‘তোমরা কি ভেবেছো তোমাদের অহেতুক সৃষ্টি করেছি’

2 weeks ago 9

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে বিনা কারণে বা দুনিয়াবী আনন্দ ফুর্তির জন্যী সৃষ্টি করেননি। আমাদের অবস্থা আজ এমন হয়েছে যে, নিজেকে নিয়ে ক্ষণিকের জন্যও ভাবতে চাই না আর সঠিকভাবে ধর্মকর্ম পালন করা তো দূরের কথা।

প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তি যদি সে তার ধর্মের আদি-সারকথার দিকে ফিরে যায় এবং সে অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে তাহলে মানুষ নিজেকে বুঝতে পারতো আর পৃথিবীর চেহারা যেত পালটে।

আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন : ‘মানুষ কি মনে করে, তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দেয়া হবে? (সুরা কিয়ামা, আয়াত : ৩৬)

আবার সুরা মুমিনুনের ১১৫ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা এ কথাই ব্যক্ত করেছেন ‘তোমরা কি ভেবেছো তোমাদের অহেতুক সৃষ্টি করেছি।’

মোটেও নয় বরং বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্যই তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু আজ আমরা আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে বসেছি, তাইতো সমাজ, দেশ ও বিশ্বের সর্বত্র অশান্তি বিরাজমান। আমার অধিকার, আমার প্রাপ্য, আমর সম্মান সব কিছু সম্পর্কেই আমি খুব ভালো বুঝি, কেবল নিজেকেই বুঝি না।

অনেকে রাতের অন্ধকারে অনেক পাপকাজ করে ভাবতে থাকে কেউতো দেখেনি কি আর হবে। যার ফলে একের পর এক অন্যায় তার দ্বারা সংঘটিত হতে থাকে। অথচ সৃষ্টিকর্তা যিনি আছেন তিনি তো সবই দেখছেন, কেননা তিনি আমাদের সাথেই আছেন। আমাদের একের পর এক অপরাধ সত্ত্বেও তিনি আমাদেরকে ছাড় দিচ্ছেন, সংশোধনের সময় দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন : ‘যেখানেই তোমরা যাও তিনি তোমাদের সাথে থাকেন আর তোমরা যা-ই কর আল্লাহ তা পুরোপুরি দেখেন।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত : ৪)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক এটাও ইরশাদ করেছেন, তিনি আমাদের জীবনশিরা অপেক্ষাও নিকটে রয়েছেন। (সুরা কাফ, আয়াত : ১৬)

আল্লাহপাক আমাদের এত নিকটে তারপরও আমরা তার রহমত থেকে বঞ্চিত থেকে যাই। এর কারণ হল- আমার যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, সব কিছুই যে তার, আমার যে কিছুই নাই, এই বিষয়টা নিয়ে কখনও আমি চিন্তা করি না। আর এ কারণেই আমি আমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুকেও চিনতে পারছি না এবং তার কল্যাণ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছি।

নিজেকে চেনার, জানার এবং নিজেকে সংশোধন করার সময় কি এখনো আসেনি? অনেকে বলতে পারেন, কেবল নিজেকে চিনলে লাভ কি? হ্যাঁ, লাভ আছে। যেভাবে বিন্দু বিন্দু জল মিলে নদী হয়, ছোট ছোট পাথর মিলে পাহাড় হয়, লতাপাতা, ছোট ছোট গাছ মিলে জঙ্গল হয় এভাবেই এক এক ব্যক্তি মিলে জাতি গঠিত হয়। কোনো জাতির গঠন, উন্নতি, শ্রেষ্ঠত্ব ও দৃঢ়তা অর্জনে ঐ জাতির ব্যক্তিরাই মেরুদণ্ডের হাড়ের ভূমিকা রাখে।

হাদিসে বলা হয়েছে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি তার নিজ সত্তার পরিচিতি লাভ করতে পেরেছে সে মহান প্রভুকে চিনতে পেরেছে।’

উল্লিখিত হাদিসের কথাই পবিত্র কুরআনে সুরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াতে ভিন্ন ভঙ্গিতে মহান স্রষ্টা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন।’ এ কথার অর্থ হল আল্লাহকে ভুলে যাওয়া সমান নিজ সত্তাকে ভুলে যাওয়া। আসলে কি মানুষ নিজ সত্তাকে ভুলে যায়?

হ্যাঁ, মানুষ নিজ সত্তাকে ভুলে যায়। আজ আমরা নিজ সত্তাকে ভুলে বসেছি। যেহেতু আজ আমরা নিজ সত্তাকে ভুলে বসেছি তাই আজ আমার দ্বারা নানা ধরনের অন্যায় কাজ সংঘটিত হচ্ছে। নিরীহ মানুষ ও নিষ্পাপ শিশুদের ওপর জুলুম অত্যাচার করতেও আমার হৃদয় আজ কাঁদে না।

মুখে এক আর অন্তরে ভিন্ন, এটাই যেন আজ রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ আমাদের অন্তরে কি আছে তা তিনি খুব ভাল করেই জানেন। তাই মানুষকে নানান ভাবে ধোঁকা দেয়া সম্ভব কিন্তু আল্লাহপাককে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয়, কারণ তিনি প্রকাশ্য এবং গোপন, ভিতর এবং বাহিরের সব কিছু সম্পর্কেই অবগত।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি বল, তোমাদের অন্তরে যা আছে তা তোমরা গোপন কর বা তা প্রকাশ কর আল্লাহ তা জানেন। আর আকাশসমূহে যা আছে এবং পৃথিবীতে যা আছে তিনি তাও জানেন। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বশক্তিমান। সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভাল কাজ করেছে, চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও, ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দীর্ঘ হতো! আল্লাহ তার নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আর আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি অতি মমতাশীল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ২৯-৩০)

নিজেকে চেনার, জানার এবং নিজেকে সংশোধন করার সময় কি এখনো আসেনি? অনেকে বলতে পারেন, কেবল নিজেকে চিনলে লাভ কি? হ্যাঁ, লাভ আছে। যেভাবে বিন্দু বিন্দু জল মিলে নদী হয়, ছোট ছোট পাথর মিলে পাহাড় হয়, লতাপাতা, ছোট ছোট গাছ মিলে জঙ্গল হয় এভাবেই এক এক ব্যক্তি মিলে জাতি গঠিত হয়। কোনো জাতির গঠন, উন্নতি, শ্রেষ্ঠত্ব ও দৃঢ়তা অর্জনে ঐ জাতির ব্যক্তিরাই মেরুদণ্ডের হাড়ের ভূমিকা রাখে।

এই সত্যকে অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই যে, কোনো জাতির উন্নতির শিখরে পৌঁছার ক্ষেত্রে সেই জাতির লোকেরা চাবিকাঠির ভূমিকা রাখে। সেখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, কোন জাতির অধঃপতনের চরমে নিপতিত হওয়ার ক্ষেত্রেও তারাই দায়ী।
আজ যদি আমরা পরের দুঃখে ব্যথিত হই, অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করি, তাহলে সেই সত্তা যিনি আমাদের জীবনশিরারও নিকটে অবস্থান করেন তিনিই আমাদের সব সমস্যা দূর করবেন। ফকির লালন শাহ কতই না চমৎকারভাবে তার এক কবিতায় উল্লেখ করেছেন-
‘এমন মানব জনম আর কি হবে।
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।
অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের তুলনা কিছুই নাই।’

আসলে মানবের সাথে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। মানবতা আজ নেই বললেই চলে। আমরা চোখের সামনে একজন নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেললেও আমার হৃদয়ে তার জন্য সামান্য মায়া লাগে না। আমার চোখের সামনে কত অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে অথচ আমি দেখেও না দেখার ভান করছি! আমরা কি তাহলে জেনে বুঝে জাহান্নামকে হাতছানি দিয়ে ডাকছি?

যেভাবে আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি জ্বিন এবং মানুষদের অনেক দলকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর রয়েছে কিন্তু তা দিয়ে তারা বিবেচনা ও উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ রয়েছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না, তাদের কান রয়েছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না, তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতম, প্রকৃতপক্ষে তারাই উদাসীন, গাফেল এবং শৈথিল্যপরায়ণ।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৭৯)

হায়! আজ যদি আমি আমার জন্মের উদ্দেশ্যকে বুঝতে পারতাম, তাহলে হয়ত পশুর ন্যায় ছুটে বেড়াতাম না। ন্যায় অন্যায় বুঝতাম। অন্যের ক্ষতি সাধনের আগে শতবার ভাবতাম।

তাই আসুন, নিজেকে নিয়ে একটু ভাবি আর সব ধরনের অন্যায় পরিহার করে নিজের উত্তম কর্মদ্বারা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মাহাত্ম্্যকে জগতের সামনে ফুটিয়ে তুলি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি শান্তি ও সম্প্রীতির সমাজ রেখে যাই। আল্লাহপাক আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

Read Entire Article