আমার ছেলে আহমাদ বিন আলিমের বয়স বারো। সময়-সুযোগ পেলেই পাবলিক বাসে চেপে বসে; বেইজিংয়ের নানান জায়গায় একা একা ঘুরে বেড়ায়। চীনের রাজধানী পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ জায়গা, যদি সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা না-হয়। তারপরও, পিতামাতার মন বলে কথা! শর্তসাপেক্ষে তাকে একা একা ঘুরতে যেতে দেওয়া হয়: প্রথমত, মাগরিবের আগে ঘরে ফিরতে হবে; দ্বিতীয়ত, স্মার্ট ঘড়ি হাতে পরতে হবে।
স্মার্ট ঘড়ি আসলেই স্মার্ট। এর নিজস্ব একটা সিমকার্ড আছে। সে চাইলে ঘড়ি থেকে যে-কাউকে ফোন করতে পারে, আবার আমরা চাইলে তাকে সাধারণ ফোন থেকে কল করতে পারি। অডিও-ভিডিও দু’ধরনের কলই চলে। সবচেয়ে বড় কথা, ওর স্মার্ট ঘড়ি নিয়ন্ত্রিত হয় আমার মোবাইল ফোন দিয়ে। সে কোথায় যায়, কখন যায়, আমার ফোনে ইনস্টল করা সংশ্লিষ্ট একটা অ্যাপ তা সবসময় নজরে রাখে।
দু’জনই হাসলেন। হাসিকে অনুমতি ধরে নিয়ে আমি তাদের ছবি তুললাম। ছবি তুলেই সামনে এগিয়ে গেলাম ও তাদের উদ্দেশ করে বললাম: ‘আসসালামু আলাইকুম।’ প্রবীণ ভদ্রলোকের মুখের হাসি আরও বিস্তৃত হলো, তিনি অনেকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মুসলিম?!’ আমি মাথা নেড়ে হ্যান্ডশেকের জন্য উনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। ভদ্রলোকের হাতে দস্তানা পরা ছিল, তিনি দ্রুত সেটা খুলে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি একটা সুন্দর স্মৃতি নিয়ে গন্তব্যের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
তো, সে স্মার্টঘড়ি হাতে পরে বেইজিং ঘুরে বেড়ায় পাবলিক বাসে। চীনে পাবলিক বাসে ভাড়া খুবই কম। আমার মানিব্যাগের ওপর তেমন কোনো চাপ পড়ে না। সে যে সবসময় শর্ত মেনে চলতে পারে, তা নয়। বরং প্রায়ই শর্ত ভেঙে শাস্তি পায়। ঘড়ি পরে বের হওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মাগরিবের আগে ঘরে ফেরার শর্ত সে প্রায়শই ভাঙে এবং বিনিময়ে পরের তিন দিন পাবলিক বাসে চড়ার অধিকার হারায়।
এভাবেই চলছে। পাবলিক বাসে চেপে বেইজিংয়ের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করা, নতুন নতুন জায়গার অনুসন্ধান করা। প্রাপ্ত নতুন তথ্য সে নিয়মিত আমাদের সঙ্গে শেয়ারও করে; বেইজিং সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়ে। নিংসিয়া ভ্রমণে এসে আমিও দলের অন্যান্যের সঙ্গে বাসে চেপে ঘুরেছি; আধা ঘন্টা থেকে ৪ ঘন্টার পথ; এক শহর থেকে আরেক শহরে; একই শহরের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। পার্থক্য শুধু একটাই: ছেলে পাবলিক বাসে চড়ে, আর আমরা ভাড়া-করা-বাসে ঘুরেছি।

১২ আগস্ট ২০২৫, ছিল চীনের নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে আমাদের অষ্টম তথা কার্যত শেষ দিন। চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এবং বেইজিংয়ের অন্যান্য গণমাধ্যমের একদল সাংবাদিককে নিয়ে এই ‘আমরা’। এরই মধ্যে নিংসিয়ার সর্বমোট ৫টি শহরের সবকটি আমাদের দেখা হয়ে গেছে। আমাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল ওই বাস। ১২ আগস্ট সকালেই আমরা চুংওয়েই শহরের ‘তাঁবু-হোটেল’ ছেড়ে আসি আমাদের শেষ গন্তব্য উচুং শহরে। এদিনও আমরা কয়েকটি দর্শনীয় জায়গায় গেছি, নতুন জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়েছি।
শুধু বাসে বসে, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, আমি নিংসিয়া সম্পর্কে যেটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি, তা-ও কম নয়। নিংসিয়ার কোনো শহরেই যানজটের বালাই নেই। এমনকি রাজধানী ইনছুয়ানেও না। এর মূলত কারণ দুটো: এক. নিংসিয়ার জনসংখ্যা অনেক কম, মাত্র ৭২ লাখের মতো; দুই. সব শহরেই সড়কগুলো অনেক চওড়া ও সড়কের নেটওয়ার্ক যথেষ্ট বিস্তৃত। আমি এক সপ্তাহে পাঁচ শহরের কোনোটিতে সড়কে একসঙ্গে পঞ্চাশটি গাড়িও দেখিনি। গাড়ির চাপ কম, যাত্রীদের চাপ কম, পথচারীদের চাপ কম, কিন্তু ট্র্যাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা ঠিকঠাকমতোই কাজ করে যাচ্ছে। লাল বাতি জ্বললে গাড়ি-পথচারী নির্বিশেষে সবাই থামছে, সবুজ বাতি জ্বললে চলছে।
নিংসিয়ায় কোনো মেট্রো তথা পাতাল রেল নেই। থাকার আসলে দরকারও নেই। চীনের জনসংখ্যা কমছে। এই প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে, আগামী পঞ্চাশ বছরে নিংসিয়ায় পাতাল রেলের প্রয়োজন হবে বলেও মনে হয় না। তবে, নিংসিয়ার সড়কগুলোর বিন্যাস, ডিজাইন, ও নেটওয়ার্ক দেখে মনে হলো, একসময় পাতাল রেলের প্রয়োজন হতে পারে—এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখা হয়েছে।
নিংসিয়ার মানুষ পাবলিক বাসে চড়ে। মাঝেমাঝে পাবলিক বাস দেখা যায়। বেইজিংয়ের মতো ঘন ঘন দেখা যাওয়ার কারণও নেই। রুটের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বাসে ভিড়বাট্টাও তেমন একটা নেই। পাবলিক বাসের পাশাপাশি, প্রাইভেট কার আছে, যার সংখ্যাও বেইজিংয়ের তুলনায় অনেক কম।
নিংসিয়ায় বেইজিং বা অন্যান্য বড় শহরের মতো ভাড়ায় সাইকেল পাওয়া যায় না। আমি গোটা নিংসিয়ায় মাত্র দুই-তিনটি প্রাইভেট সাইকেল দেখেছি। তবে, ভাড়ায় ই-বাইক পাওয়া যায়। একাধিক কোম্পানির ই-বাইক আমি দেখেছি। তবে, সেগুলোর সংখ্যাও হাতে গোনা যাবে, এমন। মাঝেমাঝে ফুটপাতে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬টি ই-বাইক চোখে পড়ে; ই-বাইকে চড়া যাত্রী অবশ্য আমি গাড়ির জানলা দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দেখেছি। তবে, একসঙ্গে একাধিক লোককে ই-বাইকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

সে যাই হোক, সফরের শেষ দিনে বাসে চড়ে কোথায় কোথায় গেলাম, কী কী দেখলাম, সে প্রসঙ্গে আসি। নিংসিয়ায় আসার পর আমরা একাধিক ওয়াইন কারখানা পরিদর্শন করেছি। উচুংয়ে এসে ভিনেগার তৈরির কারখানা ঘুরে দেখলাম। মুসলিমদের জন্য ওয়াইন হারাম, কিন্তু ভিনেগার হালাল। আপেল জুসের সাথে ভিনেগার মিশিয়ে তৈরি একধরনের হালকা পানীয়ের স্বাদ চেখে দেখলাম। জানানো হলো, এই ভিনেগার তৈরির কারখানাটি উচুংয়ের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় কারখানা।
দুপুরে লাঞ্চের অভিজ্ঞতাটা ছিল চমৎকার। নিংসিয়ার খাবার এমনিতেও সুস্বাদু। জানলাম, উচুংয়ের খাবার নিংসিয়ার সেরা। আসলেই তাই। খাবারের সময় রেস্তোরাঁর একজন কর্মকর্তা (সম্ভবত মালিক) বিশেষ এক ধরনের চায়ের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। চায়ের নাম ‘পা পাও ছা’, যার অর্থ দাঁড়াবে ‘আটটি অমূল্য উপাদানে তৈরি চা’। সাধারণ চা পাতার সাথে কয়েকটি ফল মিশিয়ে তাতে গরম পানি ঢেলে ঢেকে দিতে হয়। তারপর, বিশেষ কায়দা করে পান করতে হয়। খেতে ভালোই লাগে।
পরে জানলাম, আমরা যাকিছু লাঞ্চ হিসেবে খেয়েছি, স্থানীয়রা সেগুলো ব্রেকফাস্ট হিসেবে খায়! তবে, সেই খাওয়া চলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। পা পাও ছা-এর সাথে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি, মাংস থাকতেই হবে। চায়ের সাথে মাংস খাওয়ার কথা জীবনে প্রথম শুনলাম। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো: দুপুর পর্যন্ত যদি ব্রেকফাস্ট চলে, তবে লাঞ্চ ওরা খায় কখন?
পা পাও ছা চীনের অন্যান্য জায়গায়ও খাওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে এই চা পরিচিত ‘লিউছানতুও’ (LIUSANDUO) নামে। ১৮৬১ সালে লিউ নামের এক ভদ্রলোক উচুংয়ে এই চায়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসা এখন ফুলে-ফেঁপে অনেক বড় হয়েছে। একটা বিশাল দোকানে তার উত্তরপুরুষরা সে ঐতিহ্য ধরে রাখতে সচেষ্ট আছে। সেখানে রীতিমতো হাতেকলমে আমাদের আবারও পা পাও ছা বা লিউছানতুও বানানোর ও পান করার কৌশল শেখানো হলো। দলের মোটামুটি সবাই দোকান থেকে চা ও চা-সংশ্লিষ্ট পণ্য কিনলেন।
হোয়াংহো তথা হলুদ নদীর কথা আগের লেখায় এসেছে। চীনাদের মাতৃনদী হোয়াংহো। একসময় এটি ছিল চীনের দুঃখ। এই নদীর পানিতে সয়লাব হয়ে যেতো মানুষের বাড়ি-ঘর, ফসলের জমি। কিন্তু বাঁধ নির্মাণ করে সে দুঃখ দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন চীনাদের পূ্র্বপুরুষরা। উচুংয়ের মধ্য দিয়েও বয়ে গেছে হোয়াংহো। উচুং এলাকায়ও হোয়াংহোর উপর একটি বাঁধ আছে, যেটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। এ বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল হোয়াংহোর পানিকে সেচকাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন অনুসারে এতদঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় প্রবাহিত করা। আমরা সেই বাঁধটি দেখলাম এবং ছোটোখাটো একটা জাহাজে ৪৫ মিনিটের নদীভ্রমণের আনন্দ নিলাম। দুই পাশে পাথুরে পাহাড়, আর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে হোয়াংহো। চমৎকার একটা দৃশ্য, অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।
উচুং শহরের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। নিংসিয়ার পাঁচটি শহরের মধ্যে একমাত্র উচুংয়েই হুই মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। শহরের প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষই হুই। স্বাভাবিকভাবেই, সর্বত্র তাদের আনাগোনা চোখে পড়ে। স্থানীয় একজন সাংবাদিক, যিনি আমাদের সফর কাভার করতে এসেছিলেন, তিনিও হুই মুসলিম। চীনারা স্বভাবগতভাবেই বিনয়ী, ভদ্র, অতিথিপরায়ণ, ও হেল্পফুল। হুইরাও এর ব্যতিক্রম নয়।

দু’জন প্রবীণ হুই মুসলিমের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ঘটনা দিয়ে আজকের তথা এই সিরিজের লেখার ইতি টানতে চাই। নদীভ্রমণের জন্য একটি পার্কের ভিতর দিয়ে জাহাজ-ঘাটার দিকে যাচ্ছিলাম আমরা সবাই মিলে। এমন সময় নজরে এলো একজন প্রবীণ পুরুষ ও একজন প্রবীণ নারী পার্কের একটি বেঞ্চে বসে আছেন। পুরুষটির মাথায় টুপি এবং নারীর মাথায় হিজাব। আসলে হিজাব না-বলে ‘টুপি’-ই বলা উচিত। চীনা মুসলিম মেয়েরাও মাথায় টুপি পরে। সিনচিয়াংয়ে অনেক উইগুর মুসলিম নারীর মাথায় আমি টুপি দেখেছি।
যাই হোক, আমি সেই দুই প্রবীণের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, নিজের হাতের মোবাইল দেখিয়ে ইঙ্গিতে ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। দু’জনই হাসলেন। হাসিকে অনুমতি ধরে নিয়ে আমি তাদের ছবি তুললাম। ছবি তুলেই সামনে এগিয়ে গেলাম ও তাদের উদ্দেশ করে বললাম: ‘আসসালামু আলাইকুম।’ প্রবীণ ভদ্রলোকের মুখের হাসি আরও বিস্তৃত হলো, তিনি অনেকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মুসলিম?!’ আমি মাথা নেড়ে হ্যান্ডশেকের জন্য উনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। ভদ্রলোকের হাতে দস্তানা পরা ছিল, তিনি দ্রুত সেটা খুলে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি একটা সুন্দর স্মৃতি নিয়ে গন্তব্যের দিকে হাঁটতে লাগলাম। (শেষ)
উচুং, নিংসিয়া, ১২ আগস্ট ২০২৫
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
এইচআর/জিকেএস

4 hours ago
6









English (US) ·