‘জীবনযাপনে অনিয়মই ডায়াবেটিসের মূল কারণ’

2 hours ago 8

১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর সারাবিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে জনগণকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্য নিয়ে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন’। বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এই অসংক্রামক রোগ এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস এখন নীরব মহামারি। জীবনযাপনে অনিয়ম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবই ডায়াবেটিস বৃদ্ধির মূল কারণ। সচেতনতা, শৃঙ্খলা ও জীবনধারার পরিবর্তনই পারে নিয়ন্ত্রণে আনতে এই ঘাতক রোগকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যু হয় এবং দুইজন নতুন ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত হয়।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডায়াবেটিস এমন এক অসংক্রামক রোগ, যেখানে রক্তে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। একবার আক্রান্ত হলে সারাজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় এই রোগকে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৮৪ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ২০ জন গর্ভবতী নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন—এদের মধ্যে ৬০ শতাংশের রোগটি পরে স্থায়ী হয়ে যায়।

তিনি জানান, ডায়াবেটিসের মূল কারণ জীবনযাপনের অনিয়ম—অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, মানসিক চাপ, স্থূলতা এবং শহুরে অলস জীবন। এমনকি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এখন অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও স্থূলতার কারণে ডায়াবেটিসের প্রবণতা বাড়ছে। এই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শৃঙ্খল জীবনযাপন। সময়মতো ও পরিমিত খাবার গ্রহণ, নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, মানসিক চাপ কমানো এবং চিনি ও ফাস্টফুড বর্জনের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।

আরও পড়ুন
গোপনে ডায়াবেটিস বেড়ে থাকলে শরীরে যেসব লক্ষণ দেখা যায় 
ডায়াবেটিস কী? এই রোগ সম্পর্কে যা জানা জরুরি 

ডা. আবদুল্লাহ বলেন, মরহুম প্রফেসর মোহাম্মদ ইব্রাহিম স্যারের মতে—ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে তিনটি ‘ডি’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: ডায়েট (খাদ্য নিয়ন্ত্রণ), ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা) ও ড্রাগ (ওষুধ)। প্রথম দুইটি ‘ডি’ মানতে পারলে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

ডায়াবেটিস শুধু রক্তে শর্করা বাড়ায় না বরং ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় এটি হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকল, চোখের রেটিনা নষ্ট হওয়া এবং পায়ের অঙ্গহানি পর্যন্ত ঘটাতে পারে। এজন্য রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা, জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা আনা এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন।

নীরব মহামারির রূপে ডায়াবেটিস
ব্র্যাক হেলথ সিস্টেম ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড ইনোভেশন ইউনিটের প্রধান ডা. ইমরান আহমেদ চৌধুরী বলেন, ডায়াবেটিস এখন কেবল একটি রোগ নয়, এটি একটি নীরব মহামারি। সময়মতো নিয়ন্ত্রণে না আনলে এটি হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকল, অন্ধত্ব ও অঙ্গহানি পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

তিনি জানান, ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েছে শত বছর আগে। তবুও অসংক্রামক রোগগুলো (এনসিডি) এখনও বিশ্বের প্রধান প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে বিশ্বের মোট মৃত্যুর প্রায় ৭৫ শতাংশের জন্য দায়ী এনসিডি। প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অকালে মারা যায়, এর মধ্যে ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের মানুষ।

আরও পড়ুন
ডায়াবেটিসের রোগীরা চোখে যে লক্ষণ দেখলে সতর্ক হবেন 
ডায়াবেটিসের যে লক্ষণ দেখা দেয় শরীরের ৬ অঙ্গে 

ডা. ইমরান বলেন, অতিরিক্ত ওজন, অস্বাস্থ্যকর খাবার, মানসিক চাপ ও শহুরে জীবনযাত্রার কারণে ডায়াবেটিস দ্রুত বাড়ছে। শুধু অসচেতনতা ও দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণেই অনেক মানুষ জটিল অবস্থায় চিকিৎসা নিতে আসে।

তিনি আরও বলেন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতনতা ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও ধূমপান বর্জন—এসব অভ্যাস গড়ে তুললে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সরকারের এনসিডি কর্নার ও ব্র্যাকের NCD360° উদ্যোগ ইতোমধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে বলে জানান তিনি। এ ধরনের সমন্বিত ও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগই হতে পারে অসংক্রামক রোগ মোকাবিলার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা।

অর্থনৈতিক ভারও বাড়ায় ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের কমিউনিকেশন কনসালট্যান্ট সিমিন ইবনাত ধরিত্রী বলেন, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ যা একদিকে শরীরের ওপর নীরবে আঘাত হানে, অন্যদিকে আর্থিকভাবে পরিবারকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ের বড় অংশই ব্যক্তিকে নিজেকেই বহন করতে হয়। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৬১ লাখ মানুষ চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে দরিদ্র হয়ে পড়ে—এর বড় অংশই ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগের জন্য।

তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন, উপসর্গ না থাকলে তারা সুস্থ। কিন্তু অসংক্রামক রোগগুলো, বিশেষত ডায়াবেটিস, অনেক সময় লুকিয়ে লুকিয়ে ক্ষতি করে। এজন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং, সময়মতো চিকিৎসা ও ফলো-আপ অত্যন্ত জরুরি।

ব্র্যাকের কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ঘরে ঘরে গিয়ে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের পরীক্ষা করছেন, সচেতনতা বাড়াচ্ছেন এবং প্রয়োজনে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করছেন। প্রযুক্তিনির্ভর এই ব্যবস্থায় রোগ শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ—দুই-ই বেড়েছে বলে জানান তিনি।

সিমিন ইবনাত ধরিত্রী মনে করেন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখন সময় এসেছে ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা, সামাজিক সচেতনতা ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের সমন্বয় ঘটানোর। আমরা যদি সময়মতো ব্যবস্থা নিতে পারি, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ঘাতক রোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ের পথে আরও এগিয়ে যাবে।

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস শুধু একদিনের প্রতীকী আয়োজন নয়—এটি আত্মসমালোচনারও সময়। জীবনযাপনে সামান্য পরিবর্তন এনে, সচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষাকে অভ্যাসে পরিণত করলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

আরও পড়ুন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রোগীর খাবার যেমন হবে 
নাস্তায় যেসব খাবার খেলে বেড়ে যায় ডায়াবেটিস 

বিশেষজ্ঞদের মতে, আজ থেকেই যদি আমরা নিজেদের খাদ্যাভ্যাস, চলাফেরা ও মানসিক শৃঙ্খলায় মনোযোগ দিই, তবে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস মোকাবিলায় বিশ্বের জন্য একটি সফল উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।

ডায়াবেটিস দিবসের কর্মসূচি
‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ উপলক্ষে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি দুই দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমিতির অন্যান্য অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত অধিভুক্ত সমিতিগুলিও এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।

এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, রোড শো (প্লাকার্ড হাতে সড়কে অবস্থান কর্মসূচি) : ১৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৮টায় শাহবাগ বারডেম কার পার্কিং থেকে টেনিস ক্লাবের গেট পর্যন্ত রোড শো (প্লাকার্ড হাতে সড়কের একপাশে দাঁড়িয়ে অবস্থান কর্মসূচি) পালিত হবে।

এছাড়াও এদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চতুর্থ তলায় হ্রাসকৃত মূল্যে হার্ট, নিউরো ও ভাসকুলার ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হবে।

১৫ নভেম্বর সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা, বারডেম, এনএইচএন ও বিআইএইচএস-এর বিভিন্ন কেন্দ্রে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় করা হবে।

দিবসটি উপলক্ষে ১৫ নভেম্বর বেলা ১০টায় বারডেম অডিটোরিয়ামে আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস)-এর এমিরেটাস অধ্যাপক হাজেরা মাহতাব। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করবেন বারডেম অ্যাকাডেমির পরিচালক অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান।

এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে ১৪ ও ১৫ নভেম্বর সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বারডেমে, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল হেমাটোলজি বিভাগে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন করা হবে।

যেভাবে এলো ডায়াবেটিস দিবস
১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ) ১৪ নভেম্বর তারিখটিকে ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অনুরোধে সরকার ১৪ নভেম্বর ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করে। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২০০৭ সাল থেকে পৃথিবীজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

এসইউজে/এমআরএম

Read Entire Article