মোমিন মেহেদী
ছাত্র-জনতার জ্ঞান অন্বেষণের প্রধানতম মুগ্ধমেলা অমর একুশে বইমেলা। এই বইমেলা যখন আটকে যায় অন্ধকারের হাতছানিতে; তখন লেখকের কলম নির্ভীক হয়ে ওঠে বরাবরের মতো। সেই লেখনী নিরন্তর চলবে। গর্জে উঠবে সচেতন লেখকদের কলম। যখন বইমেলার মতো বিষয় নিয়ে নানা ধরনের সিদ্ধান্ত আসছে; তখন নীতিগতভাবে দোদুল্যমান অবস্থায় কলম ধরাই উচিত।
সাহিত্য-সংস্কৃতির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখেছি, বইমেলা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর জ্ঞানচর্চার প্রতীক। যদি দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে ভাবি, তবে বলতে পারি—যারা লেখক তারা বইমেলার মাসটি বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। সেই বইমেলা যখন আটকে গেছে; তখন স্মৃতিতে ভাসতে থাকে বইমেলার প্রতিটি স্টলে থাকে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ।
লেখকের চারপাশে থাকে অটোগ্রাফ শিকারিরা। কিছু কিছু স্টলের সামনে থাকে পাঠকের সারি। যারা তরুণ লেখক, তাদের বইমেলার সময় মনের ভেতর কী অবস্থা থাকে, তা সেই তরুণ লেখক ছাড়া আর কে বোঝেন? কেউ যদি অটোগ্রাফের জন্য তার দিকে বইটি বাড়িয়ে দেন; তখন তরুণ লেখকের অনুভূতি হয় শূন্যে উড়ে যাওয়ার মতো। শুধু তরুণ লেখকদের বই নিয়েই বুকের ভেতর তোলপাড় হয়, তা কিন্তু নয়। যারা অনেক দিন ধরে লিখছেন; তাদেরও বই নিয়ে ভালো লাগা ও চিন্তা কাজ করে।
একজন লেখক, পাঠক বা সচেতন নাগরিক হিসেবে বরাবরই আমি বইমেলার পক্ষে। বইয়ের পক্ষে। লেখালেখির পক্ষে। তাই যখন শুনি, ‘আমাদের দেশে যত বই বের হয়; পাঠক তত নেই।’ তখন মনে হয়, এ কথা যারা বলেন, তারা মূলত নিজেরাই নিজেদের অজান্তে পাঠক ও লেখকবিরোধী হয়ে উঠছেন। তবে এ কথা সত্য, পাঠকের চেয়ে কয়েকজন লেখকের ভক্ত তৈরি হয়। লেখকের উপস্থিতিতে পাঠক বই কিনতে চান। হয়তো অটোগ্রাফের আশায়। সব লেখকের নির্দিষ্ট কয়েকজন পাঠক তো থাকেই। সেই সঙ্গে বইমেলায় তৈরি হয় নতুন নতুন পাঠক।
সেই বইমেলা আটকে আছে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায়। এমন পরিস্থিতিতে তরুণ লেখকদের একটি অংশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে অনানুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানালেও কোনো গতি হয়নি ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা করার বিষয়ে। তবে বরাবরের মতো আমি মনে করি, মহান একুশে বইমেলাকে কোনো টানাহেঁচড়া না করে ফেব্রুয়ারিতেই রাখা হবে বুদ্ধিদ্বীপ্ততার উদাহরণ। সেই উদাহরণ দিতে ব্যর্থ হলে টানাপোড়েন শুরু হবে সচেতন নাগরিকদের মাঝে।
ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা হওয়ায় পাওয়া যায় মহান ভাষা দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস। সেদিন প্রায় সবাই তার প্রিয় মানুষকে পছন্দের বইটি কিনে দেন। এতে ভালোবাসার সঙ্গে যুক্ত হয় চমৎকার একটি অভ্যাস। তা হলো, বই কেনা ও উপহার দেওয়া। অনেকের মতো আমারও বইমেলাকে কেন্দ্র করে লিখতে গেলে বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। কারণ বইমেলায় আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেকেরই সোনালি অতীত। যারা ভালোবাসতেন কেবল বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে। বারো মাসই চলতো তাদের লেখালেখি আর পড়াশোনা।
আরও পড়ুন
আনন্দধারা: রাকিবের অনুপম বই-বাড়ি
সিলেটের নীলক্ষেত: রাজা ম্যানশন যেন বইয়ের খনি
সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের লেখালেখি-কর্মব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। লিখতেন একের পর এক বই। প্রুফ রিডিং হয়ে আসার পর আবার সেটি চেক করতেন। প্রচ্ছদের বিষয়ে খুব বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন অনেকেই। প্রচ্ছদশিল্পীর সঙ্গে বারবার আলোচনা করে ফাইনাল প্রচ্ছদ দাঁড় করাতেন প্রিয় মানুষেরা। আমি সেই বরেণ্যদের অনেকেরই স্নেহাচার্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছি বইমেলাকে কেন্দ্র করেই। তা-ও আবার শীতঘেঁষা বইমেলা—ফেব্রুয়ারির মহান একুশে বইমেলায়।
বইমেলার কথা শুনলেই আমাদের চোখের পাতায় ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমির বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে লাখো মানুষকে টেনে আনে একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে। বর্ধমান হাউজ, একাডেমি প্রাঙ্গণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে জমে ওঠা লেখক-পাঠকের অঘোষিত সম্মিলন, জমজমাট আড্ডা ফিরিয়ে আনতে কেউ এগিয়ে না এলেও আমরা আসবো—আমরা বলবো বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে বাস্তবায়নের পক্ষে।
অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে শুরু। বইপ্রেমী, লেখকপ্রেমী, পাঠকপ্রেমী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলা শুরু করেন। ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের বই। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলা উপলক্ষে ১৫-২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি মুক্তধারা, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং তাদের দেখাদেখি কেউ কেউ বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন।
সেই যে জাতির জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিমগ্ন চেষ্টায় পথচলা শুরু হলো; ২০২৪ সালের ফেব্রুযারি পর্যন্ত তা যথাযথভাবে চললেও মাত্র ১ বছরের মাথায় এমন সিদ্ধান্ত আমাকেই কেবল ব্যথিত করেনি, আমি বিশ্বাস করি—সব সচেতন নাগরিককে ব্যথিত করেছে। সব ব্যথার উপশম ঘটাতে নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই বইমেলা বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। আমি মনে করি, সেই বইমেলায় আরও দৃঢ় উদ্যোগে গড়া হবে বইবন্ধন। কেননা একুশে বইমেলা নিছক কোনো বইমেলা নয়; আমাদের এগিয়ে চলার স্মারক।
কোনো ভাবেই বইমেলাকে যেন ফেব্রুয়ারি থেকে সরিয়ে অন্য কোনো মাসে স্থানান্তর করা না হয়। বইমেলাকে বন্ধ রাখার পক্ষে অনেকেই সাফাই গাইছেন। আমি মনে করি, কোনো কিছুই কোনো প্রভাব ফেলবে না ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। মহান একুশে বইমেলাকে ফেব্রুয়ারিতেই রাখুন।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পূর্বাভাস।
এসইউ/জিকেএস

10 hours ago
4









English (US) ·