ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে- তা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। এই কলাম লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য, চলতি বছরের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়াল ৩১৩ জনে। আর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ৫৪৩ জনে। পরিসংখ্যান বলছে, ডেঙ্গু এখন এক ভয়াবহ 'জনস্বাস্থ্যের জাতীয় সংকটে' পরিণত হয়েছে। যা সাধারণ জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা এই রোগটি যেভাবে ছাড়াচ্ছে- তা আতঙ্কিত হওয়ার মতোই। প্রতিদিনই হাসপাতাল গুলোতে বাড়ছে রোগীর ভিড়। চিকিৎসকদের ওপর তৈরি হচ্ছে অতিরিক্ত চাপ। আবার পর্যাপ্ত বেড, ওষুধ ও রক্ত না থাকায় সাধারণ মানুষ পড়ছে চরম দুর্ভোগে।
একসময় ডেঙ্গু ছিল ঢাকা কেন্দ্রিক। কিন্তু এখন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। শহর থেকে গ্রামে মানুষের যাতায়াত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মশার অভিযোজনক্ষমতা- সব মিলিয়ে রোগটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, বহু মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপের ধরনও এখন পাল্টে গেছে। এডিস মশাবাহিত এই রোগটি এখন সারা বছরের। বিশেষ করে গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সচেতনতার অভাব থাকায় অনেক সময় রোগ শনাক্তই হয় না, ফলে মৃত্যু ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহতার দিকে যেতে পারে। সহজভাবে বলা যায়, ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি জ্বর নয়- এটি এক ভয়াবহ মহামারিতে রূপ নিয়েছে।
প্রতিবছর বর্ষা এলেই রাজধানীসহ সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এখন রোগটি সব ঋতুর, সব সময়ের। এবারের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বরং হাসপাতাল গুলোতে রোগীর চাপ, চিকিৎসা সংকট ও প্রশাসনিক অদক্ষতা এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন রোগীর চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মেঝে ও করিডোরে পর্যন্ত মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে। চিকিৎসক ও নার্সরা দিনরাত পরিশ্রম করলেও পর্যাপ্ত বেড, স্যালাইন ও চিকিৎসা উপকরণের ঘাটতি সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। অনেক সময় রোগী ভর্তি করার আগেই মৃত্যু ঘটছে। এ পরিস্থিতি শুধু স্বাস্থ্যখাতের সীমাবদ্ধতা নয়, প্রশাসনিক প্রস্তুতিরও ব্যর্থতা।
শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা ঠিক নয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন ঘরের ভেতরে ও বাইরে পানি জমে আছে কি না তা তদারকি করা দরকার। ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, এয়ার কন্ডিশনের নিচে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। সবাই যদি নিজেদের আশপাশ পরিষ্কার রাখি তবে এডিস মশার প্রজনন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
ডেঙ্গু মূলত এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়। কিন্তু এখন শুধু মশা নয়- আমাদের উদাসীনতা, শহর-নগর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জনসচেতনতার অভাবই এই রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় প্রতিটি অলিগলিতে মশার উপদ্রব এখন চরম পর্যায়ে। অপরিকল্পিত আবাসন, খোলা নর্দমা, পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল ও ফুলের টবে জমে থাকা পানি- সবই এডিস মশার প্রজননের আদর্শ স্থান। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছরই মশা নিধনের নামে বিপুল বাজেট ব্যয় করে, কিন্তু ফলাফল প্রায় শূন্য। মশা মারার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বারবার; এমনকি অনেক সময় নিম্নমানের ওষুধ ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া যায়। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, সাধারণ মানুষ এখন এই রোগকে অনেক সময় অবহেলা করছে। প্রাথমিক জ্বর, মাথাব্যথা বা চোখের ব্যথাকে "সাধারণ জ্বর" ভেবে চিকিৎসা নিতে দেরি করছে, আর তখনই বাড়ছে জটিলতা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ডেঙ্গু দ্রুত শনাক্ত করা এবং পর্যাপ্ত তরল সরবরাহই রোগীকে বাঁচানোর মূল উপায়। কিন্তু সঠিক সময়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। সর্বশেষ গণ মাধ্যমে দেখলাম, স্যালাইন সংকটসহ নানা সমস্যায় হাসপাতালে রোগীরা। চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও জনবল ঘাটতি এই যুদ্ধকে কঠিন করে তুলেছে।
প্রতিরোধই ডেঙ্গুর একমাত্র কার্যকর উপায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এখনও মানুষ এই রোগকে অবহেলা করে। জ্বর, মাথাব্যথা বা গায়ে ব্যথাকে সাধারণ সর্দিজ্বর ভেবে চিকিৎসা নিতে দেরি করে। অথচ দ্রুত পরীক্ষা ও তরল সরবরাহ রোগী বাঁচাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অনেকেই নিজের ঘর-বাড়ি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে সচেতন নন। অথচ মশার জন্মস্থল আমাদের ঘরের কোণেই। অবশ্য প্রতিরোধে একক কোনো সংস্থা নয়, দরকার সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা।
সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বর্ষার আগেই পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করতে হবে; ওষুধের মান নিশ্চিত করতে হবে; পাশাপাশি ওয়ার্ডভিত্তিক নাগরিক কমিটি গঠন করে এলাকাভিত্তিক মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে গণসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। স্কুল, কলেজ, অফিস- সব জায়গায় নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালু রাখা প্রয়োজন।
আসলে মশার প্রজননের সুযোগ তৈরি করে দেয় আমাদেরই অব্যবস্থা। খোলা নর্দমা, ভাঙা ড্রেন, ছাদে জমে থাকা পানি, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতল কিংবা ফুলের টবে জমা বৃষ্টির পানি- সবই মশার বংশবৃদ্ধির আদর্শ স্থান। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার বাজেট ব্যয় হয় 'মশা নিধন কর্মসূচি'-তে, কিন্তু বাস্তবে কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। নিম্নমানের ওষুধ, অনিয়মিত স্প্রে, এবং প্রশাসনিক উদাসীনতায় ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো এখন মশার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
এই ছোট ছোট অভ্যাসই বড় পার্থক্য আনতে পারে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে কর্মস্থল পর্যন্ত সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে ওয়ার্ডভিত্তিক "মশামুক্ত এলাকা" গঠনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন পরিবর্তিত হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন উপপ্রজাতি। ফলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া আরও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই গবেষণায় বিনিয়োগ জরুরি IEDCR ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা তহবিল দিয়ে শক্তিশালী করা দরকার। স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের উন্নয়নেও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ডেঙ্গু আজ কেবল একটি রোগ নয়, এটি আমাদের নগরজীবনের ব্যর্থতার প্রতীক। একদিকে উন্নত শহর গড়ার স্বপ্ন, অন্যদিকে অগোছালো অপরিচ্ছন্নতা ও নাগরিক উদাসীনতা- এই বৈপরীত্যই আমাদের আজকের সংকটের মূল। এখনই চাই সার্বজনীন উদ্যোগ- সরকার, প্রশাসন, নাগরিক ও গণমাধ্যম-সবাইকে একত্র হতে হবে। প্রতিটি জীবনের মূল্য আছে। প্রতিটি মৃত্যু একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে ডেঙ্গু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমি মনে করি, পরিবর্তিত বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে ডেঙ্গু মোকাবিলায় নতুন কৌশল নিতে হবে।
বলা হচ্ছে, দেরিতে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ায় এ বছর অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। যেহেতু কার্যকর চিকিৎসার জন্য দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়াটা অপরিহার্য, তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে সকল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গু শনাক্ত করা এবং চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা থাকা জরুরি। ডেঙ্গু পরীক্ষাগুলো যেন ভর্তুকি মূল্যে সহজলভ্য হয়, সেটাও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়মিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালানো জরুরি। যা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেহেতু ডেঙ্গু এখন মহামারিতে পরিণত হয়েছে, তাই বিস্তার রোধে এবং মৃত্যু ঠেকাতে টেকসই, বছরব্যাপী স্থায়ী উদ্যোগ দরকার।
আমি আরও মনে করি, এখানে রাষ্ট্র ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো সুসংগঠিত পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে কাজ করা। শুধু নামমাত্র মাইকিং বা প্রচার নয়, প্রয়োজন ঘরে ঘরে গিয়ে সচেতনতা তৈরি করা। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। ব্যবহৃত কীটনাশক যেন কার্যকর হয়, তার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যদিকে, শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা ঠিক নয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন ঘরের ভেতরে ও বাইরে পানি জমে আছে কি না তা তদারকি করা দরকার। ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, এয়ার কন্ডিশনের নিচে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। সবাই যদি নিজেদের আশপাশ পরিষ্কার রাখি তবে এডিস মশার প্রজনন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
আমরা এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকর ও দায়িত্বশীল হতে বলব। বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করছে যে, ডেঙ্গু এখন কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং জাতীয় সংকট। তাই সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণ সবার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট তথা আতঙ্ক থামানো যাবে না।
ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দিতে এডিস মশা নিধন কর্মসূচিকে আরও কার্যকর করা, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। মনে রাখতে হবে, আমার আপনার মৃত্যু সরকারের কাছে একটি সংখ্যা মাত্র; কিন্তু আমরা প্রত্যেকে পরিবারের কাছে এক একটি পৃথিবী। সুতরাং এই মুহূর্তে মানুষের জীবন রক্ষার চেয়ে আমাদের আর কোনো বড় দায়িত্ব নেই।
লেখক: কলামিস্ট ও শিল্পো-উদ্যোক্তা।
এইচআর/এএসএম

3 hours ago
7








English (US) ·