ঝালের আসল উপাদান ক্যাপসাইসিন, যা পাওয়া যায় ক্যাপসিকাম গাছে। প্রকৃতি এটি এমনভাবে তৈরি করেছে, যাতে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা গাছের বীজ চিবিয়ে নষ্ট না করে। ঝাল আসলে স্বাদের বিষয় নয়। এটি সরাসরি আমাদের নার্ভ সিস্টেমে গিয়ে কাজ করে। জিহ্বা, গলা ও ত্বকের রিসেপ্টরে গিয়ে এক ধরনের জ্বালাভাব সৃষ্টি করে। শরীরকে জানায় যে — এই জিনিস খেও না, এটি বিপজ্জনক, দ্রুত ফেলে দাও! প্রশ্ন হলো, আমরা কেন এই জ্বালাভাব উপভোগ করি? এটা কি কোনো সমস্যা?
ইউসিএল-এর নিউরোসায়েন্টিস্ট লিয়াম ব্রাউন ব্যাখ্যা করেন, ‘টিআরপিভি-১ নামে আমাদের শরীরের একটি রিসেপ্টরের সঙ্গে ক্যাপসাইসিন যুক্ত হয়। এই রিসেপ্টর থাকে বিশেষ ধরনের নিউরনে, যেগুলো সাধারণত ব্যথা বা ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়।’ এই সময়ে শরীরে যেন অ্যালার্ম বেজে ওঠে, যা স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে। ফলাফল, চোখে পানি, ঘাম ঝরা, নাক দিয়ে পানি পড়া। এ সবই শরীরের একধরণের চেষ্টা, ঝাল উপাদানকে বের করে দেওয়ার।
এই টিআরপিভি-১ রিসেপ্টরের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে বা কালো মরিচের পাইপেরিন নামের উপাদানে সক্রিয় হয়, যদিও তুলনামূলকভাবে তা অনেক হালকা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সরিষা, ওসাবি ও মূলা জাগিয়ে তোলে টিআরপিএ-১ রিসেপ্টর, আর মেনথল বা ঠান্ডা অনুভূতি আসে টিআরপিএম-৮ রিসেপ্টরের মাধ্যমে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, ক্যাপসাইসিনের থেকেও হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী রাসায়নিক পদার্থ হচ্ছে রেজিনিফেরাটক্সিন, যা পাওয়া যায় ইউফোর্বিয়া রেজিনিফেরা নামের এক গাছে। এটি এত তীব্র যে, জিনিসটা সত্যিই বিপজ্জনক। তারপরও কেউ কেউ, বিশেষ করে কয়েকজন ইউটিউবার কৌতূহলবশত এটাও চেখে দেখেছেন।
বৈশ্বিক হট সস মার্কেট ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। ছবি: পেক্সেল
কেন আমরা ঝাল খেতে এত ভালোবাসি
ঝাল চোখে জল এনে দেয়, মুখ যায় জ্বলে। তবু আমরা এটা খেয়ে কেন আনন্দ পাই? আর এ নাকি মানুষের হাজার বছরের পুরোনো অভ্যাস। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ সালে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকায় প্রথম মানুষ মরিচ খেতে শুরু করে। প্রায় ১ হাজার বছর পর সেগুলোর চাষও শুরু হয়। ইউরোপে মরিচ আসে ১৬ শতকে, আর এখন এর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। ২০২২ সালে বৈশ্বিক হট সস মার্কেট ছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, যা আমাদের কাঁদায়, তা আমরা স্বেচ্ছায় খেয়েই যাচ্ছি, কেন? ঝাল লাগে, সেটা কেন আমাদের ভাল্লাগে?
জিন এবং সহনশীলতা
কিছু মানুষের টিআরপিভি-১ জিন-এর ভিন্ন ভিন্ন ধরন আছে, যা নির্ধারণ করে ঝালের প্রতিক্রিয়া কত সহজে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হবে। মজার বিষয় হলো, এই জিন পাখিদের শরীরেও আছে, কিন্তু তারা ক্যাপসাইসিনে অসংবেদনশীল। তাই তারা সহজেই ঝাল বীজ খেতে পারে!
সময়ের সঙ্গে এই রিসেপ্টরগুলো কম সংবেদনশীল হয়ে যায়, অর্থাৎ কেউ চাইলে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের শরীরকে ঝাল-সহনশীল করে তুলতে পারে।
মস্তিষ্কের শেখার প্রক্রিয়া
আমরা ঝাল পছন্দ করি সম্ভবত এর মানসিক প্রতিক্রিয়ার কারণে। নিউরোসায়েন্টিস্ট লিয়াম ব্রাউন বলেন, ‘মানব মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে শেখে কোন জিনিস নিরাপদ, কোনটা বিপজ্জনক। যখন আমরা ঝাল কিছু খাই, শরীর এক ধরনের “অ্যালার্ম সিগন্যাল” পায়, যেন গরম আগুন ছুঁয়েছি। কিন্তু কয়েকবার ঝাল খাওয়ার পর শরীর বুঝে যায়, এটা ক্ষতিকর নয়। তখন সেই বিপদের অনুভূতি বদলে যায় “নিরাপদ উত্তেজনায়”। এ কারণেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝাল সহনীয় হয়ে ওঠে, একসময় হয়ে ওঠে আনন্দদায়ক।’
বিনাইন ম্যাসোচিজম: যন্ত্রণার আনন্দ
ব্রাউন বলেন, ‘অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে আমরা যন্ত্রণাকে নতুনভাবে দেখি। যখন বুঝি এটা আমাদের ক্ষতি করবে না, তখন নিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি তৈরি হয়। পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে ঝাল খাওয়ার সামাজিক আনন্দও সেরকম।’ এই অভিজ্ঞতা অনেকটা হরর মুভি দেখা, রোলার কোস্টারে ওঠা বা ঠান্ডা পানিতে গোসল করার মতো, যেখানে ভয় বা ব্যথা মিশে থাকে নিরাপদ উত্তেজনায়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন বিনাইন ম্যাসোচিজম ‘নিরাপদ যন্ত্রণার আনন্দ’।
শরীরের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া
এই ঝাল খাওয়ার সময় শরীর এন্ডরফিন নামের সুখ-হরমোন নিঃসরণ করে, যা ব্যথার অনুভূতি কমিয়ে হালকা এক ধরনের ‘হাই’ বা আনন্দাবেশ তৈরি করে। তাই হয়তো কোরিয়ান চিকেন উইংস বা ঝাল ভর্তা খাওয়ার পর আমাদের মুখ জ্বললেও মন খুশি হয়ে যায়!
আরও পড়ুন:
আপনার সুখের পেছনে দায়ী যে রাসায়নিক
পান পাতার রসে আছে অসংখ্য স্বাস্থ্যগুণ
কর্টিসল শুধুই স্ট্রেস হরমোন নয়, জানুন আপনার শরীরের রক্ষাকবচকে
মিন্ট আইসক্রিমে থাকা চর্বি ও প্রোটিন ক্যাপসাইসিনকে দূর করে। ছবি: পেক্সেল
আচ্ছা, কেউ যদি ঝালঝাল ভর্তা খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। কিন্তু আপনি ঝাল একদম পছন্দ করেন না। কী করবেন? প্রথমেই মনে রাখা দরকার, ক্যাপসাইসিন (যা মরিচে থাকে) হলো চর্বি-দ্রবণীয় এবং হাইড্রোফোবিক, অর্থাৎ এটি পানিতে গলে না। তাই ঝাল কমানোর জন্য পানি খেলে লাভ হবে না। বরং দুধ খাওয়া সবচেয়ে কার্যকর উপায়। কারণ দুধের চর্বি ও প্রোটিন ক্যাপসাইসিনকে গলিয়ে বাঁধতে পারে এবং তা শরীর থেকে দূর করে দেয়।
অ্যালকোহল কিছুটা কাজ করতে পারে, কারণ তা ক্যাপসাইসিনকে পাতলা করে। কিন্তু এটি ক্যাপসাইসিনের সঙ্গে যুক্ত হয় না। আর ওকে কাজ করাতে হলে অ্যালকোহলের মাত্রা অনেক বেশি হতে হবে; তাই বিয়ার খেয়েও কোনো উপকার হবে না। এক্ষেত্রে দই দুধের মতোই কাজ করে, তাই ঝালের সময় এক চামচ দই খাওয়া বেশ কাজের।
তবে এর চেয়েও মজার সমাধান হচ্ছে মিন্ট আইসক্রিম! ইউসিএল-এর অধ্যাপক লিয়াম ব্রাউন বলেছেন, ‘মিন্ট আইসক্রিমে থাকা চর্বি ও প্রোটিন ক্যাপসাইসিনকে দূর করে, পাশাপাশি এতে থাকা মেনথল আমাদের টিআরপিএম-৮ রিসেপ্টরকে সক্রিয় করে, যা ঠান্ডা অনুভূতি দেয় এবং পিআরপিভি-১ রিসেপ্টরের “ঝাল ব্যথা” কমিয়ে দেয়।’
তাই কোথাও খেতে গেলে যদি ঝাল ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয়, একটা মিন্ট আইসক্রিম বা দই খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। মনে করিয়ে দিই, ঝাল খাওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু কেবল স্বাদের নয়, এক গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বটে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
আরএমডি

6 hours ago
4








English (US) ·