পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, এসএমই কোম্পানির তালিকাভুক্তি, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, নতুন আর্থিক পণ্য উদ্ভাবন এবং স্টার্টআপ ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে অর্থায়নের লক্ষ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)-এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
এ বিষয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ডিএসই ও ডিসিসিআই’র পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে গুলশানে ডিসিসিআই কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং পুঁজিবাজারকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করে তুলতে ভবিষ্যতে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) পুঁজিবাজারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলমান রাখার লক্ষ্যে উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষে চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র পক্ষে সভাপতি তাসকিন আহমেদ স্মারকে সই করেছেন।
সমঝোতা স্মারক সই’র ফলে উভয় প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে গবেষণা ও উন্নয়ন, নীতি প্রস্তাবনা প্রণয়ন, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং যৌথ সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
চুক্তির আওতায় ডিএসই লিস্টিং সংক্রান্ত কারিগরি সহায়তা, নীতি সহায়তা ও প্রচারণা কার্যক্রমে সহযোগিতা প্রদান করবে। অন্যদিকে ডিসিসিআই তার সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবে, প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ সরবরাহ করবে এবং সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
সমঝোতা স্মারকের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে উভয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি যৌথ কার্যকরী কমিটি গঠন করা হবে, যা সমঝোতা স্মারকের বাস্তবায়ন, অগ্রগতি ও কার্যক্রম তদারকি করবে। কমিটি নিয়মিতভাবে বৈঠক করে যৌথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে। সব সিদ্ধান্ত পারস্পরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হবে এবং যৌথ প্রতিবেদন ও প্রকাশনায় উভয় প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
অনুষ্ঠানে ডিএসইর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আসাদুর রহমান বলেন, ডিসিসিআই’র সঙ্গে বৈঠকের ধারাবাহিকতায় এই সমঝোতা স্মারক সেই হচ্ছে, যা পুঁজিবাজার উন্নয়নে যৌথ প্রচেষ্টার নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ত করতে ডিএসই থেকে একটি ডেডিকেটেড টিম ডিসিসিআই-এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে৷ প্রাথমিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এবং উদ্যোক্তাদের তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে। এ যৌথ উদ্যোগ উভয় প্রতিষ্ঠানের জন্যই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে এবং দেশের পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, আজকের এই চুক্তি শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি যৌথ প্রতিশ্রুতি— যার মাধ্যমে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি একসঙ্গে কাজ করবে দেশের বেসরকারি খাতকে আরও গতিশীল করতে, জ্ঞান ও উদ্ভাবনের আদান-প্রদান বাড়াতে এবং যৌথ গবেষণার মাধ্যমে অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে।
তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি এখনো মূলত ব্যাংকনির্ভর, তবে পুঁজিবাজারের বিকাশে এখনই সময় একসঙ্গে কাজ করার। আমি বিশ্বাস করি-যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা একটি শক্তিশালী ও টেকসই আর্থিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারব, যেখানে বেসরকারি খাত ও পুঁজিবাজার পরস্পরকে পরিপূরক করবে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা চেম্বার দীর্ঘদিন ধরে এমএসএমই উন্নয়ন ও গবেষণায় কাজ করছে। আজকের এই সমঝোতা ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারে অর্থায়নের সুযোগ বাড়ানোর একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। আমরা জ্ঞান বিনিময়, সচেতনতা বৃদ্ধি ও গবেষণার মাধ্যমে এসএমই উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একত্রে কাজের মাধ্যমে আমরা একটি দৃঢ় ও সহনশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
ডিএসই’র চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো পর্যন্ত জাতীয় অর্থনীতির প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সংগ্রহে এখনো ব্যাংকিং খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা রয়েছে, যা ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজার— উভয়ের টেকসই উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। পুঁজিবাজারে ভারসাম্য আনতে হলে বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি জরুরি।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে হলে সরবরাহকারীকে শক্তিশালী করতে হবে। অর্থাৎ তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ও মান বৃদ্ধি, নতুন বিনিয়োগ পণ্য যেমন ডেরিভেটিভ প্রবর্তন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও সম্পদশালী বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ডিএসই একটি গ্রাহক-কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান৷ পুঁজিবাজারের উন্নয়নে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও প্রযুক্তিগত ইন্টিগ্রেশন অপরিহার্য। ডিএসই বর্তমানে একটি সমন্বিত প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে বিনিয়োগকারী, তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ইস্যু ম্যানেজার ও ফান্ড ম্যানেজার— সবাই একই প্ল্যাটফর্মে কার্যকরভাবে সংযুক্ত থাকতে পারেন।
মমিনুল ইসলাম জানান, ডিএসই এটিবি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে স্বচ্ছ ও কার্যকরভাবে শেয়ার স্থানান্তর বা লেনদেনের সুযোগ করে দিতে কাজ করবে।
ডিসিসিআই’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাজিব এইচ চৌধুরী বলেন, আমরা আজকের এই উদ্যোগকে একটি মাইলস্টোন ও স্টার্ট-আপ পর্যায়ের পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি, যা মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। আমাদের লক্ষ্য হলো তাদের পুঁজিবাজারে সহজভাবে সম্পৃক্ত করা এবং ট্রেডিংকে ইউজার-ফ্রেন্ডলি ও অনলাইনে সহজলভ্য করা।
তিনি বলেন, আমরা চাই, ব্যবহারকারীরা দ্রুত ও সহজভাবে লেনদেন করতে পারুক, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইংল্যান্ডে অ্যাপভিত্তিক ট্রেডিং হয়। এ উদ্যোগের মাধ্যমে জনসাধারণকে পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করা এবং এসএমই’র জন্য নতুন অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করা হবে। আমরা নিশ্চিত, ভবিষ্যতেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে এই উদ্যোগকে সফল করা হবে।
ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, আমাদের দেশীয় জিডিপি ও বাজার মূলধনের অনুপাত এখনও নিম্নমানের। এর কারণ হলো আমরা অনেক প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি। পুঁজিবাজার হলো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের গেটওয়ে, যা ব্যাংকিং খাত প্রদান করতে পারে না।
তিনি বলেন, আমি আশা করি, আগামী পাঁচ বছরে আমরা এমন একটি নতুন বাজার দেখতে পাবো যা গত তিন দশকে দেখা যায়নি। স্টক এক্সচেঞ্জের বিস্তীর্ণ পরিকাঠামো এবং আমাদের পরিকল্পিত সম্প্রসারণ এই সম্ভাবনাকে আরও বাস্তবায়নযোগ্য করে তুলবে।
ডিসিসিআইর পরিচালক সাঈদ মামুন কাদের বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর আগে এই স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং আজ যা দেখছি, তা সত্যিই অবাক করা পরিবর্তন। শুধু ভবন নয়, পুরো বাজারের পরিসরেই পরিবর্তন স্পষ্ট। প্রযুক্তির কারণে এখন মানুষ যে কোনো জায়গা থেকে ট্রেড করতে পারছে, তবে এই বাজার জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা গড়ে তুলতে অপরিহার্য।
ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়নের জন্য শুধু বিনিয়োগকারী নয়, বরং মানসম্মত ও ফান্ডামেন্টাল শক্তিশালী কোম্পানি থাকা অত্যন্ত জরুরি। ভালো কোম্পানি থাকলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগকারীর আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং বাজার স্থিতিশীল থাকে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা বিজিএমইএ’র সঙ্গে বৈঠক করেছি, যেখানে তারা তালিকাভুক্তির জন্য আগ্রহী টেক্সটাইল কোম্পানিগুলোর বিষয়ে মতামত প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। একইভাবে, ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিও আমাদের সহযোগিতা করতে পারে— তাদের সদস্য কোম্পানিগুলোর আর্থিক সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা সম্পর্কে মূল্যবান মতামত দিয়ে। আমাদের লক্ষ্য এমন এক বাজার গড়ে তোলা, যেখানে বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারক একসঙ্গে কাজ করবে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য।
এমএএস/এমএএইচ/এমএস

1 week ago
6









English (US) ·