ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা অনেক রকম। কেউ চিঠি লেখে, কেউ বলে ফেলে সব আবার কেউ নিঃশব্দে বাড়িয়ে দেয় একগুচ্ছ ফুল। সেই ফুলের পাপড়িতেই লুকিয়ে থাকে হাজারো অনুভব, হাজারো ভালোবাসার গল্প। কিন্তু যে ফুল হাতে তুলে দিয়ে আমরা বলি ‘ভালোবাসি’, সেই ফুলের পেছনের গল্পটা কি কখনও ভেবে দেখি?

ঢাকার ব্যস্ত নগরে প্রতিদিন সকালে এমন একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা শহরের কোলাহলে নিজেদের স্বপ্নগুলোকে গুঁজে রাখে ফুলের ঝুড়িতে। ভোর না হতেই তারা পথে নামে-কেউ যায় যাত্রাবাড়ী, কেউ আগারগাঁও, কেউ আবার সাভার বা নারায়ণগঞ্জের আশপাশের বাগানে। শিশিরভেজা ফুলগুলো সাবধানে তুলে নিয়ে তারা চলে আসে শাহবাগ ও টিএসসি এলাকায়। সেখানেই শুরু হয় তাদের নতুন দিনের গল্প-ফুল গাঁথার গল্প, বেঁচে থাকার গল্প।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর আর শাহবাগ মোড়-এই দুই জায়গা যেন শহরের ‘ফুলের হৃদয়’। এখানে সকালে পৌঁছালেই দেখা যায়, ফুটপাথের ধারে ছোট ছোট ঝুড়িতে সাজানো গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা। রঙে আর ঘ্রাণে মিশে থাকা এক উৎসবমুখর দৃশ্য।

হাতের আঙুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তারা মালা গাঁথে, কেউ বানায় গাজরা, কেউ দেয় সাজানো তোড়া। সেই তোড়াগুলোর প্রতিটিই হয়তো কারও ভালোবাসার প্রতীক হবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।

তবে এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে কঠিন বাস্তবতা। ফুলের দাম কমলে বা বৃষ্টি নামলে তাদের দিনের রোজগার প্রায় শূন্য হয়ে যায়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ধুলায় মিশে-তবুও তারা হাসিমুখে বলে, ‘ভাই, ফুল নেন না? আজ খুব সুন্দর গোলাপ এসেছে।’ সেই হাসিটা যেন শুধু ক্রেতাকে নয়, পুরো পৃথিবীকেই একটু সুন্দর করে তোলে।

এই মানুষগুলোর হাতেই ফুল পায় প্রাণ। তাদের আঙুলের স্পর্শেই গোলাপের কাঁটাও হয়ে ওঠে কোমল। অথচ তাদের জীবনটা বড়ই কাঁটাযুক্ত-অস্থির, অনিশ্চিত, তবুও ভালোবাসায় পূর্ণ। হয়তো নিজের জীবনে সুখ নেই, কিন্তু অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব তারা নিয়েছে নীরবে।

টিএসসির ফুটপাথে বসে থাকা এক নারী ফুলওয়ালা বলছিলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ফুল গাঁথতে গাঁথতে মনে হয়, এই ফুলটা আজ কার মুখে হাসি আনবে।’ সেই কথা শুনে বোঝা যায়-ভালোবাসা কেবল সম্পর্কের মধ্যে নয়, কাজের মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে।

আজ যখন আমরা কাউকে ফুল উপহার দেই, তখন একটু ভেবে দেখা দরকার-এই ফুল শুধু পাপড়ি আর সুগন্ধ নয়, এতে লুকিয়ে আছে এক অজানা মানুষের ঘাম, ভোরবেলার দৌড়ঝাঁপ আর এক চিমটি স্বপ্ন।

ভালোবাসার উৎসব যতদিন থাকবে, এই ফুলওয়ালারা ততদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের শহরের আত্মায়। তাদের হাতেই ফুটে উঠবে ভালোবাসার প্রকৃত রূপ-নিঃস্বার্থ, নিরব, অথচ সবচেয়ে সুন্দর।
জেএস/

4 days ago
5









English (US) ·