ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের বিস্ময়কর ভ্রমণ শুরু হয়েছিল আমাদের ওয়েস্ট পয়েন্ট আইল্যান্ডে নামার মাধ্যমে। সমুদ্রযাত্রার ক্লান্তি কাটিয়ে যখন আমরা ছোট নৌকায় ভেসে দ্বীপের তীরে পৌঁছলাম; তখন থেকেই মনে হয়েছিল যেন পৃথিবীর একান্ত কোণে লুকানো কোনো রূপকথার দেশে প্রবেশ করেছি। এই দ্বীপে পা রাখার মুহূর্ত থেকেই আমাদের চোখে ধরা দিলো অসংখ্য হলুদ রঙের ফুল, যেগুলো বাতাসে দুলে যেন অতিথিদের আগমনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। সমুদ্রের নীল জলরাশি, পাহাড়ের মাথায় সবুজ ঘাস আর তার মাঝখানে রঙিন ফুলের সমারোহ এক অনন্য আবহ তৈরি করেছিল। শহরের ভিড় আর যান্ত্রিক কোলাহল থেকে বহু দূরে দাঁড়িয়ে এই দ্বীপ যেন প্রকৃতির অমলিন শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
দ্বীপে নামার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর পাখি ব্ল্যাক ব্রাউড অ্যালব্যাট্রস দেখা। পাখিগুলোকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই এক অন্যরকম অনুভূতি। বিশাল ডানাওয়ালা অ্যালব্যাট্রস পৃথিবীর দীর্ঘতম ডানার অধিকারী পাখিদের অন্যতম। পাহাড়ের পাথুরে খাজে তারা নিজেদের বাসা তৈরি করে এবং সেখানে ডিম ফোটায়। আমরা যখন পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে তাদের কলোনির দিকে এগোলাম; তখন দূর থেকে তাদের উড়ান চোখে পড়ল। আকাশের গাঢ় নীল ক্যানভাসে তারা যেন সাদা-কালো তুলি দিয়ে আঁকা রেখার মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। ডানা মেলে যখন তারা আকাশে উড়ছিল, তা ছিল মহিমান্বিত এক দৃশ্য আর যখন তারা নির্ভুল ভঙ্গিতে বাসায় ফিরে আসছিল; তখন মনে হচ্ছিল যেন প্রকৃতির নিজস্ব কোনো আচার অনুষ্ঠান চলছে আমাদের চোখের সামনে।
অ্যালব্যাট্রসদের কলোনিতে দাঁড়িয়ে একদিকে যেমন আমরা তাদের পারিবারিক জীবন প্রত্যক্ষ করেছি, অন্যদিকে প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সংগ্রামী সম্পর্কও অনুভব করেছি। বাবা-মা অ্যালব্যাট্রস পালাক্রমে খাবারের জন্য সমুদ্রের দিকে যায় এবং ফিরে এসে ছানাদের খাওয়ায়। এই যাত্রা কখনো কখনো শত শত কিলোমিটার দীর্ঘ হয়। তবুও তারা নির্ভুলভাবে নিজেদের বাসায় ফিরে আসে, যা তাদের অসাধারণ দিকনির্দেশনা ক্ষমতার প্রমাণ বহন করে। তাদের চোখেমুখে এবং চলাফেরায় যে মমতা ও দৃঢ়তা আমরা দেখেছি, তা হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে গেছে।

অ্যালব্যাট্রসের বাসাগুলোর পাশে ছিল রকহপার পেঙ্গুইনের কলোনি। এই পেঙ্গুইনগুলো দেখতে ছোট ও মজার, কিন্তু তাদের জীবনযাপন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। মাথার ওপরের হলুদ রঙের কেশরের মতো পালক তাদের আলাদা করে চেনার মতো বৈশিষ্ট্য। পাথুরে পাহাড়ের মাথায় তাদের বাসা তৈরি এবং প্রতিদিন সমুদ্র থেকে খাদ্য এনে ছানাদের খাওয়ানো তাদের জন্য সহজ কাজ নয়। ক্ষুদে ছানাদের জন্য এই খাড়া পাহাড়ে ওঠানামা করতে গিয়ে তাদের যে কষ্ট সহ্য করতে হয়, তা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনা, তা ঠোঁটে করে বাসায় পৌঁছে দেওয়া এবং ছানাদের খাওয়ানো সবকিছুই প্রকৃতির এক বিরামহীন সংগ্রামের গল্প। আমরা অনেক ছোট ছোট ছানাকে দেখেছি; যারা তখনো মায়ের উষ্ণ পালকের নিচে লুকিয়ে বসে আছে। মা বা বাবা পেঙ্গুইন যখন খাদ্য নিয়ে ফিরে আসে; তখন তারা অস্থির হয়ে ওঠে, ছোট ছোট ডাক দিয়ে খাবারের জন্য ব্যাকুল হয়। এ দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল পিতা-মাতার দায়িত্ববোধ কেবল মানুষের নয়, প্রাণীকুলেরও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
অ্যালব্যাট্রস আর রকহপার পেঙ্গুইনকে একই জায়গায় পাশাপাশি বাস করতে দেখে মনে হয়েছিল যেন প্রকৃতি এখানে এক চমৎকার সহাবস্থানের পাঠ শিখিয়েছে। আকাশে উড়ছে অ্যালব্যাট্রস, মাটিতে হাঁটছে পেঙ্গুইন এই বৈপরীত্যই একসঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছে অনন্য দৃশ্যপট। আমরা দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখেছি, ছবি তুলেছি, আবার মাঝে মাঝে কেবল নীরব হয়ে বসে থেকেছি। মনে হচ্ছিল শব্দ দিয়ে নয়, কেবল হৃদয়ের ভেতরের গভীর অনুভূতিই যথেষ্ট এই সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার জন্য।
আরও পড়ুন
উগান্ডার স্মৃতি: আবেগঘন ভ্রমণকাহিনি
জিঞ্জা শহর: নীল নদের উৎসের সন্ধান
ওয়েস্ট পয়েন্ট আইল্যান্ডে পৌঁছাতে আমাদের অন্তত এক ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে। নৌকা থেকে নামার পর সমুদ্রপারের সবুজাভ প্রান্তর, ফুলে ভরা মাঠ আর পাহাড়ি পথ ধরে ধীরে ধীরে আমরা অ্যালব্যাট্রস আর পেঙ্গুইনের কলোনির দিকে এগিয়েছি। অনেক পর্যটক, বিশেষ করে যারা বয়স্ক ছিলেন; তারা জিপ গাড়িতে করে সেখানে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু আমরা হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া পছন্দ করেছি, কারণ এতে দ্বীপের প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে উপভোগ করার সুযোগ মিলেছে। হাঁটার পথে বাতাসের ঠান্ডা ছোঁয়া, সমুদ্রের গর্জন আর মাঝে মাঝে দূরের পাখির ডাক আমাদের মনকে আরও প্রফুল্ল করেছে।

ফেরার পথে আমরা ফকল্যান্ডের আরও কিছু প্রজাতির রাজহাঁস দেখতে পেলাম। সবুজ ঘাসের ওপর তারা তাদের ছানাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ছোট ছোট ছানাগুলো মায়ের পেছনে হেঁটে চলছিল, মাঝে মাঝে থেমে ঘাস ঠোকরাচ্ছিল। মা রাজহাঁস সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশ দেখছিল, যেন কোনো বিপদ থেকে ছানাদের রক্ষা করতে পারে। এ দৃশ্য দেখে আমাদের মনে হলো, প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণীই তার সন্তানের জন্য এক অদ্ভুত ভালোবাসা আর ত্যাগের প্রতীক।
দ্বীপে মানুষের বসবাস বলতে কেবল একটি পরিবার। এত বিস্তৃত প্রকৃতির মাঝেও তাদের উপস্থিতি অবাক করার মতো। তারা পর্যটকদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। আমরা যখন ফিরে আসছিলাম; তখন সেই পরিবার আমাদের জন্য কফি ও নাস্তার আয়োজন করেছিল। অচেনা দ্বীপে, দূর সমুদ্রে এসে এমন আন্তরিক আপ্যায়ন পেয়ে আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। মানুষের এই সরল আতিথেয়তা প্রকৃতির মহিমার সঙ্গে মিলে আরও এক অনন্য অভিজ্ঞতা যোগ করেছিল আমাদের ভ্রমণে।

ওয়েস্ট পয়েন্ট আইল্যান্ডে কাটানো সময় যেন এক জীবন্ত কাব্য। এখানে আমরা কেবল অ্যালব্যাট্রস বা পেঙ্গুইনই দেখিনি, দেখেছি সংগ্রাম, ভালোবাসা, সহাবস্থান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য মেলবন্ধন। দ্বীপ থেকে দক্ষিণ মহাসাগরের দিকে ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, ভ্রমণের প্রথমদিনেই আমরা যেন পৃথিবীর এক মহামূল্যবান অধ্যায়কে ছুঁয়ে দেখলাম। এই দ্বীপে প্রকৃতি যেন আমাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে, যার ভেতর দিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের বর্ণময় রহস্যের জগতে।
প্রকৃতির এমন অভূতপূর্ব সৌন্দর্য আর প্রাণীকুলের এমন বৈচিত্র্য আমাদের মনে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। ওয়েস্ট পয়েন্ট আইল্যান্ডে আমাদের প্রথম ল্যান্ডিং তাই শুধুই ভ্রমণ ছিল না, ছিল প্রকৃতিকে নতুনভাবে চেনার একটি অংশ।
এসইউ/এএসএম

 1 day ago
                        8
                        1 day ago
                        8
                    








 English (US)  ·
                        English (US)  ·