বই পড়িয়ে আলো ছড়াচ্ছেন জামাল হোসেন

14 hours ago 5

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার টিপের বাজারের তরুণ জামাল হোসেন। জীবনের সামান্য ভুল থেকে পাওয়া শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর অসামান্য উদ্যোগ নিয়েছেন। তার হাতে গড়া ‘সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার’ আজ শুধু বইপড়ার কেন্দ্র নয়, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ, বিশেষ করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আশা-ভরসার ঠিকানা। তার অনন্য কর্মযজ্ঞ দেশ-বিদেশের ১৭টি স্বীকৃতি অর্জন করেছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের হাত থেকেও নিয়েছেন সম্মাননা।

২০১৩ সালের শেষদিকে ঢাকায় একটি কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন জামাল হোসেন। লালমনিরহাটে প্রথম স্থান অধিকারী হয়ে রংপুর বিভাগের পাঁচজনের সাথে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছান। তবে আঞ্চলিক ভাষার কারণে প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়েন। বিচারকের পরামর্শ ছিল, একটি বিশেষ বই কিনে পড়তে, যা তাকে শুদ্ধ উচ্চারণে সাহায্য করবে। কিন্তু এলাকার কোনো পাঠাগারে বইটি খুঁজে পাননি। কিন্তু হতাশ না হয়ে নিজেই একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

২০১৪ সালে মাত্র ৭৫০ টাকা পুঁজি নিয়ে বন্ধুদের সহযোগিতায় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের টিপার বাজার এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার’। এই সামান্য পুঁজি এসেছিল একটি মাটির ব্যাংকে জমানো খুচরো টাকা থেকে।

বই পড়িয়ে আলো ছড়াচ্ছেন জামাল হোসেন

পাঠাগার প্রতিষ্ঠার শুরুতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে। প্রান্তিক মানুষজন এ উদ্যোগের গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। তবে জামাল দমে যাননি। ২০১৬ সালে লক্ষ্য করেন, এলাকার সেলুনগুলোয় চুল কাটার অপেক্ষায় থাকা মানুষ অলস সময় নষ্ট করেন। তখনই তিনি অভিনব উদ্যোগ নেন ‘সেলুন লাইব্রেরি’র। সেলুনগুলোয় বিনা মূল্যে বই দিয়ে আসার এই ধারণা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অলস সময় নষ্টকারীরা বই পড়তে মনোযোগী হন। তার এ গল্প শুধু জেলা বা দেশেই নয়, বিদেশেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। যা পরে দেশের ৬৪ জেলায় সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সেলুন লাইব্রেরি স্থাপনের অনুপ্রেরণা জোগায়।

জামাল হোসেনের মানবিক কাজের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে তার কাজ। তিনি শুধু তাদের বিপদে-আপদে ছুটে যান না। তাদের পড়াশোনা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ করে দেন। কর্মমুখী ব্যবস্থা তৈরি করেন। বর্তমানে তার পাঠাগারে ১ হাজার দুইশর মতো ছাত্র-ছাত্রী এবং ৫২ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন
বই যেভাবে আসে পাঠকের হাতে
যুবসমাজকে বইমুখী করতে প্যাপিরাস পাঠাগারের যাত্রা শুরু

তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য মোহনা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষ বলে হিজড়া মানেই চাঁদাবাজি। জামাল ভাই আমাদের কাছে টেনে নিয়েছেন। পড়ালেখা করান, গান-বাজনা করান এবং কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা এলে আমাদের নিয়ে দেন। একদিন আমরাও মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে পারবো।’

বই পড়িয়ে আলো ছড়াচ্ছেন জামাল হোসেন

জামাল হোসেনের নিঃস্বার্থ সমাজসেবা এনে দিয়েছে দেশ-বিদেশের ১৭টি সম্মাননা। উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো হলো—ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের হাত থেকে এ পুরস্কার নেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গ্লোবাল হেলথ ইমপ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড, স্বপ্নযাত্রা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড, টিআইবি অ্যাওয়ার্ড, রবীন্দ্র নজরুল সাহিত্য পুরস্কার, ভলান্টিয়ার সার্ভিস ওভারসিজ পুরস্কার এবং কবি অসীম সাহা সম্মাননা লাভ করেন। এমনকি ব্র্যাক ও আরডিআরএস থেকে সামাজিক কাজের জন্য পুরস্কার পান এবং ২০২১ সালের ১৩ মার্চ তার পাঠাগার জাতিসংঘ থেকে আসা একটি দল ভিজিট করে।

ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী জামাল হোসেন বলেন, ‘শুরুটা কঠিন ছিল। নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে। তবুও থেমে থাকিনি। গাছ লাগানো, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, মাদক নির্মূল, সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা আমার সামাজিক কাজের অংশ। আমি চাই বাংলাদেশে কোনো মানুষই যেন পিছিয়ে না পড়ে। সবাই যেন সমতার কাতারে এসে নিজেকে তুলে ধরতে পারে।’

বই পড়িয়ে আলো ছড়াচ্ছেন জামাল হোসেন

পাঠাগারের শিক্ষার্থী তিশা রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘জামাল ভাইয়ের হাত ধরেই প্রথম সংগীত শেখার সুযোগ পাই। এখন আমি বিভিন্ন জায়গায় গান পরিবেশন করি। শুধু বই নয়; সংস্কৃতিতেও তিনি আমাদের পথ দেখিয়েছেন।’

জামালের মা শাহের বানু জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষ নানা কথা বলতো কিন্তু আমি ওর পাশে থেকেছি। নিজের সেলাই মেশিন চালিয়ে ছেলেকে টাকা দিতাম। যেন সে মানুষের জন্য কাজ করতে পারে। যখন দেখি আমার ছেলে ড. ইউনূসের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে; তখন গর্বে বুক ভরে যায়।’

এসইউ/এমএস

Read Entire Article