দেশের আমদানিনির্ভর খাতে ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠেছে চীন

1 week ago 11

একসময় পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ ছিল ভারত। তবে বিশ্ব বাণিজ্যের নানান সমীকরণ ও মারপ্যাঁচে গত দেড় যুগে এ চিত্র পাল্টেছে অনেকটাই। বাংলাদেশও খুঁজে নিয়েছে নতুন ঠিকানা। যে ঠিকানার নাম চীন। দেশটি এখন বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের প্রধানতম উৎস। এই সময়ের মধ্যে চীনও বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর খাতে ধীরে ধীরে নিজেকে করে তুলেছে ‘অপরিহার্য’।

তুলনামূলক সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী চীনা পণ্য বাংলাদেশের সাধারণ গ্রাহকদের কাছেও দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সবশেষ কয়েক বছরে পরিস্থিতি এতটা পরিবর্তন হয়েছে যে, বলা যেতে পারে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ‘সুঁই থেকে রেফ্রিজারেটর’ পর্যন্ত সবকিছুতেই চীনা পণ্যের আধিক্য। এমনকি দেশে উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামালও বহুলাংশেই চীনের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ অঞ্চলে চীনের বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানির ক্ষেত্রে এ নির্ভরতা ক্রমেই অপরিহার্যতায় রূপ নিচ্ছে। ফলে দেশে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি বাণিজ্য বিকাশে আপাতত চীননির্ভরতার কোনো বিকল্প নেই।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য

বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ ৩৪১ দশমিক ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। আর বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি ছিল প্রায় ১০ কোটি ডলার। বছর বছর এই আমদানি ব্যাপক হারে বাড়লেও রপ্তানি সেই হারে বাড়েনি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ অঞ্চলে চীনের বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানির ক্ষেত্রে এ নির্ভরতা ক্রমেই অপরিহার্যতায় রূপ নিচ্ছে

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৩৫ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৬৪ কোটি মার্কিন ডলার এবং রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৭১ কোটি ৫৩ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২ হাজার ১৮০ কোটি ডলার ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক হাজার ৮৫০ দশমিক ৪০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়।

মৌলিক বিষয়গুলোও চীননির্ভর

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মূলত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক বিষয়গুলোর চাহিদা পূরণেও বাংলাদেশ এখন বহুক্ষেত্রে চীননির্ভর। কারণ, আগে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি হলেও এখন চীন থেকে সর্বাধিক খাদ্যপণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ। এছাড়া দেশে বহু খাদ্যপণ্যের শিল্পকারখানার কাঁচামাল কিংবা আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ নানা প্রযুক্তির সবই চীনের। আসছে সার, কীটনাশকও।

দেশের আমদানিনির্ভর খাতে ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠেছে চীন

আবার দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ ও রপ্তানিনির্ভর পোশাকশিল্পও চীনের ওপর ঝুকছে। এ শিল্পের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আসছে চীন থেকে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রীর প্রধান প্রধান কাঁচামাল, ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্সের যন্ত্রাংশের প্রায় ৯০ শতাংশ চীনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পণ্য। একইভাবে শিক্ষার মূল উপাদান কাগজের কাঁচামাল, বই ছাপানোর কালি ও প্রযুক্তি শেখার সব উপকরণও ওই দেশের।

আবার চিকিৎসা খাতে হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রাংশের বেশিরভাগ চীন থেকে আমদানিনির্ভর। আর দেশে যে ওষুধগুলো তৈরি হচ্ছে, তার কাঁচামালও আসে চীন থেকে।

আরও পড়ুন
চীনে উন্নত চিকিৎসা: ভিসা সহজ হলেও জটিলতা ভাষা ও খাবারে
চীনের মডেলে ‘শিল্পায়নের কেন্দ্রস্থল’ হতে চায় বাংলাদেশ
ছয় বছরে নেদারল্যান্ডসে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পণ্য, পণ্যের কাঁচামাল ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প এখন বাংলাদেশের হাতে নেই। এই সোর্স ব্যবসায়ীদের জন্যও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। চীন যখন প্রতিযোগিতামূলক দামে বিভিন্ন মানের পণ্য উৎপাদনের দিকে গেলো, বাংলাদেশ তখন মূলধনী যন্ত্রপাতি বেশি আনা শুরু করলো চীন থেকে। আগে বাংলাদেশ এগুলো আমদানি করতো জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া—এসব দেশ থেকে।’

২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীন থেকে এক লাখ ২৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকার খাদ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে; যা মোট আমদানির ২৩ শতাংশ। একই সময়ে চীনের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত থেকে ৫৬ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকার খাদ্যপণ্য এসেছে; যা মোট আমদানির সাড়ে ১৩ শতাংশ।—পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য

তিনি বলেন, ‘শুধু মূলধনী যন্ত্রপাতি নয়, মধ্যবর্তী ভোগ্যপণ্যও আসছে চীন থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নে চীনা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত পণ্য, নানা প্রযুক্তিপণ্য। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিরাজ করছে, সেটাও আমদানি বাড়াতে সহায়তা করেছে।’

চীন থেকে সর্বোচ্চ খাদ্য আমদানি

বাংলাদেশ খাদ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় অংশটি আমদানি করে চীন থেকে। প্রধান আমদানিপণ্যের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের কাঁচামাল, কিছু ভোজ্যতেল, গম, রসুন, আদা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচসহ বিভিন্ন ফল, কাঁচা মাছ ও মাংস রয়েছে। যদিও চীন থেকে এককভাবে কোনো শস্য সর্বোচ্চ আমদানি হয় না, কিন্তু নানান ধরনের পণ্য আমদানির কারণে এ পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ‘বৈদেশিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান’র তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীন থেকে এক লাখ ২৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকার খাদ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে; যা মোট আমদানির ২৩ শতাংশ। একই সময়ে চীনের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত থেকে ৫৬ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকার খাদ্যপণ্য এসেছে; যা মোট আমদানির সাড়ে ১৩ শতাংশ।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে খাদ্যপণ্য আমদানি করছেন বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সবসময় চায় নির্ভরযোগ্যতা ও মুনাফা। সেক্ষেত্রে চীনা পণ্যের দাম সবসময় ভালো থাকে। এছাড়া এলসি করে ঠিকঠাক পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তায় চীন সবচেয়ে এগিয়ে। যে কারণে ব্যবসায়ীরা চীনে পণ্য পেলে অন্যত্র যেতে চান না।’

মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাথী ট্রেডার্সের আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘চীন থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণে শুধু আদা ও রসুন আমদানি হচ্ছে, সেটাও প্রচুর। অন্য অনেক দেশের সার্বিক আমদানি খরচের চেয়ে সেটা বেশি।’

তিনি বলেন, ‘ভারতের পরে সবচেয়ে নিকটবর্তী ও কম পরিবহন খরচের দেশ চীন। সেখান থেকে পণ্য আমদানিতে ঝুঁকি ও ঝামেলা কম।’

দেশের আমদানিনির্ভর খাতে ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠেছে চীন

খাদ্য উৎপাদনে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সার আমদানি করে বাংলাদেশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৪ সালে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি মিলিয়ে মোট ৪৭ লাখ টন সার আমদানি হয়েছে। এ পরিমাণ সারের দাম ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মতো। যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সার আসে চীন থেকে।

সুতা, কাপড়সহ অন্য কাঁচামালের উৎস হিসেবে চীনের ভালো কোনো বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। এ খাত যত এগিয়ে যাবে, চীননির্ভরতা তত ব্যাপকহারে বাড়তে পারে। মূলত, কৃত্রিম সুতা ও কাপড়ের জন্য বিকল্প কিছু পাওয়া মুশকিল।—ফারুক হাসান

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) আহমেদ ফয়সল ইমাম বলেন, ‘চীন সার আমদানির জন্য নির্ভরযোগ্য দেশ। কয়েক বছর ধরে চীন থেকে প্রচুর সার আমদানি করছে বাংলাদেশ।’

পাশাপাশি দেশের বীজ, কীটনাশক ও কীটনাশক তৈরির কাঁচামালের বাজারও চীনের দখলে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৪০ হাজার টন কীটনাশক ও কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। যার অর্ধেকই চীনা পণ্য বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের।

বস্ত্রের কাঁচামালের ৮০ শতাংশ চীনের

দেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের কাঁচামালের প্রায় ৮০ শতাংশ চীনের ওপর আমদানিনির্ভর বলে তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি পরিসংখ্যান।

সরকারের এ সংস্থাটি বলছে, দেশের পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য থেকে শুরু করে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের আমদানির মূল উৎস এখন চীন। পোশাকশিল্পের ওভেন খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ বস্ত্র চীন থেকে আমদানি করা হয়। আর নিট পোশাকের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল এবং প্রায় ৮০ শতাংশ রাসায়নিক ও এক্সেসরিজও আসে চীন থেকে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের, যার ৮০ শতাংশই চীনের। এসব আমদানি করা কাঁচামালের মধ্যে ছিল তুলা, সুতা, স্ট্যাপল ফাইবার, টেক্সটাইল ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ম্যান মেইড ফাইবার (এমএমএফ) বা কৃত্রিম তন্তুর কাপড়ে তৈরি পোশাক। এ তন্তুর জন্য এখন ব্যবসায়ীরা প্রায় শতভাগ চীনের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চীন বিদেশি বিনিয়োগের একটি বড় উৎস, কারণ এ খাতে তাদের উচ্চদক্ষতা ও জ্ঞান রয়েছে। আমরা রপ্তানিকারক দেশ হলেও পোশাকের ব্র্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের বড় ধরনের ঘাটতি আছে।’

ভারতের পরে সবচেয়ে নিকটবর্তী ও কম পরিবহন খরচের দেশ চীন। সেখান থেকে পণ্য আমদানিতে ঝুঁকি ও ঝামেলা কম।—ব্যবসায়ী আব্দুল মাজেদ

‘যে কারণে এর কাঁচামালের চাহিদা আমদানির মাধ্যমেই মেটাতে হয়। সুতা, কাপড়সহ অন্য কাঁচামালের উৎস হিসেবে চীনের ভালো কোনো বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। এ খাত যত এগিয়ে যাবে, চীননির্ভরতা তত ব্যাপকহারে বাড়তে পারে। মূলত, কৃত্রিম সুতা ও কাপড়ের জন্য বিকল্প কিছু পাওয়া মুশকিল’- বলেন ফারুক হাসান।

নির্মাণশিল্পে একক আধিক্য

২০০০ সালের পর থেকে দেশে আমদানি খাতের শীর্ষ পণ্য সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ক্লিংকার আমদানি হয়েছে মোট দুই কোটি পাঁচ লাখ টন। এতে ব্যয় হয়েছে ১৩ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এ পণ্যটির ৩৫ শতাংশই চীনের।

প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘সিমেন্ট তৈরিতে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হলো—ক্লিংকার, জিপসাম, স্ল্যাগ, চুনাপাথর ও ফ্লাই অ্যাশ। যার বেশিরভাগ আমদানিনির্ভর। চীনের পাশাপাশি ভারত, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কোরিয়া থেকেও এসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে।’

দেশের আমদানিনির্ভর খাতে ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠেছে চীন

শুধু ক্লিংকার নয়, দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানি পণ্য কয়লা ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভাঙা পাথর। এর সবই নির্মাণশিল্পের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শীর্ষ কাঁচামাল। কারণ, কয়লা দিয়েই তৈরি হয় অবকাঠামো নির্মাণের অন্যতম উপকরণ ইট। এসব সামগ্রীও আসে চীন থেকে।

আরও পড়ুন
দুর্লভ খনিজ রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলো চীন
চীনের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছেন ট্রাম্প
সংকটে জর্জরিত আকাশপথে পণ্য পরিবহন, বাধাগ্রস্ত আমদানি-রপ্তানি

দেশে আকরিক লোহার খনি না থাকায় চাহিদার প্রায় শতভাগ ইস্পাত আমদানি করতে হয়। বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন ইস্পাত আমদানি হয় দেশে। এ শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে বড় নির্ভরতা রয়েছে চীনের ওপর। এছাড়া বর্তমানে টাইলস, মার্বেলসহ বসতবাড়ির নানান ধরনের ফিটিংসের বাজারেও রয়েছে চীনের পণ্যের দাপট।

শিক্ষাসামগ্রীর মূল উপাদান আমদানি

বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের কাগজ ব্যবহার করা হয়। বইপত্র ছাপানো বা পড়াশোনার কাজে হালকা কাগজ আর ক্যালেন্ডার, প্যাকেজিং বা গার্মেন্টস শিল্পের ভারী কাগজ। লেখা ও ছাপার জন্য বছরে ১০ লাখ টন কাগজের চাহিদা রয়েছে। যার বেশিরভাগ দেশে উৎপাদিত হয়।

তবে এসব কাগজ তৈরির উপকরণ পাল্প আমদানি করতে হয়। একই সঙ্গে ভারী কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। ওইসব পাল্প ও ভারী কাগজ এখন চীন থেকে আসছে।

আম্বার পেপার মিলস লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান জানান, দেশে প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি কারখানায় কাগজ উৎপাদন হলেও এসব প্রতিষ্ঠান পাল্প আনছে চীন থেকে। থাইল্যান্ড ও জার্মানি থেকেও কিছু পাল্প আসে। তবে চীন থেকে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, যা শুরু থেকে গতিশীল ও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে। চীন ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির দেশ, তারা ব্যবসাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। কোনো ভূ-রাজনৈতিক কারণে দু’দেশের ব্যবসায়িক টানাপোড়েন কখনো হয়নি।—অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক

বাজারে কলম, পেনসিল, ব্যবহারিক খাতা, মার্কার, ফাইল, বোর্ড, ক্যালকুলেটর, স্কেল, কালির মতো শিক্ষাসামগ্রীর অধিকাংশ উপকরণ কিংবা এসব উপকরণ তৈরির কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির প্রধান উৎসও এখন চীন।

ওষুধের এপিআই বেশিরভাগই চীনের

বাংলাদেশ ওষুধ প্রস্তুতকারকরা দেশের চাহিদার প্রায় পুরোটা মেটানোর পাশাপাশি ১৬০ দেশে রপ্তানিও করছে। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঁচামালের বেশিরভাগ আনতে হচ্ছে চীন থেকে।

দেশের ওষুধশিল্পের বাজারের আকার ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টের (এপিআই) ৯৭ শতাংশ চাহিদা মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। গত অর্থবছর দেশে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয় ৬০ কোটি ডলার বা পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কাঁচামাল চীনের বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব মো. জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওষুধ ফরমুলেশনে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু এপিআই সক্ষমতা না থাকায় আমাদের ভিত্তি দুর্বল। এখন চীন আমাদের ব্যাকআপ দিচ্ছে। ওষুধের কাঁচামালের সবচেয়ে সাশ্রয়ী উৎসও তারা। চীনের এপিআই সরবরাহকারীদের বিকল্প পাওয়া কঠিন।’

বিশ্বস্ততা ও স্থিতিশীলতা ছিল সবসময় অটুট

১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর চীন থেকে পণ্য আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। প্রথম ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস।

দেশের আমদানিনির্ভর খাতে ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠেছে চীন

অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-চায়না অ্যালামনাইয়ের (এবিসিএ) সাধারণ সম্পাদক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, যা শুরু থেকে গতিশীল ও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে। চীন ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির দেশ, তারা ব্যবসাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। কোনো ভূ-রাজনৈতিক কারণে সে দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক টানাপোড়েন কখনো হয়নি।’

এ ধরনের বিশ্বস্ততা ও স্থিতিশীলতা চীনের প্রতি এদেশের ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করে তুলেছে বলেও মনে করেন তিনি।

ড. সাহাবুল হক বলেন, ‘একসময়ের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন বারবার হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হলেও বন্দর বন্ধ করে দেওয়া, হুট করে পণ্যে অস্বাভাবিক শুল্ক আরোপ এবং নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘটনা ভারতের সঙ্গে অহরহ হয়। যে কারণে ভারতের চেয়ে চীনের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি। কারণ, সব ব্যবসায়ীই নিরবচ্ছিন্ন ও টেকসই ব্যবসা করতে চান।’

তিনি বলেন, ‘দুই দেশের এ দীর্ঘদিনের ব্যবসা শুধু অর্থনৈতিক হিসাবই নয়, কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও চীনের প্রভাব স্পষ্ট ছিল।’

দু’দেশের সরকারের মধ্যেও ভালো সমঝোতা

শুধু ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নয়, দু’দেশের সরকার পর্যায়েও ভালো সমঝোতা ছিল সবসময়। যে কারণে এদেশে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে চীনের বড় প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে শুরু করে পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে—সবখানেই রয়েছে চীনা কোম্পানির হাতের ছোঁয়া।

চীনের সরকারি ঋণ ও বিনিয়োগ এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় উৎস। প্রতিবেশী চারটি দেশ নিয়ে গঠিত আঞ্চলিক জোট বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার) অর্থনৈতিক করিডোর এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বাংলাদেশের ৩০টিরও বেশি প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে চীন। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, বর্তমানে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি।

এনএইচ/এমকেআর/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article