাসে প্রকাশিত ‘জেন্ডারভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ইউএন উইমেনের সহযোগিতায় প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মসংস্থানের এই সংকোচন শুধু পরিবারগুলোর আয়কেই প্রভাবিত করছে না, বরং দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সামাজিক ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ও সেবা খাতে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আসি শ্রমিকদের জীবনমান প্রসঙ্গে। দেশে শ্রমিকের জীবন এতোটাই মূল্যহীন যে তাদের কাজের অধিকার ও সুযোগ, নিরাপত্তা, সন্তানের যত্ন বা আরাম-আয়েশ সবই গৌণ; তাদের দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। অথচ এই দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। 

শুধু কলকারখানা বন্ধ নয়, এর বাইরেও দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেক শ্রমিক মারা যান ও আহত হন। সাধারণত এর কোনো সুষ্ঠু বিচার হয় না। নির্যাতনের ধরণগুলোর মধ্যে রয়েছে- শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, ছুরিকাঘাত, খুন, রহস্যজনক মৃত্যু, অপহরণ ও মারধর ইত্যাদি।

ফর্মাল বা আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য আইন আছে, শ্রমিকের জীবনের মূল্যও আছে, শ্রমিকের ভালো-মন্দ দেখার জন্য বিভিন্ন বোর্ড ও সংগঠন আছে, সরকার শ্রমিকদের কল্যাণ দেখার জন্য একটি মন্ত্রণালয় রেখেছেন, অভিবাসী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা দেখার জন্যও আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। কিন্তু এরপরেও শ্রমিকরা খুবই অবহেলিত ও নির্যাতিত। প্রতিবার কোন না কোন ধাক্কায় শ্রমিকের জীবন সবচেয়ে আগে নড়বড়ে হয়ে যায়।

বাংলাদেশে যারা নির্মাণ শ্রমিক, সুইপার, যারা দাহ্য পদার্থের গুদামে কাজ করেন এবং গাড়ির গ্যারাজে ওয়েল্ডিং কাজ করেন তাদের জীবনের নিরাপত্তা প্রায় শূন্যের কোঠায়। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্তে¡ও শুধু টাকা বাঁচানোর জন্য মালিকরা শ্রমিকদের নিরাপত্তার ইস্যুটি গণনার মধ্যে আনেন না।

দেখা গেছে বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকদের প্রায় বন্দী করে রাখা হয়। বিপদ এলে তারা পালিয়েও বাঁচতে পারেন না। এরকম অনেক উদাহরণ আছে আমাদের সামনে। ২০১৩ সালে যখন সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক, আহত হয়ে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন আরো অনেক মানুষ, তখন আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আওয়াজ তুলেছিলাম শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে।

কিন্তু এরপর ঘটে গেল জুস বানানোর কারখানায় হত্যাযজ্ঞ। অসংখ্য শিশু শ্রমিকের লাশ বের হয়ে এলো। ঘটে গেল চট্টগ্রামের ডিপোতে বিস্ফোরণ, আগুনে পুড়ে গেল অসংখ্য শ্রমিক। এর ফাঁকে আরো অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে শ্রমিক নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারগুলো ডুবে গেছে, সন্তান এতিম হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনই বোধ করিনা। কারণ এই মানুষগুলোর প্রাণের কোনো দাম নেই।

কেমিক্যাল সংরক্ষণে অদক্ষতা ও অবহেলা, ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, কারখানার ভবনে জরুরি বহির্গমন পথ না থাকা, বহির্গমন পথ তালাবদ্ধ করে দেওয়া, কারখানা নির্মাণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতি না নেওয়া, নিরাপত্তার বিষয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া, নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া না করা ইত্যাদি কারণে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটলে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে না। মালিক কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকের জীবনের চাইতে সম্পদের নিরাপত্তা বেশি জরুরি।

আমরা যখন শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কথা বলি, তাদের দাবি আদায়ের কথা বলি, তখন তা শুধু ফর্মাল বা আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কথা বলি। কারণ তাদের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন ও অধিকার রয়েছে। কিন্তু যারা অ-আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, তাদের কথা তো কেউ ভাবেও না, কোথাও লেখাও নেই। তাদের জীবনের দুর্যোগ-দুর্বিপাক আরো অনেক বেশি।

বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যান্য পেশাজীবীদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন শ্রমিকরা। এই কথা সবাই বলে এবং জানে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির জন্য ন্যূনতম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা আমাদের অনেকের মধ্যেই নাই। বিশেষ করে মালিক গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ শ্রমিকদের আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন কিন্তু তাদের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিতে চান না। শুধু মে দিবস কেন্দ্রিক সংগ্রামী চেতনার কোনো মূল্য নেই শ্রমিকদের কাছে। যারা প্রতিদিন রুটি-রুজির জন্য সংগ্রাম করছেন, তারা চান সঠিক মজুরি, যথাসময়ে মজুরি, সম্মান, নিরাপত্তা ও একটু ভালবাসা।

শ্রমিকরা যতক্ষণ না পথে নামেন, স্লোগান দেন, রাস্তায় বিক্ষোভ করেন, ততক্ষণ তাঁদের কথা আমরা ভুলেই থাকি। এমনকি এই শহরে আসলে কতজন শ্রমিক আছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে, এরও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সবকিছু মিলিয়ে দেশের শ্রমবাজার বেশ বিপর্যস্ত। এর থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হবে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটবে।

১০ নভেম্বর, ২০২৫

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article