জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও তরুণ প্রজন্মকে নিকোটিন আসক্তি থেকে রক্ষায় সরকার ই-সিগারেট ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএনডিএস) আমদানি ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। এরপরও বিদেশি বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ লিমিটেডকে নারায়ণগঞ্জে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।
তাদের অভিযোগ, এই অনুমোদন সরকারের ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকারের পরিপন্থি।
সরকারি নথি অনুযায়ী, গত এপ্রিলে ফিলিপ মরিস বাংলাদেশকে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয় বেজা। প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ৫৮ দশমিক ২ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে এবং বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৩৬৩ লাখ ইউনিট।
গত ১৮ মে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক ড. আহমেদ উল্লাহ স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় বলা হয়, ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএএন্ডস) যন্ত্র সংশ্লিষ্ট পণ্য উৎপাদন বন্ধ ও এ সংক্রান্ত কোনরূপ অনুমতি না দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা। আর গত জানুয়ারিতে ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএনডিএস) সংশ্লিষ্ট সব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বেজা জানায়, দেশে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন বা রপ্তানির ওপর সুনির্দিষ্ট কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী, কোম্পানিটিকে এক বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে হবে। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি এরইমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে পরিবেশগত ছাড়পত্রের আবেদন করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিকোটিন পাউচ আসক্তিকর এবং এটি তরুণদের মধ্যে নতুন করে নিকোটিন নির্ভরতা তৈরি করবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, নিকোটিন পাউচ তামাকের চেয়ে আরও বেশি ঝুকিঁপূর্ণ। মানুষ মনে করবে এটায় ক্ষতি হয় কম; তারা বেশি বেশি নেবে, ফলে বেশি ক্ষতি হবে। কেউ যদি সিগারেট ছেড়ে জর্দা চিবিয়ে খায় তাহলে ক্ষতিটা বেশি হবে। মুখসহ নানা অঙ্গে ক্যানসার হয়। পাউচে ক্ষতিটা বেশি হবে।
একদিকে ই-নিকোটিন জাতীয় পণ্য উৎপাদন নিষিদ্ধে ব্যবস্থ্যা ও আরেকদিকে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনে অনুমোদনকে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা সাংঘর্ষিক। টপ টু বটম তামাক ব্যান করা উচিৎ। প্রথমে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। আমাদের মাটি ব্যবহার করে তামাক চাষ হবে সেটা সারা দুনিয়ার যাবে; অনেক দেশ যারা তামাক পণ্য ভোগ করে কিন্তু তারা উৎপাদন করে না। আমাদের মাটিতে ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদন করছে; এ কেমন কথা?
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, নিকোটিন পাউচ তরুণদের মধ্যে আসক্তি তৈরি করবে। শুরুতে এটি ক্ষতিকর নয় মনে হলেও, পরবর্তীতে নিকোটিনের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করবে। যা থেকে ধূমপানের অভ্যাস গড়ে ওঠে।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) এবং মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) জানায়, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সরকারের ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যৌথ ঘোষণায় সই করেছে। প্রধান উপদেষ্টা সুস্থ-সবল প্রজন্ম গড়তে তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। সেখানে বেজা কর্তৃক তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনের সুযোগ দেওয়া জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য একটি প্রাণঘাতী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ অ্যান্টি-টোব্যাকো অ্যালায়েন্স এক বিবৃতিতে বলেছে, দেশের জগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকার যেখানে তামাক নিয়ন্ত্রণে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের প্রমাণ রেখে চলেছে ঠিক সেখানে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা) নতুন নেশাপণ্য নিকোটিন পাউচ তৈরির কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। যা দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি করছে। নিকোটিন পাউচ তৈরির নতুন এই কারখানা স্থাপনের অনুমতি সংবিধান, আপিল বিভাগের রায় এবং সরকারের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে প্রচেষ্টার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর (বিইআর) প্রকল্প পরিচালক হামিদুল ইসলাম হিল্লোল জাগো নিউজকে বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মূল্য ও করহার বাড়ানোর উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। এখন নতুন তামাকজাত পণ্য বাজারে আনা হচ্ছে; এটা সরকারের তামাকবিরোধী পদক্ষেপের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
- নিকোটিন পাউচ কী?
ইন্টারনেট থেকে জানা যায়, নিকোটিন পাউচ হলো ছোট, তামাকমুক্ত প্যাকেট যা নিকোটিন, স্বাদ এবং মিষ্টির মতো উপাদান ধারণ করে। ব্যবহারকারীরা এটি ঠোঁট এবং মাড়ির মধ্যে রাখে। যেখানে নিকোটিন মুখের শ্লেষ্মার মাধ্যমে রক্তপ্রবাহে শোষিত হয়।
এ ধরণের পাউচ ধূমপান বা তামাক চিবানোর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে নিকোটিন থাকায় এটি আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং দাঁত ও মাড়ির ক্ষতি করতে পারে। ২০১৬ সাল থেকে সুইডেনে এবং ২০১৪ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিকোটিন পাউচের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
বর্তমানে, এটি তামাকের ধোঁয়া ছাড়া নিকোটিনের একটি বিকল্প হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিকোটিন পাউচকে তামাকজাত পণ্য হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, এটি সিগারেটের তুলনায় কিছুটা কম ক্ষতিকর হতে পারে, তবে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয়।
অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনো নিকোটিন পাউচকে নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এনআরটি) হিসেবে অনুমোদন দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি সতর্ক করেছে, নিকোটিন অত্যন্ত আসক্তিকর এবং এটি বিশেষ করে তরুণ ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যান। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাকজনিত রোগে চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হ্রাসজনিত ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যেখানে সরকার একই সময়ে তামাক খাত থেকে রাজস্ব পেয়েছিল ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
এসএম/এএমএ/জিকেএস

10 hours ago
6









English (US) ·