প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ (৫ নভেম্বর ২০২৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১,০৬৯ জন এবং মারা গেছেন ১০ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে ৭৪,৯৯২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৩০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবর মাসেই মারা গেছেন ৮০ জন এবং নভেম্বরের প্রথম পাঁচ দিনে আরও ২০ জন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে ১,৭০৫ জন এবং ২০২৪ সালে ৫৭৫ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে যে, ডেঙ্গু এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নভেম্বর মাসে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আসন্ন মাসগুলোতে সংক্রমণ আরও বিস্তার লাভ করতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু সংক্রমিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মৃত্যুহার এখনো অনেক বেশি। ২০২৩ সালে মৃত্যুহার ছিল ০.৫১ শতাংশ, আর ২০২৫ সালে তা কিছুটা কমে ০.৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে এই হার ০.০১ শতাংশেরও নিচে। ব্রাজিলে মৃত্যুহার ০.০৪৯ শতাংশ এবং ফিলিপাইনে ০.৩৪ শতাংশ। এসব দেশের অভিজ্ঞতা দেখায়, উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের কারণে মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে রয়েছে চিকিৎসায় বিলম্ব, হাসপাতালে দেরিতে আগমন, সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত না করা এবং প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাব।
এ বছর আক্রান্ত রোগীদের ৬২ শতাংশের বেশি পুরুষ হলেও মৃত্যুহারে লিঙ্গভেদ তেমন বেশি নয়—পুরুষ ৫৩.৩ শতাংশ এবং নারী ৪৬.৭ শতাংশ। নারীদের তুলনামূলক বেশি মৃত্যুহার ইঙ্গিত করে যে, অনেক নারী দেরিতে হাসপাতালে আসছেন বা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এটি সমাজে সচেতনতার ঘাটতি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নারীর প্রতিবন্ধকতার দিকটিও নির্দেশ করে।
এডিস মশা আজ আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যর্থতাকে সফলতায় রূপ দিতে হলে এখনই সময় দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। ডেঙ্গু আর কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়—এটি এখন জাতীয় সংকট। এর সমাধানে সমন্বিত জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প নেই।
চলতি বছরের মৃত্যুহারের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সর্বাধিক মৃত্যু—প্রায় ৬৫ শতাংশ। শিশু ও কিশোরদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ১৫ শতাংশ এবং প্রবীণদের মধ্যে ৮ শতাংশ। এই চিত্রটি প্রমাণ করে, ডেঙ্গু এখন আর কেবল শিশুদের রোগ নয়; বরং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, যা অর্থনীতি ও উৎপাদনশীলতার ওপরও প্রভাব ফেলছে।
ঢাকা বিভাগেই দেশের মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ)। এরপর চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে মৃত্যুহার তুলনামূলক বেশি। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সর্বাধিক। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা ও যশোরসহ বেশ কিছু জেলায় সংক্রমণ ক্রমে বাড়ছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গুর বর্তমান ঢেউ আগামী বছরের শুরু পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই আমি মাঠ ও গবেষণাগারে মশা নিয়ে কাজ করছি। ২৬ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো নীতিনির্ধারকদের গবেষণাভিত্তিক পরামর্শ উপেক্ষা করা। আমি একাধিকবার বৈজ্ঞানিক মডেল প্রস্তাব করেছি, যা ২০২৪ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠ–এর সম্পাদকীয় পাতায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ কারণেই আজও আমরা একটি ছোট্ট পতঙ্গ—এডিস মশার কাছে পরাজিত হচ্ছি।
ডেঙ্গু মৃত্যুহার কমাতে প্রথম ও প্রধান করণীয় হলো দ্রুত রোগ শনাক্ত করা এবং সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, জ্বরকে সাধারণ ভাইরাল জ্বর ভেবে চিকিৎসা নিতে দেরি করা হয়, ফলে রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। সময়মতো পরীক্ষা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে অধিকাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এসব হাসপাতালে অন্তত দুইজন চিকিৎসককে ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনে রোগীকে অন্যত্র পাঠানো না হয়। কারণ এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের সময়ই অনেক রোগীর অবস্থা মারাত্মক হয়ে ওঠে। এই রেফারেল বিলম্ব কমাতে প্রশাসনিকভাবে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মৃত্যুবিশ্লেষণ টিমের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিটি মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে ভবিষ্যৎ প্রতিরোধমূলক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সঠিক ক্লিনিকাল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে চিকিৎসকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ জরুরি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের “Clinical Management of Dengue” বইটি মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকদের হাতে পৌঁছে দিয়ে এর ওপর প্রশিক্ষণ চালানো প্রয়োজন। অনেক সময় অজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার অভাবে রোগী মারা যায়, যা প্রতিরোধযোগ্য।
একই সঙ্গে হাসপাতালভিত্তিক ওষুধ, স্যালাইন, রক্ত সরবরাহ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে তথ্য ও চিকিৎসা সমন্বয় বাড়ানো গেলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। ডেঙ্গু চিকিৎসায় দ্রুত শনাক্তকরণ, হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি, চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ও মৃত্যুবিশ্লেষণ, এই চারটি উপাদান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল শর্ত হলো এডিস মশার প্রজনন রোধ করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ফগিং বা কীটনাশক স্প্রে করেই কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব শেষ মনে করে। অথচ এগুলো সাময়িক সমাধান মাত্র। টেকসই সমাধানের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। এডিস মশা সাধারণত ঘরের ভিতর বা আশপাশের পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে, ফুলের টব, টায়ার, ড্রাম বা ছাদের পানির ট্যাংক এসব তার প্রজনন ক্ষেত্র।
মশার প্রজনন বন্ধ করতে হলে প্রথমেই করতে হবে “Source Reduction”, অর্থাৎ মশার জন্মস্থল ধ্বংস। প্রতিটি নাগরিকের উচিত সপ্তাহে অন্তত একদিন বাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার রাখা। যেখানে পানি জমে, তা খালি বা ঢেকে রাখতে হবে। প্রয়োজন হলে লার্ভানাশক যেমন নোভালিউরন, টেমিফস বা ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইজরাইলেন্সিস ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলে তার বাড়ির চারপাশে অন্তত ২০০ মিটার এলাকায় ফগিং ও লার্ভা ধ্বংস কার্যক্রম চালাতে হবে।
তবে শুধু ফগিং নয়, সময় ও কৌশলও গুরুত্বপূর্ণ। সকালে বা দুপুরে ফগিং করলে ফল পাওয়া যায় না, কারণ তখন মশা নিষ্ক্রিয় থাকে। ফগিং করতে হবে ভোরবেলা বা বিকেলবেলা, যখন এডিস মশা সক্রিয় থাকে। এ কার্যক্রম বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে পরিচালনা না করলে ফলাফল আসবে না।
মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জনগণের যৌথ অংশগ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে সমন্বয়ের অভাব, বাজেট অপচয় এবং তদারকির ঘাটতির কারণে কার্যক্রমগুলো ব্যর্থ হয়। এজন্য একটি জাতীয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি, যেখানে সিটি কর্পোরেশন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ এবং স্থানীয় প্রতিনিধিরা একসঙ্গে কাজ করবেন।
এডিস নিয়ন্ত্রণে নাগরিক অংশগ্রহণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে “মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি” গঠন করে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এতে সচেতনতা যেমন বাড়বে, তেমনি প্রশাসনিক চাপও কমবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে মশা নিয়ন্ত্রণকে আরও কার্যকর করা যায়, নাগরিকরা মোবাইল অ্যাপ বা অনলাইন সিস্টেমের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রজননস্থল রিপোর্ট করতে পারেন।
আমাদের পার্শ্ববর্তী শহর কলকাতা এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেখানে “Integrated Mosquito Management (IMM)” মডেলের মাধ্যমে সারা বছর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, সোর্স রিডাকশন এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো হয়। ফলে জলবায়ু ও জনঘনত্ব প্রায় একই হলেও তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল।
বাংলাদেশেও এমন বৈজ্ঞানিক ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, গবেষক, গণমাধ্যম ও জনগণ—সবাইকে একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস, দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ এবং হাসপাতালভিত্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি—এই তিনটি পদক্ষেপ যদি নীতি–স্তরে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে বাংলাদেশেও ডেঙ্গু মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
এডিস মশা আজ আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যর্থতাকে সফলতায় রূপ দিতে হলে এখনই সময় দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। ডেঙ্গু আর কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়—এটি এখন জাতীয় সংকট। এর সমাধানে সমন্বিত জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প নেই।
লেখক: কীটতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/এএসএম

5 hours ago
4









English (US) ·