- খাবার ও মাছের দামের দ্বিমুখী চাপে চাষিরা
- মাছের খাবারের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৪০ টাকা
- মনিটরিংয়ের অভাবে খাবারের দাম বাড়াচ্ছে কোম্পানিগুলো
- মাছের দামে সিন্ডিকেটের হানা
- পাঙাশের ঘাটতি বড় প্রভাব ফেলবে গরিবের আমিষে
দেশের অন্যতম প্রধান মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্র ময়মনসিংহে পাঙাশ মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। মাছচাষিরা বলছেন, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদন খরচে লাগামহীন চাপ এবং বাজারে ন্যায্যদাম না পাওয়ার কারণে তারা পাঙাশ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অনেকে পুকুর খালি রেখে দিয়েছেন, কেউ কেউ আবার অন্য জাতের মাছচাষে ঝুঁকছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন পাঙাশ উৎপাদন হয়েছিল। এরপর থেকেই উৎপাদন কমতে থাকে। পরের বছর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন কমে হয় ৪ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন আরও ৫০ হাজার মেট্রিকটন কমে।
‘এক বছর আগেও এক কেজি খাদ্য কিনেছি ৯০ টাকা দরে। এখন সেটা কিনতে হচ্ছে ১৩৬ টাকায়। মাছের খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলেও পাইকাররা উপযুক্ত দাম না দেওয়ায় আমাদের পোষাচ্ছে না।’
এদিকে পাঙাশ উৎপাদনে বিখ্যাত ময়মনসিংহ জেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৬৭ মেট্রিক টন পাঙাশ উৎপাদন হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯১ হাজার ৭৬১ মেট্রিক টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ১১ হাজার ৭৪৯ মেট্রিক টন পাঙাশ মাছ উৎপাদন হয়। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১ লাখ ১১ হাজার ৯৭৬ মেট্রিক টন।
আরও পড়ুন-
পুকুরে পাঙাশ মাছ চাষে কমবে বেকারত্ব
বর্ষাকালে পুকুরে লাভজনক মাছ চাষের উপায়
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে পাঙাশ উৎপাদন খাত একটি নীরব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রোটিনের জোগানে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে বাজারে ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এই দ্বিমুখী চাপে পড়ে পাঙাশ চাষি ও এই খাতের সঙ্গে যুক্ত মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। আর্থিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকঋণের বোঝা, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা। অনেকেই লাভের আশায় চড়া সুদে এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, কিন্তু লাভতো দূরের কথা- মূলধন রক্ষা করাই এখন চ্যালেঞ্জ। এখন প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ ও কার্যকর নীতিমালা, যেন মানুষের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ মাছটি টিকিয়ে রাখা যায়।
‘আমরা টন হিসেবে খাদ্য কিনি। ২০২৩ সালে পোনা পাঙাশের খাদ্য কিনতে আমাদের প্রতি কেজিতে পাইকারি দাম পড়ত ৯০ টাকা, এখন পাইকারিভাবে ১২৮ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। খামারিরা আমাদের কাছ থেকে এই খাদ্য ১৩৬ টাকা কেজিতে কিনে মাছকে খাওয়াচ্ছেন।’
চাষিরা বলছেন, পাঙাশ মাছ উৎপাদনে ৭০-৮০ শতাংশ ব্যয় খাবারের পেছনেই যায়। পাঙাশ বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে মাছের খাদ্যের দাম কেজি প্রতি ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে চাষিদের মুনাফা মার্জিন নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। ফলে অনেক খামারি পাঙাশ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন।

জেলার ত্রিশাল উপজেলার বৈলর এলাকার পাঙাশ চাষি মো. আফজালুর রহমান। তিনি বলেন, এক বছর আগেও এক কেজি খাদ্য কিনেছি ৯০ টাকা দরে। এখন সেটা কিনতে হচ্ছে ১৩৬ টাকায়। মাছের খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলেও পাইকাররা উপযুক্ত দাম না দেওয়ায় আমাদের পোষাচ্ছে না।
আরও পড়ুন-
চুয়াডাঙ্গায় কৃষিতে বছরে ক্ষতি কোটি কোটি টাকা
নিরাপদ মাছ উৎপাদন নিশ্চিতে জাতীয় মৎস্য নীতির খসড়া
একই উপজেলার সফল মাছচাষি হিসেবে পরিচিত জয়নাল আবেদিন। তিনি বলেন, কয়েকটি পুকুরে পাঙাশ চাষ করতাম। বর্তমানে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং মাছ বিক্রির সময় পাইকার ও আড়তদারদের দিক থেকে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় পাঙাশ চাষ কমিয়ে দিয়েছি।
‘পাঙাশ মাছের দাম কম হওয়ায় অনেকে এটাকে গরিবের মাছ বলে থাকেন। দেশে সাধারণের আমিষের আধারখ্যাত পাঙাশ মাছের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকলে বাজারে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য মাছ ক্রয় কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
আজিজুল হক নামের আরেক খামারি বলেন, আগে প্রতিবছর অন্তত ২০ মেট্রিক টন পাঙাশ উৎপাদন করতাম। কিন্তু এখন চাষ কমিয়ে এনেছি। এতে খরচ উঠেছে ঠিকই, কিন্তু লাভ বলতে কিছুই নেই। পাইকাররা কারসাজি করে দাম কমিয়েছেন, যার ফলে খামারিরা দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক খামারি পাঙাশ চাষ বন্ধ করে অন্য জাতের মাছ চাষে ঝুঁকছেন। সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য খাতে ভর্তুকি, চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন।
ত্রিশালের ধানীখোলা বাজারে ১৪ বছর যাবৎ মাছের খাদ্যের ব্যবসা করেন মো. হাসান সারোয়ার সোহান। তিনি বলেন, আমরা টন হিসেবে খাদ্য কিনি। ২০২৩ সালে পোনা পাঙাশের খাদ্য কিনতে আমাদের প্রতি কেজিতে পাইকারি দাম পড়ত ৯০ টাকা, এখন পাইকারিভাবে ১২৮ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। খামারিরা আমাদের কাছ থেকে এই খাদ্য ১৩৬ টাকা কেজিতে কিনে মাছকে খাওয়াচ্ছেন। এছাড়া তুলনামূলক একটু বড় পাঙাশের খাদ্যের দাম আগে পাইকারিভাবে ৫৩ টাকা কেজিতে আমরা কিনতে পারলেও এখন পাইকারিভাবেই ৭০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে পাইকারিভাবে প্রতি কেজি খাদ্যের দাম কেজিতে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে মাছের খামারিরা বিপাকে পড়েছেন। পাঙাশ মাছ বড় হতে এক বছরের মতো সময় লাগে। অন্যদিকে তেলাপিয়া পাঁচ-ছয় মাসেই বিক্রির উপযোগী হয়ে যায়। এ কারণেও অনেকে পাঙাশ ছেড়ে তেলাপিয়া বা অন্য মাছচাষে ঝুঁকছেন।

আরও পড়ুন-
ময়মনসিংহে বিক্রি বেড়েছে নিষিদ্ধ সাকার ফিশের
ইলিশের দাম কি এ বছর আর কমবে?
ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহ্যবাহী মেছুয়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, উচ্চমূল্যের বাজারে এখনো কিছুটা হাতের নাগালে রয়েছে কেবল পাঙাশ মাছের দাম। ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে এ মাছ বিক্রি হচ্ছে। তবে এই দামেও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নিম্ন ও মধ্যম আয়ের লোকজন। তারা বলছেন, কয়েক বছর আগেও আরও কম দামে পাওয়া গেছে পাঙাশ। অথচ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই মাছের দামও হু হু করে বেড়েছে। মাছের খাদ্যের দাম কমিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে শক্তভাবে বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। তা না হলে পাঙাশ কেনা ব্যক্তিরাও একসময় চাহিদা অনুযায়ী মাছ কিনতে পারবে না।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মশিউর রহমান বলেন, পাঙাশ হচ্ছে দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের অন্যতম সস্তা প্রোটিন উৎস। পাঙাশ মাছের দাম কম হওয়ায় অনেকে এটাকে গরিবের মাছ বলে থাকেন। দেশে সাধারণের আমিষের আধার খ্যাত পাঙাশ মাছের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকলে বাজারে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য মাছ ক্রয় কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, বর্তমানে মাছের যেসব বড়ো খাদ্য কোম্পানি রয়েছে, তাদের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ইচ্ছামতো দাম বাড়ানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার যদি হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে শুধু পাঙাশ নয়, সামগ্রিকভাবে দেশীয় মৎস্য উৎপাদনে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা পাঙাশ চাষিসহ সব ধরনের মাছ চাষিদের উৎপাদন বাড়াতে পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া চাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর দিকেও কাজ চলছে।
এফএ/এএসএম

2 weeks ago
8









English (US) ·