অন্তর্বর্তী সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে ভোটব্যাংক তৈরিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামীসহ ছয়টি দল নির্বাচনি সমঝোতা করছে। ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিনের বৈরিতা ভুলে সমঝোতায় আসছে।
তাদের সমঝোতার উদ্দেশ্য, আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ।
জাগো নিউজ: ছয়টি ইসলামি দল নির্বাচনি সমঝোতায় আসছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। আপনাদের (ইসলামী আন্দোলন) নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন?
ইউনুছ আহমাদ: আলহামদুলিল্লাহ, আমরা অনেক আগে থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছি। ৩০০ আসনেই যেন প্রার্থী দিতে পারি, সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে মতামত নিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে। যেহেতু আমরা সমঝোতা করব, প্রার্থীদের আগেই বলা হয়েছে, সমঝোতা হলে প্রয়োজনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হতে পারে। এরই মধ্যে প্রার্থী ঘোষণার পর তারা এলাকায় গণসংযোগ করছেন, দাওয়াতি দল মাঠে কাজ করছে, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি গঠনের কাজ চলছে। অনেক স্থানে পোলিং এজেন্ট নির্ধারণও সম্পন্ন। এরপর তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নির্বাচনের কোনো দিক বাদ না রেখে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছি।
জাগো নিউজ: সমঝোতা হলে কয়টি আসনে জয়ের আশা করছেন?
ইউনুছ আহমাদ: যেহেতু এটা শুধু এক দলের নয়, কয়েকটি দলের সমঝোতা, তাই আমরা একসঙ্গে বসব। প্রত্যেক দলকে বলা হয়েছে, নিজ নিজ এলাকায় কাজ চালিয়ে যেতে। যেখানে যার অবস্থান, জনপ্রিয়তা ও জনশক্তি ভালো, সেখানে তাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। সেটা জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস কিংবা আমাদের নির্বাচনি সমঝোতায় আসা যে দলই হোক না কেন। আমরা আগেই বলেছি, সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আমাদের আছে। ইসলামি শক্তির উত্থানই আসল লক্ষ্য, আমরা কম আসন পেলেও সমস্যা নেই। আমাদের সংগঠন তৃণমূল পর্যন্ত শক্তিশালী, তাই প্রার্থীদের পেছনে অর্থ ব্যয় না করে কর্মীরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছেন।
আরও পড়ুন
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করে যাবো
তফসিলের আগে গণভোট ও গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে: চরমোনাই পীর
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায় অস্পষ্টতা রয়েছে: ইসলামী আন্দোলন
জাগো নিউজ: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নিজেদের ভোটব্যাংক নিয়ে কোনো জরিপ করেছে?
ইউনুছ আহমাদ: আলাদা করে ভোটব্যাংক জরিপ করিনি। তবে আমরা কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি, কর্মী-সমর্থকরা কাকে পছন্দ করছেন, কাকে সমর্থন দিচ্ছেন, সেটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। আমাদের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে, তৃণমূলের সাড়া আগের চেয়ে অনেক বেশি। নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমেই সেটি স্পষ্ট হবে।
জাগো নিউজ: ইসলামি দলগুলোর নতুন এই সমঝোতা কি সাময়িক নির্বাচনি জোট, নাকি স্থায়ী ঐক্যের সূচনা?
ইউনুছ আহমাদ: প্রায় ৫৪ বছর ধরে দেশের মানুষ নানান দলের শাসন দেখেছে, কিন্তু তারা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এখন মানুষ বিকল্প খুঁজছে। এই বিকল্প শক্তি হলো ইসলামি শক্তি। আগে অনেকে বলতেন, ‘হুজুররা রাজনীতি করবে কেন?’ এখন মানুষের চেতনা বদলেছে। তারা বুঝেছে—ভালো মানুষদেরও রাষ্ট্র পরিচালনায় আসা দরকার। সেই চেতনা থেকেই ইসলামি নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। ফলাফল যাই হোক এখন পর্যন্ত আশা আছে, আমাদের ঐক্য স্থায়ী হবে।
জাগো নিউজ: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সূচনা কখন থেকে?
ইউনুছ আহমাদ: ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৮৭ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর আগে ১৯৮১ সালে হাফেজি হুজুর (রহ.) নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলে আমরা তার প্রতি সমর্থন জানাই। এরপর ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়ে ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের যাত্রা শুরু। পরে ২০০৮ সালে নাম পরিবর্তন করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ হয় এবং নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়।
জাগো নিউজ: জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বহুদিন বৈরী সম্পর্ক ছিল, এখন হঠাৎ সমঝোতার কারণ কী? এই ঐক্যের পেছনে কাদের ভূমিকা বেশি?
ইউনুছ আহমাদ: আগে জামায়াতের সঙ্গে কিছু মতাদর্শগত ভিন্নতা ছিল, বিশেষ করে ইসলামি শাসনব্যবস্থা নিয়ে। কিন্তু এখন সবাই বুঝছে—যার যার অবস্থান ও মতাদর্শ বজায় রেখেও একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব। এজন্যই আমরা জোট নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে এগোচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ইসলামি শক্তির ঐক্য, নেতৃত্ব দখল নয়। জোট হলে এক আমির কিংবা নেতৃত্বের বিষয়ে দ্বন্দ্ব হতো। এখন তা নেই। ঐক্যের জন্য আমরা সবাই আগ্রহী ছিলাম। যেহেতু বিগত ৫৪ বছরে কোনো শাসক জনগণের দুঃখ-দুর্দশা তেমন দূর করতে পারেনি। প্রতিটি দলে একজন করে ঐক্যের জন্য যোগাযোগ মেইনটেইন করছে। এরপরই নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়ে একমত হয়েছে।
আরও পড়ুন
ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনি সমঝোতা কীভাবে?
উচ্চশিক্ষিত অনেকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি: রেজাউল করীম
নভেম্বরে গণভোটসহ নানা দাবিতে ইসিতে জামায়াতসহ ৮ দলের স্মারকলিপি
জাগো নিউজ: কেউ কেউ বলছেন এ সমঝোতা ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশলমাত্র। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ইউনুছ আহমাদ: ইসলামী আন্দোলন কখনো ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেনি। আমাদের কাছে বহু প্রস্তাব এসেছে—কত আসন লাগবে, কী চাই। কিন্তু আমরা আদর্শের প্রশ্নে আপস করিনি। আমাদের লক্ষ্য ক্ষমতা নয়, বরং আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও জাতির আশা পূরণ।
জাগো নিউজ: সমঝোতা নিয়ে আপনাদের দলের ভেতরে সমালোচনা হচ্ছে, কেউ বলছেন ইসলামী আন্দোলনের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হচ্ছে—এ বিষয়ে কী বলবেন?
ইউনুছ আহমাদ: কিছু মিডিয়া সবসময় ইসলামি শক্তিকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে। তারা ইসলামি উত্থান দেখতে চায় না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষ আমাদের কথা জানতে পারছে। সমঝোতা মানেই স্বাতন্ত্র্য হারানো নয়। আমরা কারও নেতৃত্বে যাচ্ছি না, সবাই সমান ভিত্তিতে কাজ করছে। প্রোগ্রামগুলোর সভাপতিত্বও সবাই পর্যায়ক্রমে করছে। তাই এটা নিয়ে কোনো সমস্যা দেখি না।
জাগো নিউজ: জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আকিদাগত দূরত্ব কমেছে কি?
ইউনুছ আহমাদ: আকিদা নিয়ে সব দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আমরা নির্বাচনি সমঝোতা করছি। যার যার মতাদর্শ তাদের কাছে। নির্বাচন কিংবা রাজনৈতিক ঐক্যে এসবের প্রভাব নেই। এরপরেও আকিদা প্রশ্নে জামায়াতের কাছ থেকে ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। তারা আমাদের জানিয়েছেন, যে বিষয়ে সমস্যা আছে লিখিতভাবে দিলে তারা সেটি নিয়ে বসবে। আমরা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখি।
জাগো নিউজ: যদি সমঝোতার মাধ্যমে আপনাদের দল রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়, আপনারা কীভাবে দেশ পরিচালনা করবেন?
ইউনুছ আহমাদ: ইসলাম কোনো খণ্ডিত আদর্শ নয়। আমরা ধাপে ধাপে ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো। একদিনে সব পরিবর্তন সম্ভব নয়, কিন্তু সংস্কার ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আমরা ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে কাজ করবো। আমরা চাই মানুষ ইসলামের সৌন্দর্য বাস্তবে দেখতে পাবে, যেখানে অন্যায়, দুর্নীতি ও অবিচার কমে যাবে।
আরও পড়ুন
রাসুলের সিরাত অনুযায়ী দেশ পরিচালিত না হওয়া মুসলিম হিসেবে লজ্জার
তফসিলের আগেই গণভোট হওয়া উচিত: ইসলামী আন্দোলন
ইসলামি শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে হবে: চরমোনাই পীর
জাগো নিউজ: কেউ কেউ আশঙ্কা করেন, ইসলামি শক্তি ক্ষমতায় এলে নারীর স্বাধীনতা বা অধিকার সীমিত হবে। আপনারা কী বলেন?
ইউনুছ আহমাদ: আমরা ‘ইসলাহি’ বা আত্মশুদ্ধিমূলক পদ্ধতিতে সমাজে শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনতে চাই। কাউকে জোর করে নয়। পরিবেশ এমন হবে যেন মানুষ নিজের থেকেই শালীনতা বজায় রাখে। নারীদের প্রতি কোনো অবিচার হবে না বরং মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সমাজ যাতে বিনষ্ট না হয়, সেদিকেই আমরা নজর রাখব।
জাগো নিউজ: ইসলামি রাজনীতিতে আকিদা বা মতাদর্শগত পার্থক্য কি ঐক্যের পথে বাধা?
ইউনুছ আহমাদ: না, বাধা নয়। আমরা উদারতার নীতি অনুসরণ করছি, যেন সবাই ইসলামি শক্তির ঐক্যে অংশ নিতে পারে। আকিদা ভিন্ন হলেও রাজনৈতিক ঐক্য সম্ভব। আমাদের উদ্দেশ্য মতামত চাপিয়ে দেওয়া নয় বরং ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তোলা।
আরএএস/এমআরএম/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

14 hours ago
4









English (US) ·