তাঁবুর হোটেল, উটে চড়া, ছাগলের চামড়ার ভেলা, এবং অন্যান্য

6 hours ago 5

এই লেখাটি লিখছিলাম, নিংসিয়ার চুংওয়েই শহরের শাফোথৌ অঞ্চলে, টেঙ্গার মরুভূমির একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত, একটি তাঁবুতে বসে! মধ্যরাত, বাইরে মরু-বাতাস বইছে, তাঁবুর মোটা ছাউনি বাতাসের তোড়ে মাঝেমাঝে দুলে দুলে উঠছে, শোনা যাচ্ছে বাতাসের শো শো শব্দ। মনে হচ্ছিল, বাতাসের গতি আরেকটু বাড়লেই, একটা মাত্র লোহার খুঁটির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত তাঁবুটি, নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। তবে, আশার কথা, এটা একটা হোটেলের ‘রুম’। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এটি নির্মাণের সময় সম্ভাব্য সবধরনের ঝুঁকি বিবেচনায় রেখেছিলেন!

হোটেলের নাম ‘এস টেন্ট হোটেল’। মানে, এটা তাঁবুর হোটেল। একেকটা তাঁবু একেকটা কক্ষ। অনেকগুলো তাঁবুর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই বিচিত্র হোটেল। এ যেন টেন্ট সিটি বা তাঁবুর শহর! বাইরে থেকে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, তাঁবুর বাইরের ডিজাইনটা স্রেফ শোভা বর্ধনের জন্য, ভিতরে ইট-পাথরের তৈরি ঘরই আছে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে ভুল ভাঙলো।

ভিতরে ঢুকলাম তাঁবুর দরজার জিপার খুলে! দরজাটি তেরপলের মতো মোটা কাপড়জাতীয় জিনিসে তৈরি। একই জিনিসে তৈরি তাঁবুর গোলাকৃতির দেওয়ালও, ইট-পাথর বা কংক্রিটের বালাই নেই। তবে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সবই আছে: চমত্কার বিছানা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, ওয়াইফাই, চা-কফির সরঞ্জাম।

তাঁবুর বাইরে এক্সটেনশান হিসাবে আছে বাথরুম। সেখানেও আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধাই আছে, যা সাধারণ হোটেলে পাওয়া যায়। বাথরুমের দেওয়ালে নক করে বুঝলাম, এখানেও ইট-পাথরের ব্যবহার নেই। হার্ডবোর্ড বা এই জাতীয় কোনোকিছু দিয়ে তৈরি। তবে, মূল তাঁবু ও বাথরুমের মেঝে তৈরিতে ইট-পাথর-কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হলো।

মোদ্দাকথা, একটা ভালো হোটেলের রুমে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, মরুর বুকে গড়ে ওঠা এই তাঁবু-কক্ষেও সেসব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। তবে, একটা জিনিস নেই, আর সেটা হচ্ছে লেখার টেবিল। গা এলিয়ে দিয়ে, আরাম করে বসার মতো দুটি চেয়ার আছে; দুই চেয়ারের মাঝখানে একটি ছোট গোলাকৃতির টেবিল আছে; আছে, কাঠ বা বোর্ডের তৈরি একটি টেবিলজাতীয় আসবাব, যার উপরে পানি গরম করার কেটলি ও নিচের একটি খুপরিতে ছোট একটা রেফ্রিজারেটর। নেই কেবল আরাম করে বসে লেখা যায়—এমন একটা টেবিল ও একটা চেয়ার। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে বিছানায় বসে ল্যাপটপের কিবোর্ডে আঙুল চালাতে হচ্ছিল।

১১ আগস্ট ২০২৫ ছিল আমাদের, মানে বেইজিং থেকে আসা সিএমজি ও অন্যান্য গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত দলটির, চীনের নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সফরের সপ্তম দিন। এদিন সফরের আয়োজকরা আমাদেরকে একের পর এক সারপ্রাইজ দিয়ে গেছেন। গত ৯ আগস্টও তাঁরা আমাদের সারপ্রাইজ দিয়েছিলেন, মহা আনন্দময় একটা দিন কেটেছিল আমাদের। তখন আমি ভেবেছিলাম, সফরের সেরা দিনটি কাটিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। সফরের সেরা দিনটি ছিল আসলে ১১ আগস্ট! এদিনের অনেক সারপ্রাইজের মধ্যে সর্বশেষ সারপ্রাইজ ছিল মরুভূমির বুকে এই তাঁবুর হোটেল!

এ পর্যন্ত এসে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠা এই তাঁবু-হোটেলের ভাড়া কতো? সেটা হিসাব করতে আপনাকে ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হবে। প্রতিটি তাঁবু-কক্ষের একদিনের ভাড়া ২০২৪ ইউয়ান। আর এক ইউয়ান সমান বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ১৭ টাকা। যাদের হাতের কাছে ক্যালকুলেটর নেই বা যারা অংকে কাচা বা যারা হিসাব করার কষ্টটুকু স্বীকার করতে রাজি নন, তাদের জন্য হিসাবটা আমিই করে দিচ্ছি। প্রতিটি তাঁবু-কক্ষের একদিনের ভাড়া বাংলাদেশি ৩৫,৪২০ টাকা! আর প্রাসঙ্গিক তথ্য হচ্ছে, এই হোটেল চালু হয়েছে মাত্র গত বছর, আর এখানে মোট ৮৮টি তাবু-কক্ষ আছে।

যাই হোক, দিনের কার্যক্রম কিন্তু শুরু হয়েছিল বোরিং ধরনের কাজ দিয়েই। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় চীনা বিজ্ঞান একাডেমির শাফোথৌ মরুভূমি গবেষণা ও পরীক্ষাকেন্দ্রে। আমি কলেজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়তে গিয়ে বিজ্ঞানের জগত থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়ি। পেশার কারণে বিজ্ঞান নিয়ে মাঝেমধ্যে নাড়াচাড়া করতে হয়, তবে গভীরে যাওয়া হয় না। কথায় আছে না, সাংবাদিকরা ‘জ্যাক অব অল ট্রেড, মাস্টার অব নান’! বিজ্ঞানবিষয়ক কিছু দেখলেই একটু নড়েচড়ে বসি, সিরিয়াস হই; পাছে ভুল না হয়ে যায়।

শাপোথৌয়ে অবস্থিত গবেষণাকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। কেন্দ্রের গবেষকরা, তাদের মেধা ও পরিশ্রম এবং সরকারের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কাজে লাগিয়ে, দেশের উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছেন ও রাখছেন। সেসব অবদানের একটি হচ্ছে মরুকরণ রোধ ও মরু-শাসন। চীনের সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিল যে, কানসু প্রদেশের রাজধানী লানচৌ থেকে ইনার মঙ্গোলিয়ার পাওথৌ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হবে, তখন একাডেমির বিজ্ঞানীদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল, মরুভূমির মধ্য দিয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা, বিশেষ করে মরু-শাসন করা।

মরুভূমি মানেই মরুঝড়, আর মরুঝড় মানেই বালিতে আশেপাশের এলাকা ছেয়ে যাওয়া। শুনেছি, চীনা বিজ্ঞানীরা মরু-শাসনের কৌশল আয়ত্ত করার আগে, সিনচিয়াংয়ের কাশগর শহর প্রায়ই মরুর বালিতে ঢেকে যেত, রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে যেত। কিন্তু সেই অবস্থা এখন আর নাই। মরু-শাসনের কৌশল সেই সংকটের সমাধান করেছে। হ্যাঁ, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চীনা বিজ্ঞান একাডেমির গবেষকরা শেষ পর্যন্ত মরু-শাসনের কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কাজে তত্কালীন সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা তাদের সাহায্য করেছিলেন বলেও জানা যায়। ফলে, লানচৌ-পাওথৌ রেলপথ স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নেয়।

আয়োজকরা আমাদের জন্য আগেই একজন গাইড ঠিক করে রেখেছিলেন। গাইড প্রথমে আমাদের নিয়ে গেলেন ফ্লাইং সসার আকৃতির একটা রাইডের কাছে। বিশাল একটা প্লাটফর্মে অনেকে একসঙ্গে দাঁড়াতে পারে। তারপর সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মটি ধীরে ধীরে উঠে যায় অনেক উঁচুতে। তো, বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হলো। আনুমানিক আধা ঘন্টা পর আমাদের সুযোগ এলো। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বুঝলাম মজাটা কোথায়। সেটা আমাদের নিয়ে ধীরে ধীরে অনেক উঁচুতে উঠলো, তারপর ঘুরতে লাগলো। উপর থেকে পাখির চোখে আমরা টেঙ্গার মরুভূমির পুরোটা দেখতে পেলাম। সে এক অপরূপ দৃশ্য। নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল।

একাডেমিভবন পরিদর্শনশেষে আমরা গেলাম টেঙ্গার মরুভূমিতে। উদ্দেশ্য, মরু-শাসনের কৌশল নিজ চোখে দেখা। কাশগরে মরু-শাসন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পেয়েছিলাম। এখানে একজন বিশেষজ্ঞ একাডেমির গবেষণা ও গবেষণা থেকে মরু-শাসনের কৌশল আবিষ্কারের ইতিবৃত্ত জানালেন। উনার বেশিরভাগ কথাই বুঝিনি, ভাষার কারণে। উনি স্বাভাবিকভাবেই চীনা ভাষায় বলেছেন, আর আমি চীনা ভাষা বলতে গেলে বুঝিই না, কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় শব্দ ও বাক্য ছাড়া। চীনা সহকর্মী শিশির অনুবাদ করে করে আমাকে ভদ্রলোকের বক্তব্য বোঝানোর চেষ্টা করেছে। শিশিরের সাহায্য ও ঘটনাস্থলে সংরক্ষিত দুটি বোর্ডে প্রদর্শিত কিছু ছবি দেখে এটুকু বুঝলাম যে, স্রেফ বিশেষ ধরনের খড়কুটো ব্যবহার করে মরুভূমিকে শাসন করার কৌশল এখন আমাদের কাছে খুবই সাধারণ মনে হলেও, এই ‘সাধারণ’ কৌশলটি আবিষ্কার করতে চীনা বিজ্ঞানীদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ আরও জানালেন, মরু-শাসন কার্যক্রমের ব্যাপক সাফল্যের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লে, অনেকেই এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁরা নিজের চোখে দেখতে চান, মরু-শাসনের কৌশল শিখতে চান। আগ্রহী মানুষের সংখ্যা যখন ক্রমাগত বাড়তে লাগলো, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাবলো, টেঙ্গার মরুভূমির (এটি চীনের চতুর্থ বৃহত্তম মরুভূমি) নিংসিয়া অঞ্চলের কিছু অংশকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেঙ্গার মরুভূমি, মরুভূমি-লাগোয়া হোয়াংহো তথা হলুদ নদী, এবং হলুদ নদীর অদূরে অবস্থিত পর্বতের সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে, সেখানে গড়ে তোলা হলো একটি অসাধারণ পর্যটনকেন্দ্র।

আমাদের তাঁবু-হোটেল সেই পর্যটনকেন্দ্রেরই অংশ। ক্রমবর্ধমান পর্যটকের কথা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয়েছে এই হোটেল। একই মালিক বা মালিকেরা পাশাপাশি আরেকটি বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ করেছেন। মরু-শাসন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনার পর, আমরা সেটি দেখতে গেলাম। হোটেলের নাম ‘মরুভূমি তারকা হোটেল’ (Desert Star Hotel)। মরুভূমির মাঝখানে, বেশ খানিকটা এলাকাজুড়ে, এহেন নান্দনিক বহুতলবিশিষ্ট হোটেল দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ এহতেশাম বললেন, ‘এরা তো অসম্ভবকে সম্ভব করেছে!’ আসলেই তাই। কীভাবে এটা সম্ভব হলো! পরক্ষণেই মনে হলো, মরু-শাসনের মাধ্যমে যদি মরুভূমির মাঝখান দিয়ে শত শত কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা যায়, তাহলে এমন হোটেল গড়ে তোলা যাবে না কেন?

প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, এদিন আমরা এই হোটেলেই থাকব। কিন্তু শিশির জানালো, সম্ভব না, ভাড়া অনেক বেশি। খোঁজ নিয়ে জানলাম হোটেলের সবচেয়ে কমদামি কক্ষের একদিনের ভাড়া ৩০০০ ইউয়ান। আপনার যদি এন্তার টাকা-পয়সা থাকে, তবে আপনি দৈনিক ৮০০০ ইউয়ান ব্যয় করে ভিলা-টাইপের হোটেল-রুমও ভাড়া করতে পারেন! অতএব আমাদের সেই হোটেলে থাকা হলো না। ছবি-টবি তুলে বিদায় হলাম। ততক্ষণে লাঞ্চের সময় হয়েছে। আমরা কাছাকাছি একটি রেঁস্তোরায় ঢুকলাম। আমাদের দলে সদস্যসংখ্যা মাশাআল্লাহ কম নয়। অন্তত বড় তিনটা টেবিল লাগে। তিনটা গোল টেবিলে আমরা গোল হয়ে বসলাম। আমি বসলাম সামনের কাচের স্বচ্ছ দেওয়ালের দিকে মুখ করে। কাচের ভিতর দিয়ে বাইরে নজর পড়তেই আরেক দফা বিস্মিত হবার পালা।

বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। রেস্তোরাঁর কাচের দেওয়ালের বাইরে চোখ রাখলে যে চিত্রটা আপনি দেখবেন সেটা এমন: প্রথমেই মরুভূমির একাংশ (রেস্তোরাঁটা মরুভূমির উপরই গড়ে উঠেছে), তারপর মরুভূমির কোল ঘেঁষে বয়ে চলা হোয়াংহো তথা হলুদ নদী, নদীর তীরে আরেক টুকরো সমতল ভূমি, সমতলভূমির কাছে বিশাল পর্বত, আর পর্বতের উপরে তারচেয়েও বিশাল আকাশ! আমি, শুধু হ্যলান পর্বতকে সামনে রেখে ডিনার করতে পারার আনন্দ, আগের এক পর্বে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। আর এখন লাঞ্চ করছি সামনে মরুভূমি, নদী (তাও যেনতেন কোনো নদী নয়, চীনের মাতৃনদী), সমতল ভূমি, পর্বত, ও আকাশ রেখে! আমার পাশে বসেছিলেন, ইউক্রেনের একজন বিশেষজ্ঞ, তার কাছে আমার অনুভূতি প্রকাশ করলাম। তিনি বাইরে তাকিয়ে বলে উঠলেন, তাইতো! সত্যি অসাধারণ! বলেই তিনি কাচের দেওয়ালের কাছে গেলেন ছবি তোলার জন্য।

লাঞ্চের পর নতুন হোটেলে চেক ইনের সময়। তখনও জানি না, আমরা তাঁবু-হোটেলে থাকতে যাচ্ছি! হোটেলের রিসেপশানটা সাধারণ একটা ভবন। দলনেতা জানালেন, হোটেলের রুমগুলো সাফ-ছুতরা করতে কিছুটা সময় লাগবে। এই ফাঁকে আমরা, রিসেপশনে লাগেজ রেখে, পর্যটনকেন্দ্রে ফিরে যেতে পারি; সেখানে কিছু রাইড উপভোগ করার সুযোগ আছে। আর কেউ না-যেতে চাইলে, রিসেপশানে অপেক্ষা করতে ও রুম রেডি হলে সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন। শ্রীলঙ্কার রাভি মাল হান্ডু্ওয়ালা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আগের দিন তিনি এক রাইডের মজা নিতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছিলেন। সম্ভবত সেই ভয়ের জের এ সিদ্ধান্ত।

শিশিরও না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে জানাল, তাকে অফিসের কিছু কাজ করতে হবে। হোটেলে গিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে কাজে লেগে যাওয়া তার জন্য বেহেতের। অতএব, রাভি ও শিশিরের মতো কয়েকজনকে রেখে, আমরা বাসে চেপে ফিরে গেলাম মরুভূমির সেই অংশে যেখানে বিভিন্ন রাইড আছে। শত শত মানুষ টিকিট কেটে সেসব রাইড উপভোগ করেন। বলাবাহুল্য, এখানে প্রতিটি রাইডের জন্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি টাকা গুণতে হয়।

আয়োজকরা আমাদের জন্য আগেই একজন গাইড ঠিক করে রেখেছিলেন। গাইড প্রথমে আমাদের নিয়ে গেলেন ফ্লাইং সসার আকৃতির একটা রাইডের কাছে। বিশাল একটা প্লাটফর্মে অনেকে একসঙ্গে দাঁড়াতে পারে। তারপর সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মটি ধীরে ধীরে উঠে যায় অনেক উঁচুতে। তো, বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হলো। আনুমানিক আধা ঘন্টা পর আমাদের সুযোগ এলো। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বুঝলাম মজাটা কোথায়। সেটা আমাদের নিয়ে ধীরে ধীরে অনেক উঁচুতে উঠলো, তারপর ঘুরতে লাগলো। উপর থেকে পাখির চোখে আমরা টেঙ্গার মরুভূমির পুরোটা দেখতে পেলাম। সে এক অপরূপ দৃশ্য। নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল।

এবার উটের পিঠে চড়ার পালা। আগের দিন শাহু হ্রদে উটের পিঠে চড়ার সুযোগ হয়নি। এবার হলো। পাকিস্তানি ভাই এহতেশাম বললেন, ‘আপনার ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও বললেন, ‘ছোটবেলায় অভাবের কষ্ট সহ্য করেছি, বড় হয়ে পরিবারের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছি, আমাদের নিজেদের জন্য খানিকটা সময় বের করার সুযোগ তো কখনও পাইনি! এবার পেয়েছি, আসুন কাজে লাগাই।’ তিনি এতসব কথা বললেন আমার একটা কথার পরিপ্রেক্ষিতে। আমি বলেছিলাম, ‘এই বুড়ো বয়সে বাচ্চাদের রাইডে চড়তে কেমন কেমন লাগছে।’

কেমন কেমন লাগলেও, উটের পিঠে চড়তে আমার আগ্রহের কমতি ছিল না। আমার খানিকটা ব্যাকপেইনের সমস্যা আছে, আর আমি জানি উট দুলকি চালে চলে। এতে ব্যাকপেইন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ঝুঁকিটা নিয়েই নিলাম। যা থাকে কপালে! এহতেশাম ভাই বললেন, এমন সুযোগ জীবনে আর নাও পেতে পারেন, আলিম ভাই!’

উটের পিঠে চড়ার অভিজ্ঞতাটা সত্যি অসাধারণ ছিল। উট যখন আরোহীকে নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসে, সে সময়টা আরোহীর জন্য, বিশেষ করে আমার মতো নতুন আরোহীর জন্য, চ্যালেঞ্জিং। বয়সেরও একটা ব্যাপার আছে। আল্লাহর রহমতে সব চ্যালেঞ্জেই উত্তীর্ণ হলাম। উট যখন আমাকে নিয়ে দুলকি চালে হাঁটছিল, তখন আমার ১৪ শত বছর আগের কথা মনে হলো। তখন ইসলামের শেষ নবী হিজরতের সময় মক্কা থেকে মদিনায় উটের পিঠে চেপে গিয়েছিলেন। আরও মনে পড়লো কুরআনের একটি আয়াত, যেখানে আল্লাহ মানুষকে উট নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে উত্সাহিত করেছেন।

উটে চড়া হলো। নামার ঠিক আগে এহতেশাম ভাই আমার উটসমেত ছবি তুললেন। উট যখন আমাকে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসছিল, ঠিক তখন আমাদের এক সফরসঙ্গীও আমার ছবি তুলেছিলেন। তিনি পরে সেটা আমাকে উইচ্যাটে পাঠান। তা ছাড়া, উটের দল যখন আরোহীদের নিয়ে নির্দিষ্ট ট্র্যাকে হাঁটতে থাকে, তখন একটা জায়গায় বসে থেকে জনৈক ক্যামেরাম্যান সবার ছবি তুলতে থাকেন এবং প্রত্যেককে একটা নম্বর বলেন। চীনা ভাষায় বলায় আমি বুঝতে পারিনি। উটযাত্রা শেষ করে জানলাম, ১৮ ইউয়ান দিলে ওই ক্যামেরাম্যানের তোলা ছবির ডিজিটাল ভার্সন পাওয়া যাবে; আর প্রিন্ট ভার্সনের জন্য গুণতে হবে ৩৪ ইউয়ান। আমি ডিজিটাল ভার্সনই নিলাম আর মনে মনে ভাবলাম, চীনারা ব্যবসা ভালোই বোঝে!

উটযাত্রাশেষে আবারও মনস্টার ট্রাক। সফরে আগেও একবার মনস্টার ট্রাকে চড়েছি। আবারও চড়লাম। তেমন কোনো অনুভূতি হলো না। কিন্তু সর্বশেষ রাইডটা ছিল ইন্টারেস্টিং। অনেকটা কলার ভেলার মতো দেখতে ভেলা। চীনা ভাষায় এর নাম ‘ইয়াং ফি ফা চি’। বাংলা করলে দাঁড়াবে ‘ছাগলের চামড়ার ভেলা’। হুবহু ছাগল বা ভেড়ার আকৃতির ডজন খানেক বেলুনের মতো জিনিসের ওপর কাঠের পাটাতন ফেলে এই ভেলা তৈরি হয়। কীভাবে ছাগলের চামড়া দিয়ে এমন আনাম বেলুন বানানো সম্ভব? কোন টেকনিক ব্যবহার করে তাঁরা? কেউ এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলেন না। শুধু এটুকু জানলাম, সুং রাজবংশ আমল থেকে এই ভেলার প্রচলন। ঐতিহ্য হিসেবে এখনও টিকে আছে। আর সংশ্লিষ্টরা ঐতিহ্যের প্রতি চীনাদের দুর্বলতাকে স্মার্টলি ব্যবহার করছেন। ঐতিহ্যও টিকে থাকল, ব্যবসাও হলো।

ছোটবেলায় হোয়াংহোর কথা পড়েছি বইয়ের পাতায়। পরীক্ষায় কখনও কখনও প্রশ্ন থাকতো: চীনের দুঃখ কী? উত্তরে আমরা লিখতাম: হোয়াং হো নদী। তখন জানতাম না যে, ‘হোয়াং’ মানে ‘হলুদ’ এবং ‘হো’ মানে ‘নদী’। তার অর্থ, উত্তরে আমরা বলতাম: ‘হলুদ নদী নদী’। দুইবার নদী বলার ভুল আমরা শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাই করতাম। জানা ও না-জানার মধ্যে এই হচ্ছে পার্থক্য। যাই হোক, সেই হোয়াংহো এখন আর চীনের দুঃখ নয়, বরং সুখে পরিণত হয়েছে। আমিও জীবনে প্রথমবারের মতো হোয়াংহোকে ছুঁয়ে দেখতে পেরে, এর স্রোতে ছাগলের চামড়ার ভেলায় ভাসতে পেরে, আহ্লাদিত হয়েছি।

শুরুতেই বলেছি, ১১ আগস্টের দিনটা ছিল আমাদের জন্য একের পর এক সারপ্রাইজের দিন। শেষ সারপ্রাইজ তাঁবুর হোটেল। ১২ আগস্ট সকালে এ হোটেল ছেড়ে যাবো অন্য এক শহরে, যে শহরের নাম উচুং। নিংসিয়ার পাঁচটি শহরের মধ্যে চারটি আমরা ইতোমধ্যেই ঘুরে দেখেছি। বাকি আছে উচুং। এই শহরের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। তবে, সেই প্রসঙ্গ আজকের নয়। (চলবে)

১১ আগস্ট ২০২৫
চুংওয়েই, নিংসিয়া, চীন
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article