জুয়ায় বাজি ধরে কেউ খুইয়েছেন জুয়েলারি দোকান, কেউ ছেড়েছেন দেশ

9 hours ago 6

নরসিংদী শহরের একজন স্বনামধন্য জুয়েলারি ব্যবসায়ী আরাফাত খান (ছদ্মনাম)। একসময় চট্টগ্রামে তার বড় জুয়েলারি দোকান ছিল। কিন্তু বাজি ধরে তাস খেলা ছিল তার নেশা। বাজি ধরে তাস খেলে তিনি জিতেছেন বহুবার। এই নেশায় এক রাতে তার দোকানের মালামাল বাজি রাখেন আরাফাত।

সেদিন তার কপাল খারাপ ছিল। বাজিতে আর জিততে পারেননি। ওইদিন বাজিতে হেরে দোকানের কোটি কোটি টাকার সোনাসহ দোকানের চাবি হস্তান্তর করতে বাধ্য হন আরাফাত।

তার গল্প এখানেই শেষ নয়। ব্যাংক থেকে কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নরসিংদী এসে পুনরায় জুয়েলারি দোকান খুলে বসেন। ব্যবসা ভালোই চলছিল। দোকানও বাড়িয়েছেন। কয়েক বছর যেতে না যেতেই আবার জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এবারও তাস খেলার নামে জুয়ায় হেরে মালামালসহ দোকানটাও বেহাত হয়ে যায়।

ব্যাংক ঋণের চাপ সইতে না পেরে শেষমেশ পৈতৃক ভিটেবাড়ি ফেলে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, স্বনামধন্য এই ব্যবসায়ী তার মায়ের মৃত্যুর পর মুখটাও শেষ দেখা দেখতে পারেননি।

তবে শুধু আরাফাত খান নয়, জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন নরসিংদী জেলার একাধিক ব্যক্তি। কেউ বিক্রি করেছেন বাড়ি, কেউ বন্ধ রেখেছেন ব্যবসা। কেউবা ঋণের দায়ে পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইপিএল ক্রিকেট মৌসুম মানেই জুয়ার মৌসুম। টেলিভিশনের পর্দায় ব্যাট-বলের লড়াই যতই জমে ওঠে, ততই জমে ওঠে নরসিংদীর অলিগলিতে ‘অনলাইন বেটিং’-এর আসর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ও গণসচেতনতা ছাড়া অনলাইন জুয়ার জাল থেকে মুক্তি অসম্ভব। এজন্য সবাইকে এগিেয়ে আসতে হবে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, নরসিংদী শহর, মাধবদী, শিবপুর ও পলাশ অঞ্চলে অনলাইন বেটিং অ্যাপ এবং টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে চলছে কোটি টাকার জুয়ার আসর। প্রতি ম্যাচে শত শত মানুষ বাজি ধরছেন। কারা ছক্কা মারবেন, কারা আউট হবেন, কোন দল জিতবে—এসব পূর্বাভাসের ওপর টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন
গৃহপরিচারিকা থেকে চা দোকানি—জুয়ায় নিঃস্ব সবাই
কৃষিকাজ ছেড়ে জুয়ায় মত্ত শ্রমিক, বিপাকে কৃষক
অনলাইন জুয়ার টাকা দিয়ে ডাটা কেনা কি জায়েজ হবে?
ভয়ংকর স্মার্টফোন, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জুয়ার থাবা
দুধ দিয়ে গোসল করে অনলাইন জুয়া ছাড়লেন যুবক

সূত্রটি জানায়, নরসিংদীর বিভিন্ন উপজেলার তরুণরা এখন টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের গোপন গ্রুপের মাধ্যমে আইপিএল বেটিংয়ে যুক্ত হচ্ছেন। এসব গ্রুপ পরিচালনা করে ঢাকাভিত্তিক কয়েকটি সিন্ডিকেট, যারা প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করছেন। এই বেটিং আসলে অনলাইন জুয়া। এখানে টাকার লেনদেন হয় বিকাশ ও নগদ-এর মাধ্যমে আর টাকার গন্তব্য অনেক সময় বিদেশে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নরসিংদীর হাজিপুর এলাকার একজন ব্যবসায়ী জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘প্রথমে মজার ছলে ৫০০ টাকায় শুরু করি। একদিনে ২০ হাজার টাকা জিতেছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে লাখ লাখ টাকার খেলায় নেমে যাই। শেষমেশ সব হারিয়েছি। দোকান বিক্রি করেছি। ঘরে এখন অশান্তি।’

শিবপুর উপজেলার এক যুবক পরিবার ছেড়ে দুবাই চলে গেছেন ঋণ পরিশোধের ভয়ে। তার পরিবারের সদস্যরা জানান, অনলাইন জুয়ায় কয়েক লাখ টাকা হারানোর পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। শেষে বিদেশে চলে যান।

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, বেকারত্ব, দ্রুত ধনী হওয়ার লোভ ও অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহার জুয়া সংস্কৃতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে যুবসমাজ অনলাইনে সহজে প্রবেশ করতে পারায় তারা অজান্তেই অপরাধ ও আর্থিক বিপর্যয়ে জড়িয়ে পড়ছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নরসিংদী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হলধর দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ছে। এ বছর এইচএসসিতে পাসের হার কমে গেছে। ফলে যুবকরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। ঝুঁকছে নেশা ও আইপিএল জুয়ায়।’

তিনি বলেন, ‘নেশা ও আইপিএল জুয়ার হাত থেকে যুবক বা সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে হলে আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। অন্যথায় জুয়ার মতো নেশা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। আগামীতে শিক্ষার হার আরও কমে যাবে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমদাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইপিএল বা অনলাইন জুয়ার ব্যাপারে থানায় অভিযোগ কম। নেই বললেই চলে। তারপরও অভিযোগ পেলে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। আবার অভিযোগ পেলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকে না।’

তিনি বলেন, ‘এসব অনলাইন জুয়া বন্ধ করতে হলে অনলাইনে নজরদারি বাড়াতে হবে। আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি জুয়া আসক্তি মোকাবিলায় পরিবার ও সমাজের ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

এসআর/জিকেএস

Read Entire Article