চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

11 hours ago 8

নগরীর যানজট নিরসনে জাদুর কাঠির মতো কাজ করছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। চার লেনের এ উড়াল সড়কের মূল লেনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। গাড়ি ছুটছে ঘণ্টায় ৮০-১০০ কিলোমিটার গতিতে। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে এর সুফল ভোগ করছে ঢাকাবাসী।

এক সময় নদীর মধ্যে দিয়ে টানেল ছিল কল্পনা। অথচ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছে বহুল আলোচিত টানেল। এটা চীনা প্রযুক্তির এক অনন্য উদাহরণ। ৯৮৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে টানেলটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চায়না কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

খরস্রোতা পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণও সহজ ছিল না। কিন্তু কঠিন কাজটি সহজ হয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। ফলে চীনা ঋণ, অনুদান নয়, বরং তাদের প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের গল্প।

কর্ণফুলী টানেল

২০২৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয় দেশের প্রথম টানেল। এর মাধ্যমে নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সড়ক টানেলের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এটা বিশাল ও শক্তিশালী এক ধরনের যন্ত্র, যা নদীর তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গ খনন করতে সক্ষম।

চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

এই বিশেষ টিবিএম মেশিনটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড়, যা প্রায় ৫শ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় বছর ধরে চীনের চাংশু এলাকায় তৈরি করা হয়। এটি টানেল নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত একটি স্বয়ংক্রিয় খনন যন্ত্র, যা ঘুরন্ত কাটার হেড দিয়ে মাটি ও পাথর কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করে। এই উন্নত প্রযুক্তি ছাড়া টানেল নির্মাণ কঠিন হতো।

পদ্মা রেলসেতু প্রকল্পেও আধুনিক প্রযুক্তি

পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে চীনের অর্থায়নে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কংক্রিটের স্লিপার ব্যবহার করে রেল ট্র্যাক তৈরি করা হয়। এছাড়া সেতুটি নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা দ্রুত এবং উন্নতমানের কাজ নিশ্চিত করেছে। রেললাইন তৈরি ও ট্র্যাক স্থাপন করা হয় আধুনিক চীনা প্রযুক্তিতে, যার মধ্যে রয়েছে কংক্রিটের স্লিপার ব্যবহার।

পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু থেকেই ছিল চ্যালেঞ্জিং। নির্মাণকাজের প্রতিটি পর্বেই কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল। খরস্রোতা পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণ মুখের কথা নয়। এখানে নদীশাসন যেমন চ্যালেঞ্জিং ছিল, তেমনি নদীর তলদেশে পাথর না থাকায় পাইলিং করাটাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সব কিছুই সম্ভব হয়েছে বিস্ময়কর চীনা প্রযুক্তির জন্য।

চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

পাইলিংয়ের উপরিভাগে স্ক্রিন গ্রাউটিং করে (অতিমিহি সিমেন্টের স্তর) পাইলের ওজন বহনক্ষমতা বাড়ানো হয়। পিলার ও স্টিলের কাঠামোর সংযোগস্থলে ১০০ টনের বিয়ারিং বসানো হয়। সাধারণত সেতুতে বিয়ারিং বসানো হয় দুটি করে। কিন্তু পদ্মা সেতুতে দুই স্প্যানের সংযোগস্থলে তিনটি করে বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে চীনা প্রযুক্তির কল্যাণে।

আরও পড়ুন
চীনা অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত এগোচ্ছে, আসছে কারিগরি দল
চীনা অনুদানে দেশের স্বাস্থ্যখাতে নতুন দিশা

সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আর প্রযুক্তি-প্রকৌশলে পাঁচটি বিশ্বরেকর্ড স্পর্শ করেছে পদ্মা সেতু। গভীরতম পাইল ও পেন্ডুলাম বিয়ারিং এর অন্যতম।

চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

পৃথিবীর বড় বড় তিনটি ড্রেজার আনা হয়েছিল। সেগুলোর মাধ্যমে নদীর তলায় ৮শ কেজির জিওব্যাগে তুলনামূলকভাবে মোটা বালি ভরে বটম লেয়ার বা স্তর তৈরি করা হয়েছে।

পদ্মা সেতু ছাড়াও চীনের অনুদানে বাংলাদেশে বেশ কিছু সেতু নির্মিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলাকে সংযুক্তকারী অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু।

এভাবেই বিগত এক দশকে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চীনের ঋণপ্রবাহের পাশাপাশি চীনের কল্যাণকর প্রযুক্তির প্রয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। চীনের প্রযুক্তি আরও ব্যবহার করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে বলে দাবি করেছেন অর্থনীতিবিদেরা।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বিশ্বব্যাংক-এডিবি থেকে স্বল্পসুদে ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। তখন কমার্শিয়াল ঋণে যেতে হবে। কমার্শিয়াল ঋণে যেতে হলে চীন থেকে বেশি ঋণ নিতে হবে। চীন আমাদের উন্নয়নের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী।- অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বিশ্বব্যাংক-এডিবি থেকে স্বল্পসুদে ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। তখন কমার্শিয়াল ঋণে যেতে হবে। কমার্শিয়াল ঋণে যেতে হলে চীন থেকে বেশি ঋণ নিতে হবে। চীন আমাদের উন্নয়নের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তারা বড় প্রকল্পে সহযোগিতা দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘চীন শুধু ঋণ দিচ্ছে না, তারা প্রযুক্তি দিয়েও আমাদের পাশে রয়েছে। আমরা সবাই জানি চীন এখন প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। তিস্তা মহাপরিকল্পনায়ও তারা আমাদের সহযোগিতা করছে। চীন তিস্তা প্রকল্পে টেকনিক্যালি অনেক পজিটিভ। এতে উত্তরবঙ্গে কৃষিতে ভালো কাজ হবে। তারা আমাদের অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী। মিলিটারিতেও আমাদের নানাভাবে সহায়তা দেয়।’

চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘চীনা ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে যদি পারি তবে দেশের উন্নয়নের চিত্র আরও পাল্টে যাবে। চীন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে খুবই গুরুত্ব দেয়। এটা কাজে লাগাতে হবে। চীন দ্রুততার সঙ্গে প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সহায়তা উন্নয়ন ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। তাদের ভূমিকাটা খুবই জরুরি।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নের মূলই হলো নিজেই স্বাবলম্বী হওয়া। যমুনা সেতু যখন নির্মিত হয় তখন আমরা দর্শকের ভূমিকায় ছিলাম। যারা সরকারে আছে তারা পলিসি নেবে। চীন যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তাদের সঙ্গে আমাদের লোকজন থাকলে এটা দেশের জন্য মঙ্গল। নির্মাণকাজের সময় যে নলেজ হয় সেগুলো কাজে লাগানো যায় অন্য সময়ে।’

তিনি বলেন, ‘যারা চীনের কাছ থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হবে তাদের পুল করে রেখে দেওয়া যায়, যাতে পরবর্তী একই ধরনের প্রকল্পে তাদের কাজে লাগানো যায়। চীন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে আমরা যেন দর্শকের ভূমিকায় না থাকি। পড়াশোনা করে অভিজ্ঞতা হয় না, অভিজ্ঞ হতে গেলে কাজ করতে হবে। হাতে-কলমে শিখতে হবে। ট্রান্সফার অব টেকনোলজি এখন ভ্রমণসর্বস্ব। এটা বাদ দিতে হবে। চীনের মধ্যে লোকাল লোকদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা সেতু রেল লিংক, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্ল্যান্টের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়েছে চীনের অর্থায়নে। অর্থায়নের পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেও ছিল চীনের বড় বড় কোম্পানির অংশগ্রহণ।

ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কিছু কিছু পিলারের কাজও দৃশ্যমান। ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে। মোট এক হাজার ৯৬০টি পিলারের মধ্যে এক হাজার ২০০টি পিলার দাঁড়িয়ে গেছে। সার্বিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি চার লাখ টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৯ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। বাকি সাত হাজার ৮৬০ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।

স্বপ্নের তিস্তাসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে আরও আসছে চীনা ঋণ

চীনা ঋণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কাজ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছে ৬ হাজার ৭শ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কারও বিরুদ্ধে নয়, কারও নির্দেশনায়ও চলে না
বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন

সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এ বছরের মধ্যেই আর্থিক চুক্তিতে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাগ্রিমেন্ট) সই করতে পারে দুই দেশ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, এরই মধ্যে চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থা প্রকল্পের সমীক্ষা করেছে। প্রকল্পটির পুরো নাম ‘কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব তিস্তা রিভার প্রজেক্ট’ বা তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প চীনের ঋণে বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের আগ্রহ রয়েছে। চীনও প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করতে চায়। দুই পক্ষের সম্মতিতেই বিষয়টি অগ্রসর হচ্ছে। চলতি অর্থবছর চীনের সঙ্গে হওয়া ঋণচুক্তির ফলে চারটি প্রকল্প খুব দ্রুতই আবার গতি ফিরে পাবে।

চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

জানা যায়, বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ছয়টি পূর্ণাঙ্গ স্টেশন স্থাপনের জন্য চীনের কাছে ১২৫ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়ে করা আবেদনটির প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে চীন। প্রকল্পটি সরকারি ক্রয় সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটি ও একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পটিতে চীনা ঠিকাদার মনোনয়নের জন্য অপেক্ষা করছে দেশটি। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ঐতিহাসিক চীন সফরে দেশটির সরকার ও কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ।

চীন মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০ কোটি ডলার ঋণ, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫ কোটি ডলার ও প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরও ১৫ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্য ঋণসহায়তা হিসেবে আসবে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় ড. ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বাংলাদেশে চীনের বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগের জন্য সবুজ সংকেত দেওয়ার অনুরোধ জানান। রংপুরে বিশেষ হাসপাতালও নির্মাণ করবে চীন।

চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব ঋণ আসছে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের আওতায়। নতুন করে স্বাস্থ্যখাতে চীনের ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে চীন। পাইপলাইনে আরও কিছু আছে। তিস্তা প্রকল্পের প্রস্তাবও আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে এটা সরকারি সিদ্ধান্ত। দেখা যাক কী হয়। এখনো চীনের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত মতামত আসেনি।’

চীনা বিনিয়োগ চাওয়া হতে পারে যে সব প্রকল্পে

আরও কিছু প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ চাইবে বাংলাদেশ। অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনা, তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশন পর্যন্ত রেললাইন মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি স্থাপন এবং পৌরসভাগুলোর জন্য পানি সরবরাহ প্রকল্প। ১১ প্রকল্পে চীন থেকে ৫০২ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। যদিও এর একটিরও কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে ভারতও বিনিয়োগ করতে চায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

যারা চীনের কাছ থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হবে তাদের পুল করে রেখে দেওয়া যায়, যাতে পরবর্তী একই ধরনের প্রকল্পে তাদের কাজে লাগানো যায়। চীন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে আমরা যেন দর্শকের ভূমিকায় না থাকি। পড়াশোনা করে অভিজ্ঞতা হয় না, অভিজ্ঞ হতে গেলে কাজ করতে হবে। হাতে-কলমে শিখতে হবে।- পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘চীনা ঋণে বাস্তবায়নাধীন ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে কাজে আসছে। তবে চীনের ঋণে প্রতিযোগিতামূলক ক্রয়ের সুযোগ থাকে না। তাদের কাছে ঠিকাদারিসহ পণ্য যন্ত্রপাতি কিনতে হয়। যার কারণে শুধু সুদের হার কস্টলি হয়ে যায়। বিশেষ করে প্রকিউরমেন্টের ক্ষেত্রে। দরকষাকষিসহ প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া, পণ্য কেনায় প্রতিযোগিতা না থাকলে খরচ বেশি হয়ে যায়।’

ক্রমে বাড়ছে চীনা ঋণ

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায়, যেখানে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিল দেশটি, সেখানে গত ১২ বছরে দিয়েছে ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে প্রতিশ্রুত ঋণ ১০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ঋণ দেওয়া উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে চীন।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে, যা মোট ঋণের ৩১ শতাংশ। এরপরই রয়েছে এডিবি ২৩ শতাংশ এবং মোট ঋণের ১৭ শতাংশ জাপানের কাছ থেকে নেওয়া। এরপরই রাশিয়া ১০ শতাংশ এবং মোট ঋণের ৯ শতাংশ নেওয়া চীনের কাছ থেকে।

গত এক দশকে চীনের প্রতিশ্রুত ঋণ ও ঋণছাড় দুটোই বেড়েছে। ২০১৩ সালে চীনের ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ কোটি ডলার। ছাড় করে ৭ দশমিক ৭ কোটি ডলার। ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতি ছিল ৫ কোটি ডলার, ঋণছাড় করে ৪৭ দশমিক ২৭ কোটি ডলার। মূলত ২০১৪ সাল থেকে চীনা ঋণের প্রবাহ ও ছাড় বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে চীন কোনো ঋণের প্রতিশ্রুতি না দিলেও ১২ দশমিক ১২ কোটি ডলার ছাড় করে।

এর পরের পাঁচ বছরে ঋণছাড় ছিল ভালো মাত্রায়। ২০২০ সালে চীন ২৪২ দশমিক ৭৪ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ছাড় করে ৬৯ দশমিক ৫৪ কোটি ডলার। ২০২১ সালে কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকলেও ৮৮ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার ছাড় করে দেশটি। ২০২২ সালে প্রতিশ্রুত ঋণ ১১২ দশমিক ৬৯ কোটি ডলার, ছাড় ৯৮ দশমিক ৯৫ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে ২৭ দশমিক ৬২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের বিপরীতে ছাড় ১১৩ দশমিক ২৭ কোটি ডলার।

এছাড়া ভারতের সঙ্গে যেভাবে টাকা-রুপিতে লেনদেনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় টাকা-ইউয়ানে লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।

চীনা ঋণের সিংহভাগ এসেছে শেষ ৬ বছরে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে চীন বাংলাদেশকে যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার ৯৫ শতাংশই এসেছে গত ১২ বছরে। শেষ ছয় বছরে এসেছে ৮৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়েছে দেশটির ঋণছাড়। অর্থাৎ, ২০১৩ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই (এক অঞ্চল, এক পথ) চালুর পর থেকেই বড় আকারে ঋণ দেওয়া শুরু করে।

জানা যায়, ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়। এসব প্রকল্পে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। যার মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণের চুক্তি হয়েছে। তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির অপেক্ষায়। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত অর্থছাড়ও বাড়ে। চীনের প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এই অঙ্গীকার প্রধান উপদেষ্টা বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানোর পর এসেছে।

ইআরডির তথ্যমতে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের মোট ঋণের স্থিতি ছিল ৬২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীনের অংশ ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের ঋণের স্থিতিতে চীনের অবস্থান চতুর্থ। চীন সরকার সাধারণত দুই ধরনের ঋণ দেয়, এর একটি হলো মার্কিন ডলারে প্রেফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) এবং অন্যটি চীনের নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল)।

চীনা ঋণে চলমান ছয় প্রকল্প

চীনা ঋণে চলমান ছয় প্রকল্প হচ্ছে- চট্টগ্রামের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পিজিসিবির আওতায় বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন, ডিপিডিসির আওতায় বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং রাজশাহী ওয়াসার ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ প্রকল্প। কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরের তলদেশ দিয়ে তেল সরবরাহের জন্য নির্মিত পাইপলাইন এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম প্রকল্প নামে পরিচিত। এর আগে, গত বছরের জুলাইয়ে রাজধানীর আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে চালু হয় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধনাগারের কার্যক্রম। ঋণের বাইরে অনুদানের টাকায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আটটি মৈত্রী সেতু নির্মাণ করেছে চীন।

কমবে সহজ শর্তের ঋণ, বাজারভিত্তিক বড় ভরসা চীন

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) আগেই বাংলাদেশের নমনীয় বা সহজ শর্তের ঋণপ্রবাহ ক্রমাগত কমছে। এতে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে বৈদেশিক ঋণ। এমনকি গত অর্থবছরে সরকারের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেকই বাজারভিত্তিক হারে নেওয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর সহজ শর্ত বা নমণীয় ঋণের ওপর আরও প্রভাব পড়বে। তখন বাজারভিত্তিক ঋণের প্রবাহ আরও বাড়বে। বাজারভিত্তিক ঋণের প্রবাহ বাড়লে দেশের উন্নয়নে চীন বড় ভরসা হবে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, সরকারের বাজারভিত্তিক ভাসমান সুদহারের ঋণ বড় আকারে উল্লম্ফন হয়েছে। বর্তমানে এলডিসি হিসাবে থাকার পরও বাংলাদেশ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে তার ৪২ দশমিক ৭ শতাংশই বাজারভিত্তিক ঋণ। এর আগের অর্থবছরে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ দশমিক ২ শতাংশ।

সুদহার বাড়ায়নি চীন

গত দুই অর্থবছর ধরে চীনের কোনো ঋণে সুদ বাড়েনি। তবে চীন ডলারে নির্দিষ্ট সুদে ঋণ না দিয়ে বাজারভিত্তিক হার এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে (আরএমবি) ঋণ দিতে আগ্রহী। বর্তমানে চীনা ঋণের সুদহার ২ শতাংশ।

তবে চীনা ঋণ ও প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে নিযুক্ত ডিভিশন ডিরেক্টর জ্যা পেম সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। জ্যা পেম বলেন, কোন প্রকল্পে চীনা ঋণ নেওয়া হচ্ছে এটা দেখতে হবে। তবে বাংলাদেশে চীনা ঋণের বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানি না। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি না।

এমওএস/এএমএ/এএসএ/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article