কখনো মুখে হাসি, কখনো চোখে দৃঢ়তা-রবিন উথাপ্পা যেন ছিলেন ক্রিকেট মাঠের এক স্থির আলো। বড় শহরের তারকা নয়, কর্নাটকের কোডাগুর এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই ক্রিকেটার নিজের পরিশ্রমে লিখেছেন অনন্য এক সাফল্যের গল্প।
জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া, বাদ পড়া, আবার ফিরে আসা প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল তার জন্য লড়াইয়ের আরেক নাম। কিন্তু যতই বাধা আসুক, তিনি থামেননি। কারণ উথাপ্পা বিশ্বাস করতেন ‘ব্যর্থতা শেষ নয়, বরং নতুন শুরু করার ডাক’। আজ তার জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক সেই ক্রিকেটারের জীবন, যিনি বারবার প্রমাণ করেছেন হার মানা তার অভিধানে নেই।

১৯৮৫ সালের এই দিনে কর্নাটকের কোডাগু জেলার এক ছোট শহরে জন্মেছিলেন উথাপ্পা। ছোট্ট জায়গার সেই ছেলেটি একদিন ভারতের জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন হয়তো তখন কেউ ভাবেনি। কিন্তু পরিশ্রম, দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাসের জোরেই উথাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল নাম।

রবিনের জন্ম কোডাগুতে, যে অঞ্চলটি ভারতের ‘ক্রিকেট নার্সারি’ হিসেবে পরিচিত। কোডাগু মানেই খেলার আবহ, বিশেষ করে হকি। তার বাবা ভেনু উথাপ্পা ছিলেন ভারতের জাতীয় হকি দলের একজন স্বীকৃত আম্পায়ার। আর সেখান থেকেই ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ জন্মে রবিনের মনে।

তবে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়টা হয়েছিল স্কুলজীবনেই। কর্নাটকের বাঙ্গালুরুতে পড়াশোনা করার সময় থেকেই তিনি ব্যাট হাতে ঝড় তুলতে শুরু করেন। তার স্টাইল ছিল অন্যরকম আক্রমণাত্মক, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত। বোলারদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে ভালোবাসতেন।

২০০৫ সালে চ্যালেঞ্জার ট্রফিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর আলোচনায় আসেন উথাপ্পা। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি খেলেন জাতীয় দলের হয়ে, ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে। সেই ম্যাচেই করেন ৮৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। সেই ইনিংসের পর থেকেই ক্রিকেটপ্রেমীদের নজর পড়ে এই তরুণের দিকে।

২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে করেন ঝড়ো হাফসেঞ্চুরি। আর সেই বছরই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী টি২০ দলে থাকা, যেকোনো ক্রিকেটারের জন্যই গর্বের বিষয়, আর উথাপ্পা সেই গর্ব অর্জন করেছিলেন নিজের মেধা ও সাহস দিয়ে।

২০০৮ সালে যখন আইপিএলের যাত্রা শুরু হয়, তখনই উথাপ্পা ছিলেন অন্যতম আলোচিত ব্যাটসম্যান। তিনি খেলেছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু, পুনে ওয়ারিয়ার্স, কলকাতা নাইট রাইডার্স ও চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে।

২০১৪ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্সের জার্সিতে তার পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। সেই মৌসুমে সর্বাধিক রান সংগ্রাহক হিসেবে জিতেছিলেন ‘অরেঞ্জ ক্যাপ’। তার ধারাবাহিকতা, সাহসী শট নির্বাচন আর উইকেটের পেছনে ফুরফুরে নড়াচড়া তাকে বানিয়েছিল দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়।

মোট ২০০ এরও বেশি আইপিএল ম্যাচে তিনি করেছেন প্রায় ৫ হাজার রান। স্ট্রাইক রেট ও গড় দুটিই ছিল প্রশংসনীয়। ক্রিকেটবিশ্লেষকদের মতে, আইপিএলের ইতিহাসে ভারতীয় মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে উথাপ্পা অন্যতম সফল।

সাফল্যের গল্প যেমন উজ্জ্বল, তেমনি তার আড়ালেও থাকে কিছু অন্ধকার অধ্যায়। উথাপ্পার জীবনে তেমন অধ্যায়ও ছিল। একসময় জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে যান, চোট ও ফর্মহীনতায় ভুগেছিলেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের মাধ্যমে আবারও নিজের জায়গা ফিরে পান।

তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মানুষ ভাবে, প্রতিভা থাকলেই সব সহজ হয়। আসলে মানসিক দৃঢ়তাই আসল শক্তি।’ এই দৃঢ়তাই তাকে সবসময় আলাদা করে দিয়েছে। মাঠে ব্যর্থতার পরও তার মুখে থাকত হাসি, ব্যাটে থাকত আত্মবিশ্বাস।

২০১৬ সালে উথাপ্পা বিয়ে করেন টেনিস খেলোয়াড় শীথাল গৌতমকে। দুজনের সম্পর্কের ভিত্তি বন্ধুত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। উথাপ্পা প্রায়ই সাক্ষাৎকারে বলেন, তার জীবনের স্থিরতা ও মানসিক ভারসাম্যের বড় অংশীদার তার স্ত্রী।

অবসর পরবর্তী সময়ে তিনি এখন ক্রিকেট বিশ্লেষক, ধারাভাষ্যকার ও মোটিভেশনাল বক্তা হিসেবে কাজ করছেন। জীবন ও ক্যারিয়ার দুটিরই অভিজ্ঞতা এখন তিনি ভাগ করে নিচ্ছেন তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে।
রবিন উথাপ্পা শুধু ব্যাটসম্যান নন, তিনি এক অনুপ্রেরণার নাম। ছোট শহর থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জায়গা করে নেওয়া, আবার ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সব মিলিয়ে তার জীবন যেন অধ্যবসায়ের প্রতিচ্ছবি।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। তবে অবসর মানেই শেষ নয়, বরং নতুন সূচনা। বর্তমানে তিনি সামাজিক কাজ, কোচিং এবং ক্রিকেটের বিশ্লেষণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। তার অভিজ্ঞতা ও ব্যাটসম্যানশিপের দৃষ্টিভঙ্গি নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করছে।
রবিন উথাপ্পার গল্প কেবল ক্রিকেটের নয়, এটি অধ্যবসায়ের এক গল্প। জীবনের প্রতিটি উত্থান-পতনে তিনি শিখিয়েছেন হার মানলে হার, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে গেলে প্রত্যেকটাই জয়ের রাস্তা খুলে যায়।
জেএস/

8 hours ago
5









English (US) ·