নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

2 hours ago 5

ঢাকার এক প্রান্তে, আব্দুল্লাহপুরের তুরাগ নদীর পাড়ে যখন সূর্য ডুবে যায়, তখন শহরের আলো নিভে না, নৌকায় একের পর এক বাতি জ্বলে ওঠে। সেই আলোয় দেখা যায় ভেসে থাকা জীবনের এক অনন্য অধ্যায়। এখানেই নদীর বুকে সাজানো ছোট ছোট নৌকা যেন একেকটি ভাসমান বাড়ি। কোনো নৌকায় মা রান্না করছেন, অন্যটায় শিশুরা পড়ছে, কারো নৌকায় টিভির শব্দ, আবার কোথাও শুধু ঢেউয়ের ছলাৎছল শব্দ।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

একসময় এই নদীপাড় ছিল বেদেদের বসতি। তারা নদীর সঙ্গে, নৌকার সঙ্গে, জলের সঙ্গে ছিল একাত্ম। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। সেই জায়গায় এখন এসেছে নানা পেশার মানুষ রিকশাচালক, হকার, রাজমিস্ত্রি, এমনকি দিনমজুর। শহরের ব্যয়বহুল জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে তারা বেছে নিয়েছেন এই ভাসমান আশ্রয়। কারণ নদীর পাড়ে থাকা মানে, অন্তত মাথার উপর একটা ছাদ তো আছে যদিও সেটা কাঠের, টিনের আর প্লাস্টিকের মিশ্রণে তৈরি ভাসমান ঘর।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

তুরাগ নদীর এই অংশে দিনের শুরু হয় ঢেউয়ের শব্দে। সকালে অনেকেই নৌকা থেকেই নেমে নদীতে মুখ ধোয়, কেউ গোসল করে, কেউ আবার নদীর পানি দিয়েই রান্না শুরু করে। শিশুদের হাসি, বয়স্কদের ক্লান্ত মুখ সবকিছুতেই যেন জড়িয়ে আছে নদীর গন্ধ।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

এই ভাসমান জীবনের মানুষগুলো অনেকেই শহরে গিয়ে রিকশা চালায়, কেউ ভাসমান বাজারে মাছ বিক্রি করে, কেউ আবার কাঠের কাজ করে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে যখন তারা ফিরে আসে, তখন তুরাগ নদীর হাওয়া যেন তাদের ক্লান্তি দূর করে দেয়।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

রাতের তুরাগ নদীর দৃশ্যটা অন্যরকম। নৌকার পর নৌকা সারিবদ্ধ হয়ে থাকে, তাতে জ্বলে মৃদু আলো। দূর থেকে মনে হয় যেন পানির ওপর বসে আছে এক টুকরো তারা ভরা আকাশ।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

তবে এই জীবনের কষ্টও কম নয়। বর্ষায় যখন নদী ফুলে ওঠে, তখন ভাসমান ঘরগুলোও ভাসে ভয়ের মধ্যে। মাঝে মাঝে ঝড়ের রাতে নৌকা ভেসে যায়, কারো জীবনও হারিয়ে যায় সেই জলে।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

তাছাড়া, নিরাপদ পানির অভাব, পয়োনিষ্কাশনের সমস্যা, আর স্কুলের দূরত্ব-সব মিলিয়ে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। তবুও তারা টিকে আছে, হাসছে, লড়ছে। কারণ তাদের কাছে জীবন মানে নদীর স্রোতের মতো যত বাধাই আসুক, থেমে থাকা নয়।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

একসময় এই অঞ্চলে বেদে সম্প্রদায়ের জীবন ছিল রঙিন ও রহস্যময়। তারা ঘুরে বেড়াত, সাপের খেলা দেখাত, তাবিজ বিক্রি করত, গান গাইত। এখন সেই নৌকাগুলোতেই শহরের শ্রমজীবীরা খুঁজে নিয়েছে নতুন বাস্তবতা। বেদেদের গল্প হারিয়ে গেছে, কিন্তু নৌকার ভেতরে বেঁচে আছে ‘ভাসমান জীবনের’ এক নতুন অধ্যায়।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

তুরাগ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যদি কেউ এক মুহূর্ত তাকায়, সে বুঝবে এখানেই ঢাকার আরেকটা রূপ আছে। বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এমন মানুষও আছে, যারা নদীর ঢেউ গুনে দিন কাটায়।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

এই মানুষগুলো শহরের অংশ, তবুও শহর তাদের দেখে না। তারা আলোছায়ার সীমানায় বেঁচে থাকা এক সম্প্রদায় যাদের ঘর নেই, কিন্তু ঠিকানার নাম আছে তুরাগ নদীর বুক।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

সূর্য ডোবে, নদীর জলে লাল আভা পড়ে। কেউ নৌকার ছাদে বসে গান গায়, কেউ চুলায় ভাত চাপায়। দূরে আজানের সুর ভেসে আসে। নদী থেমে থাকে না তেমনি এই জীবনের স্রোতও থামে না।

নদীর বুকেই ভাসছে জীবন

তুরাগ পাড়ের এই নৌকাগুলো হয়তো বিলাসী জীবনের প্রতিচ্ছবি নয়, কিন্তু তারা জীবনের আরেকটা সত্য শেখায়- ঘর মানে চার দেয়াল নয়, যেখানে মানুষ ভালোবাসে, সেখানেই তার ঠিকানা।

জেএস/

Read Entire Article