ডেঙ্গু রোধ করা যাচ্ছে না কেন?

2 weeks ago 14

ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী। গেলো এক সপ্তাহ যাবত শিশু হাসপাতালে। তার আট বছরের সন্তান ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি। ব্যবসা রেখে দিনরাত একাকার করে সন্তানের সুস্থতার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, ‘এডিস মশার কামড় থেকে ডেঙ্গু হয়। মশা মারতে না পারলে সিটি করপোরেশনকে কেনো আমরা টাকা দেবো? তাদেরই তো কাজ মশা মারা।’

একই অবস্থা বেসরকারি চাকরিজীবী জাহাঙ্গীর আলমের। দুই সপ্তাহের চিকিৎসায় সন্তানকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরছেন তিনি।

মোহাম্মদপুরের এই বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই শহরে থাকি। কিন্তু মশক নিধনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ আমার চোখে পড়েনি। যদি মশক নিধন হতো, তাহলে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু হতো না।’

ইকবাল ও জাহাঙ্গীরের মতো শিশু হাসপাতালে ২১ জন চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন স্বজনরা। ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশিরভাগই ঢাকার।

‘এই শহরে থাকি। কিন্তু মশক নিধনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ আমার চোখে পড়েনি। যদি মশক নিধন হতো, তাহলে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু হতো না।’ – মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম

গতবারের মতো এবারও ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক। হাসপাতালে আসা ব্যক্তিদের তথ্যও অনেক। অনেকে ঘরে বসে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে তাদের তথ্য উঠে আসছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বুলেটিনে।

ডেঙ্গু রোধ করা যাচ্ছে না কেন?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে ১ হাজার ৭৭৩, জুনে ৫ হাজার ৯৫১, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪, আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬, সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৮৬৬ এবং এ মাসের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ হাজার ২৯৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ মাসের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছেন।

‘মশক নিধনের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধ একক সরকারের কাজ নয়। জনগণকে সচেতন হতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’ - ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশক নিধনের বিকল্প নেই। তবে আক্রান্ত হয়ে গেলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শে চলা প্রয়োজন। দরকার হলে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হবে। কারণ ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বেশিরভাগই দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে হয়েছে।

এ বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, মশক নিধনের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধ একক সরকারের কাজ নয়। জনগণকে সচেতন হতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এপিডেমিওলজিস্ট তারেক হাসান শিমুল বলেন, ‘ডেঙ্গু এমন একটি রোগ, যা আমরা জানি-মশা কামড়ালে হয়। পানি জমলে মশা জন্মায়, এসব আমরা জানি তবু কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। এর পেছনে আছে একাধিক কারণ। প্রথমত, ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে, যা প্রতি বছর সংক্রমণের মাত্রা ও জটিলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমরা নিজেরা যথেষ্ট সচেতন নই। আমাদের ঘর-বাড়ির ফুলের টবে বা ছাদের পানির ট্যাঙ্কে, এমনকি শহরের ড্রেনে, রাস্তায়, ছাদে যেখানেই পরিষ্কার পানি জমে, সেখানেই মশা জন্ম নিচ্ছে। অনেক সময় উচ্চশিক্ষিত, পেশাদার মানুষের ঘরেও দেখা যায় টবে বা ফুলের পাত্রে মশার লার্ভা রয়েছে।’

ডেঙ্গু রোধ করা যাচ্ছে না কেন?

‘আমরা একদিকে সরকারকে ব্যর্থ বলি, অন্যদিকে নিজের দায়িত্বটা পালন করি না। আসলে সরকারের প্রচেষ্টা তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন প্রত্যেক মানুষ নিজের ঘর, বারান্দা, ছাদ ও আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখবে। যেকোনো পাত্রে তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকা মানেই সেটি মশার প্রজননস্থল। তাই এটি নিয়মিত পরিষ্কার করা জরুরি।’

‘ঢাকা শহরে মশার ‘হারবার’ বা আশ্রয়স্থল ক্রমেই বাড়ছে। মশার সংখ্যা বাড়লে ডেঙ্গু কমার সুযোগ নেই। আমরা যেন নিজেরাই মশার চাষ করছি, এটি বন্ধ না করলে কোনো ওষুধ বা স্প্রে দিয়েও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’ - এপিডেমিওলজিস্ট তারেক হাসান শিমুল

তারেক হাসান শিমুল আরও বলেন, ঢাকা শহরে মশার ‘হারবার’ বা আশ্রয়স্থল ক্রমেই বাড়ছে। মশার সংখ্যা বাড়লে ডেঙ্গু কমার সুযোগ নেই। আমরা যেন নিজেরাই মশার চাষ করছি, এটি বন্ধ না করলে কোনো ওষুধ বা স্প্রে দিয়েও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

উদাহরণ টেনে এই মহামারি বিশেষজ্ঞ বলেন, সম্প্রতি বরগুনা এলাকায় গিয়ে দেখি, প্রতিটি ঘরেই বৃষ্টির পানি ড্রামে ধরে রাখা হয়, কারণ সেখানে টিউবওয়েল বা সুপেয় পানির ঘাটতি আছে। কিন্তু সেই ড্রামগুলোই মশার জন্মস্থান হয়ে গেছে। যদিও ঢাকনা দেওয়া থাকে, তবু পানি তোলার সময় খোলা হয়। ফলে মশা ঢুকে বংশবিস্তার করে। আমরা যখন টর্চলাইট দিয়ে দেখি, আসলেই সেখানে লার্ভা ভাসছে। এই অবস্থা পরিবর্তন না করলে ডেঙ্গু কখনো কমবে না।

ডেঙ্গু রোধ করা যাচ্ছে না কেন?

‘সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটি কেবল সরকারের একার লড়াই নয়। জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। মশার আবাস ধ্বংস করা, পানি জমে থাকা বন্ধ করা এবং নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিরোধমূলক অস্ত্র। সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।’ বলে মন্তব্য করেন এপিডেমিওলজিস্ট তারেক হাসান শিমুল।

‘শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। মশা নিধন না করলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি আরও ভয়াবহ হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণই এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।’ - জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। মশা নিধন না করলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি আরও ভয়াবহ হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণই এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বছরের শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করলেও কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিত মশক নিধন কার্যক্রম হয়নি।’

রাজধানীর শ্যামলীতে ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিটি বাড়ি, অফিস ও আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, জমে থাকা পানি সরানো এবং নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম চালানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। মশার বংশবিস্তার রোধই আমাদের জীবন বাঁচানোর প্রধান উপায়।’

ডেঙ্গু রোধ করা যাচ্ছে না কেন?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সব প্রচেষ্টা চলমান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানি জমতে না দেওয়া, মশার ওষুধ ছিটানো সবই চলছে। জনসাধারণকে সচেতন করতে এরইমধ্যে তরুণদের দিয়ে কর্মসূচি করছি। মশার জন্ম ও বংশবিস্তার ঠেকাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মনিটরিং করতে ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে নামিয়ে দিয়েছি। আমরা আমাদের পদক্ষেপের সুফলও পাচ্ছি। আপনি দেখে থাকবেন, আমাদের শহরে রোগীর সংখ্যা কম।’

‘ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। তারা করছে। আমাদের কাজ আক্রান্তদের সেবা দেওয়া। আমরা সেটা আন্তরিকতার সঙ্গে করছি। বড় সমস্যা হলো, রোগীরা অনেক দেরি করে হাসপাতালে আসেন। তখন জটিলতা বেড়ে যায় ও চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে।’- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। তারা করছে। আমাদের কাজ আক্রান্তদের সেবা দেওয়া। আমরা সেটা আন্তরিকতার সঙ্গে করছি। বড় সমস্যা হলো, রোগীরা অনেক দেরি করে হাসপাতালে আসেন। তখন জটিলতা বেড়ে যায় ও চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে এবং প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা নিলে মৃত্যু হার কমানো সম্ভব।’

এসইউজে/এসএনআর/এমএস

Read Entire Article