কিশোর প্রেম : মোহের নকশা থেকে মৃত্যুর নাট্যমঞ্চে

3 hours ago 3

সুহানার বয়স সবে ষোলোতে পড়েছে। চোখে তার স্বপ্নের নীলাভ মায়া, আর হৃদয়ে কিশোর প্রেমের অচেনা কাঁপন। সে বিশ্বাস করত, ভালোবাসা মানে মুক্তি—প্রেমিকের হাত ধরলেই পৃথিবীর সব ভয় থেমে যাবে। কিন্তু পৃথিবী তাকে খুব নিষ্ঠুরভাবেই বুঝিয়ে দেয়—স্বপ্নের দিগন্তে সবচেয়ে বেশি অন্ধকারই লুকিয়ে থাকে।

এক সন্ধ্যায় তার প্রেমের কথা বাড়িতে ফাঁস হয়ে গেল। বাবা-মায়ের মুখ বিকৃত ক্রোধে ভরে ওঠে। মা কাঁদতে কাঁদতে বলে–মেয়ের জন্য সমাজে লজ্জায় মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়েছে! বাবা ভেতরের দরজা বন্ধ করে চরম শাসনের ভাষায় বলে–“আর একপা ঘরের বাইরে দিলে পা ভেঙে দেবো!”

সুহানার বুকের ভেতর তখন একটা অদৃশ্য দেওয়াল চূর্ণ হতে থাকে। সে অনুভব করে—এই ঘর, এই রক্তের সম্পর্ক তাকে মানতে রাজি নয়।
তার মনে পড়ে প্রেমিকের কণ্ঠস্বর– “তুমি এলে আমিই তোমার ঘর হবো—শুধু আমার কাছে চলে এসো”

সমাজে বর্ষা-মাহির বা জোবায়েদের জন্ম হঠাৎ করে ঘটে না; তারা তৈরি হয় দীর্ঘদিনের অবহেলা, অন্ধ স্নেহ এবং দায়িত্বহীন পারিবারিক মানসিকতার মধ্য দিয়ে। তাই পরিবর্তনের সূচনা ঘর থেকেই করতে হবে। সন্তানকে ভালোবাসা মানে তাকে অন্ধভাবে রক্ষা করা নয়, বরং সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ধৈর্য, নীতি, সাহস ও সদিচ্ছা নিয়ে পাশে দাঁড়ানো। এখনই সময়—পরিবারকে দায়িত্বের আসনে ফিরে আসার।

রাত যখন গভীর হয়, চাঁদের আলো ঠান্ডা হয়ে জমে আসে গায়ে, সুহানা আলমারির গহনা আর টাকা ব্যাগে গুছিয়ে নেয়। কেউ তাকে ডাকে না, তবুও তার মনে হচ্ছিল—প্রতিটি জিনিস তোলার শব্দেই আকাশ কেঁপে উঠছে। তার কাঁপা হাত, আর বুকের ভেতর বৃষ্টি নামানো ভয় নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে অন্ধকার রাস্তায়।

রাস্তার বাতিগুলো তখন নিস্তব্ধতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। সে দাঁড়িয়ে থাকে, অপেক্ষা করে—প্রেমিক আসবে। ঘণ্টা পেরোয়, রাত আরও গভীর হয়, কাঁধের চাদর পড়ে যায়, কিন্তু অপেক্ষার শেষ হয় না। হঠাৎ তার মনে হয়— প্রেমিক আসবে না। প্রতিজ্ঞা ছিল মধুর, কিন্তু পরিণতি হল প্রতারণার।

অন্ধকারে হাহাকার করা কয়েকটি ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসে। তার চিৎকার শহরের বাতাস গিলে ফেলে। এক রাতেই সুহানা হারায় নিজের দেহ, হারায় নিজের আকাশ, হারায় সর্বশেষ নিরাপত্তার সবটুকু।

ভোরবেলায় রক্তমাখা এক কিশোরীকে উদ্ধার করে থানাপুলিশ। কেউ তাকে বলে – কচি মাল, কেউ বলে ‘পালিয়ে আসা মেয়ে’। কিন্তু কেউ একবারও বলেনি—“সে এখনও অবুঝ, কৈশোর পেরোয়নি তার”!

সমাজ তার প্রতি সকল দরজা বন্ধ করে দেয়। আইনের ফাঁক গলে, মানুষের চোখের ঘৃণার তাপে, সুহানাকে ঠেলে দেওয়া হয় সেই গলিতে—যেখানে মেয়েদের নাম থাকে না, থাকে শুধু দাম।

সেখানে তার নতুন নাম রাখা হয়—মল্লিকা! তার আগের নাম, আগের স্বপ্ন, আগের লজ্জা—সব তার থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। এক রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে দেখে।

চোখ দুটো যেন আর তার নয়—এ যেন কোনো মৃত সাগরের জল। তার হৃদয় নিঃশব্দে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—"ভালোবেসেছিলাম বলেই কি আজ আমি অপরাধী? আজ আমি শুধু ধর্ষিতা নই, ধর্ষিত আমার বিশ্বাসও!”

সেখানে, পতিতালয়ের কোলাহলের মধ্যেও, সে ভেতরে ভেতরে বেঁচে থাকে এক প্রশ্ন নিয়ে—এই কি প্রেমের পরিণতি? না কি অন্ধকার সমাজের সাজানো মৃত্যুফাঁদ?

দুই.
ফলাফলে নয়, প্রেমে পাস! প্রেমিক সাপোর্ট দিয়েছে বলে ভালো রেজাল্ট, এ যেন নতুন প্রজন্মের মানসিক পরিমাপের সংকট! শিক্ষার ফল আজ আর রোল নাম্বার, গ্রেড বা শতকরা হারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা এখন হয়ে উঠেছে সামাজিক পরিচয়ের নির্মাণশিল্প। কিন্তু এই পরিচয় কি মেধার ভিত্তিতে গঠিত হচ্ছে, নাকি রোম্যান্টিক সম্পর্কের প্রদর্শনবাদী সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে একটি নতুন “ইগো-সমাজ” তৈরি হচ্ছে? সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে একচেটিয়া নামকরা প্রতিষ্ঠানের একজন এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ফলাফল সম্পর্কে প্রশ্ন পেয়ে উত্তর দিল— “বয়ফ্রেন্ডের কারণে আমার ভালো রেজাল্ট হয়েছে।”

এই উত্তরটি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো সরল কোনো বাক্য নয়। এটি একটি প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের গভীর ইঙ্গিত। কেননা এই মুহূর্তে তার মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো কেবল এক ব্যক্তির অনুভূতি নয়; এটি এক নতুন সামাজিক বাস্তবতার উচ্চারিত প্রতিধ্বনি।
শিক্ষা মানুষের আত্মপরিচয় গঠনের প্রধান সোপান। অথচ এখন অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে আত্মপরিচয় নির্মাণের প্রধান শক্তি হয়ে উঠছে "আমি কার প্রেমে আছি" বা "কে আমার প্রেমিক "। ব্যক্তিগত মেধার জায়গায় প্রেমিক বা প্রেমিকার উপস্থিতি হয়ে উঠছে সফলতার পরিমাপক। এর ফলে শিক্ষার মানসিক দর্শন বদলে যাচ্ছে—পাঠ নয়, সম্পর্ক শক্তিশালী হোক; ফল নয়, ফিলিং ভাইরাল হোক।

এখনকার সময়ের মূল কথা হলো মিডিয়া-তাড়িত আত্মপ্রদর্শন। আজকের কিশোর-কিশোরীরা কন্টেন্ট তৈরি করে বাঁচে। তারা ভাবছে না—তারা ভাবানোর চেষ্টা করে। প্রেম এখন অনুভূতি নয়, প্রমাণের প্রদর্শনী।

এ ঘটনা অনেকখানি অভিভাবক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা নির্দেশ করে।

যেখানে শিক্ষকরা চরিত্র গঠন নয়, শুধু সিলেবাস শেষকরণে ব্যস্ত; যেখানে অভিভাবকরা সন্তানের মানসিক পরিবর্তন দেখার সময় পান না—সেখানে তরুণ মানসিকতা একা হয়ে পড়ে, এবং সেই একাকিত্ব পূরণ করতে তারা প্রেমকে ‘পরিচয় রক্ষা ডিভাইস’ হিসেবে ব্যবহার করে।
ডিজিটাল সমাজের নতুন সংস্কৃতি হলো, এখন আর কেউ বলে না, "আমি ভালো করেছি"… সবাই বলে "আমি প্রেমে সফল"। কারণ সামাজিক স্বীকৃতি এখন পরীক্ষার হলে নয়, নিউজফিডে মিলে।

এই ট্রেন্ড আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বর্তমান প্রজন্ম পাঠ করছে মনস্তত্ত্বের নতুন পাঠ্যপুস্তক—যেখানে পাস নম্বর নির্ধারণ করছে আকর্ষণ, প্রতিশ্রুতি বা রোম্যান্টিক ‘সারপ্রাইজ’। এর ফলে নিজেদের মেধা ও প্রচেষ্টার জায়গায় নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে অন্যের মানসিক নিশ্চিতকরণে। যে প্রজন্ম নিজের রেজাল্টের পেছনে প্রেমিকের কৃতিত্ব খুঁজে নেয়, সে প্রজন্ম কি ভবিষ্যতে ব্যর্থতার দায়ও প্রেমিক বা প্রেমিকার ওপর চাপাবে? নাকি তখন বলবে—"বয়ফ্রেন্ড চলে যাওয়ায় আমার ক্যারিয়ার নষ্ট"? প্রেমকে দোষারোপ নয়, কিন্তু প্রেমকে শিক্ষা ও আত্মমর্যাদার প্রতিস্থাপন হতে দেওয়া যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রেমবিরোধী নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মপরিচয় শিক্ষা জরুরি। মিডিয়ার উচিত তরুণ মনের সৃজনশীল সাফল্যকে ভাইরাল করা, ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাটক নয়।

একজন শিক্ষার্থীর মুখে এমন ‘হালকা অথচ গভীর’ মন্তব্য প্রমাণ করে আমরা একটি নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি—যেখানে প্রেম মনের ব্যাপার নয়, আইডেন্টিটির অস্ত্র। এই সংস্কৃতি যদি নিয়ন্ত্রণহীন থাকে, তাহলে হয়তো আগামী প্রজন্ম তাদের ফলাফলের কৃতিত্ব প্রেমে দেবে, আর ব্যর্থতার দায় প্রেমের উপরই চাপাবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে– শিক্ষা কোথায়? আর ভালোবাসা কোথায়?

তিন.
সম্প্রতি বর্ষা, মাহির ও জুবায়েদের ঘটনাটি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—ত্রিভুজ প্রেমের শেষ কোথাও আলোর দিকে যায় না। বরং তা ছুটে চলে অন্ধকারের দিকে। যেখানে হারাতে হয় সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস—বিশ্বাস, সম্মান, মানসিক শান্তি, এবং কখনও কখনও জীবন।

এমন ঘটনা আজ নতুন নয়। রিফাত-মিন্নি-নয়ন বন্ডের মতো আরও বহু উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। কখনো একজন নারী, কখনো একজন পুরুষ—দু’পক্ষই এমন পথে পা বাড়ায়, যা শুধু ধ্বংস ডেকে আনে। সম্পর্কের দ্বৈততা, গোপন টানাপোড়েন ও আবেগের সংঘর্ষ একসময় রূপ নেয় অবিশ্বাস, ক্ষোভ ও প্রতিশোধের আগুনে। আর সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয় সবকিছু। ত্রিভুজ প্রেম, প্রেম নয়, এটি ধ্বংসের এক নির্মম সমীকরণ। ত্রিভুজ প্রেম কখনোই ভালোবাসার সৌন্দর্যকে রক্ষা করে না; বরং ধীরে ধীরে তা বিষে পরিণত করে। প্রথমে মনে হয়—এই সম্পর্কই হয়তো জীবনের সবচেয়ে রঙিন অধ্যায়, কিন্তু সময় প্রমাণ করে—এটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলের অধ্যায়।
ত্রিভুজ প্রেম সমাজের জন্য খুবই ভয়ংকর। কারণ এতে কেউই বিজয়ী হয় না। একজন হারায় বিশ্বাস, একজন হারায় আত্মমর্যাদা। আর কেউ হয়তো হারায় পুরো জীবনটাই। ত্রিভুজ প্রেমে জড়িয়ে থাকা মানে নিজের হাতে নিজের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার খাঁদে ঠেলে দেওয়া। যতক্ষণ সময় আছে, আপনি যদি বুঝতে পারেন—আপনার সম্পর্কের সমীকরণে তৃতীয় কারও উপস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তখনই সরে দাঁড়ান। কারণ সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ক্ষতি কম হয়; দেরি হলে শুধু ক্ষতি নয়, বিপর্যয় ঘটে। প্রেম কখনো জোর করে ধরে রাখার বিষয় নয়। প্রেম কখনো প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। প্রেমের নামে কাউকে হারিয়ে, কারও জীবন নষ্ট করে যে সম্পর্ক দাঁড়ায়— তা প্রেম নয়, তা একটি অপরাধমূলক আবেগের ফাঁদ। জীবনের মতো মূল্যবান আর কিছু নেই। একটি ভুল আবেগ, একটি অসম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত যেন আপনাকে এমন জায়গায় না নেয়, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। সম্পর্ক জটিল মনে হলেও তার সঠিক সমাধান হলো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত—এই না যে ত্রিভুজ সংশ্লেষে থাকতে হবে। এমন সম্পর্ক হলে মুক্ত হন, সরে আসুন—কারণ মুক্তিই শান্তির শুরু।

সম্প্রতি বর্ষা, মাহির ও জুবায়েদের ঘটনা আমাদের সামনে যে প্রশ্ন তুলে ধরেছে, তা শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এটি পুরো সমাজের মানসিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি। যে বয়সে পড়াশোনার চাপে থাকার কথা, পরীক্ষার হলে স্বপ্ন লেখার কথা—সেই বয়সে আজকের তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে জটিল প্রেম, প্রতারণা, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও অপরিণত আবেগের ভয়ংকর খেলায়। ফলাফল– খুন, আত্মহত্যা বা জীবন-সংহারী ঘটনা। এই বয়স হলো ব্যক্তিত্ব গঠনের সময়, এই বয়স হলো দিশা নেওয়ার সময়, কিন্তু আজ এই বয়সেই তারা নিজেকে হারাচ্ছে আবেগের অন্ধ ঘূর্ণিপাকে।

আসলে মূল সমস্যা খুঁজতে গিয়ে যা মনে হয়, পরিবারে মানসিক সহায়তার অভাব, সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ ব্যবহার, অল্প বয়সে প্রেমকে জীবনের কেন্দ্র ভাবা, শিক্ষার জায়গায় বিনোদনকে প্রাধান্য দেওয়া, নৈতিক শিক্ষা ও আত্মসংযমের অনুপস্থিতি। ফলে তরুণ-তরুণীরা এমন এক আবেগের স্রোতে ভেসে যায়, যেখানে ভালোবাসা নয়, বরং প্রতিযোগিতা, প্রতিশোধ ও আকর্ষণের মোহ তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। তারা বুঝতেই পারে না—একটি ভুল সিদ্ধান্ত শুধু একজনের ক্ষতি করে না বরং কয়েকটি পরিবার, একটি সমাজ, এমনকি একটি জাতির ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে দেয়। তাই আমাদের এখনই ভাবতে হবে, এভাবে যদি তরুণ প্রজন্ম নিজেদের হারানো শুরু করে, তাহলে দেশের আগামী প্রজন্মের ভিত কার হাতে থাকবে? জ্ঞান ও নৈতিকতা যেখানে হবার কথা তাদের মূল শক্তি, সেখানে যদি আবেগ ও সম্পর্কের নোংরা জটিলতা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে—তাহলে আমরা কেমন ভবিষ্যৎ তৈরি করছি? তাই এখনই প্রয়োজন—সংযম শেখানো, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা দেওয়া এবং সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। কারণ যদি আজ আমরা নীরব থাকি, আগামীকাল আরও অনেক “বর্ষা-মাহির-জুবায়েদ” আমাদের সামনে আসবে। এবং তখন হয়তো ক্ষতির হিসাব করার মতো সময়ও আর থাকবে না।

এখনই পরিবর্তনের সময়। পরিবারে মা বাবা সন্তানের ভুলকে ঢেকে না রেখে, সত্যকে স্বীকার করার মানসিকতা গড়ে তুলুন, মমত্ববোধ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু অন্ধ স্নেহ সন্তানকে নৈতিক পতনের দিকে ঠেলে দেয়। ভুল করলে “সে ছোট” – এই যুক্তি না দিয়ে ভুলকে ভুল হিসেবেই চেনাতে হবে। শিক্ষিত হওয়া মানে কেবল বই পড়া নয়; সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, অপরাধ-বিবেকের মধ্যে পার্থক্য বোঝানোই হলো মূল শিক্ষা। ঘরেই সন্তানের নৈতিক মেরুদণ্ড তৈরি হয়। বন্ধুর মতো কাছে রাখা, কিন্তু অভিভাবকের মতো নিয়ন্ত্রণ করা, সন্তান যেন তার যে-কোনো কথা বিনা ভয়েই বলতে পারে—এই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবে সেই কথার বিচার-বিশ্লেষণ করে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা হবে বাবা-মায়ের দায়িত্ব। ডিজিটাল ও সামাজিক জীবনের ওপর নজর রাখা, কার সাথে মিশছে, কী কনটেন্ট দেখছে, অনলাইনে কি শিখছে – এগুলো 'ব্যক্তিগত স্বাধীনতার নামে ছেড়ে দিলে চলবে না। বরং সচেতন উপস্থিতি রাখতে হবে। অপরাধের শুরু হয় ছোট অবহেলা থেকে তা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া:

মিথ্যা বলা, হিংসা করা, কারো ক্ষতি করে আনন্দ পাওয়া—এই সব আচরণ যদি শুরুতেই থামানো না হয়, তা ভবিষ্যতে ভয়ানক রূপ নেয়। দোষ ঢাকতে আবেগ নয়, ন্যায়বোধ জাগ্রত করা জরুরি, সন্তান যদি অপরাধে জড়ায়, 'আমার সন্তান পারবে না'—এটি অন্ধ বিশ্বাস নয়, বরং বাস্তব যাচাই করতে হবে। আইন ও সমাজের সামনে সত্যকে স্বীকার করা এবং সন্তানের সংশোধনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত। নিজেদের জীবনযাপন দিয়ে সন্তানকে উদাহরণ দেখানো, মা-বাবা যদি ঘুস, মিথ্যা, প্রতারণা, দুর্নীতিকে স্বাভাবিক মনে করে—তবে সন্তানও সেটাকেই জীবনের বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করবে। সম্মান ও মানবিকতার বীজ পরিবার থেকেই বপন করতে হবে, সন্তান যেন অন্যের জীবন, অনুভূতি ও অধিকারের প্রতি সচেতন হতে শেখে। অপরাধের মানসিকতা তৈরি হয় তখনই যখন সে অন্যকে মানুষ হিসেবে না দেখে 'বস্তু' হিসেবে দেখতে শুরু করে। পরিবারে আলোচনার সংস্কৃতি তৈরি করা, সন্তানের সাথে অপরাধ, নৈতিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে নিয়মিত কথা বলা জরুরি। বাস্তব উদাহরণ ধরে বুঝাতে হবে—অপরাধের পরিণতি কেবল আইনি নয়, মানসিক ও পারিবারিক মৃত্যুও বয়ে আনে।

সন্তানের ভুল স্বীকারের সুযোগ তৈরি করতে হবে, ভুল করলে তাকে সামাজিক অপমান নয়, সংশোধনের পথ দেখাতে হবে। পরিবারের উচিত— ‘অপরাধীকে রক্ষা নয়, মানুষকে বাঁচানো’ এই নীতি গ্রহণ করা।

সমাজে বর্ষা-মাহির বা জোবায়েদের জন্ম হঠাৎ করে ঘটে না; তারা তৈরি হয় দীর্ঘদিনের অবহেলা, অন্ধ স্নেহ এবং দায়িত্বহীন পারিবারিক মানসিকতার মধ্য দিয়ে। তাই পরিবর্তনের সূচনা ঘর থেকেই করতে হবে। সন্তানকে ভালোবাসা মানে তাকে অন্ধভাবে রক্ষা করা নয়, বরং সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ধৈর্য, নীতি, সাহস ও সদিচ্ছা নিয়ে পাশে দাঁড়ানো। এখনই সময়—পরিবারকে দায়িত্বের আসনে ফিরে আসার।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article