সাগর-নদী ও সুন্দরবনে মাছ ধরায় একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন উপকূলের জেলেরা। প্রায় সারা বছর ধরেই মৌসুমভিত্তিক থাকছে কোনো না কোনো নিষেধাজ্ঞা। এতসব অবরোধের মধ্যে মাছ শিকারের তেমন একটা সুযোগ নেই জেলেদের। বংশ পরম্পরায় এ পেশায় টিকে থাকতে ধার-দেনা করে জেলেরা জাল ও নৌকা তৈরি করলেও সেই ধার আর মেটে না তাদের। ঋণের বোঝা যেমনি বাড়ছে তেমনি সঙ্গ ছাড়ছে না অভাব-অনটন।
জাটকা ইলিশ সংরক্ষণে শনিবার (১ নভেম্বর) থেকে সাগর ও সুন্দরবনের নদ-নদীতে শুরু হয়েছে টানা ৮ মাসের অভিযান। এ অভিযান চলাকালে কোনো জেলে জাটকা আহরণ করতে পারবেন না। তবে জাটকার জাল ব্যবহার ছাড়া অন্যান্য জাল দিয়ে অপর প্রজাতির মাছ আহরণ করতে পারবেন তারা।
মোংলা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে ১৫ দিন ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫ দিন চালানো হয় বিশেষ কম্বিং অপারেশন। সকল প্রকার অবৈধ জাল নির্মূলে এ অপারেশন চালানো হয় নদ-নদীতে। তবে অবৈধ জাল ছাড়া অন্য জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারেন জেলেরা। অবৈধ জালের অভিযান চলাকালে কোনো সহায়তা পান না জেলেরা।

এছাড়া প্রতি বছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন বন্ধ থাকে সমুদ্রে মাছ আহরণ। এ ৫৮ দিন সমুদ্রে সকল প্রজাতির মাছের প্রজনন মৌসুম। এ মৌসুমে কোনো জেলেই কোনো প্রজাতির মাছ শিকার করতে পারেন না সাগরে। এ সময়টাতে কার্ডধারী জেলেদের প্রত্যেককে ৭০ কেজি করে চাল সহায়তা দেওয়া হয়। মূলত ডিম দেওয়ার এ সময়টাতে যাতে জেলেরা মাছ শিকার থেকে বিরত থাকে সেজন্য চাল সহায়তা দিয়ে থাকে মৎস্য বিভাগ।
আরও পড়ুন-
নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে জেলেরা, মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ
নিষেধাজ্ঞা শেষে ঋণের বোঝা মাথায় নদীতে জেলেরা
পচা ইলিশে সয়লাব চাঁদপুর মাছঘাট
আর প্রতি বছর অক্টোবর মাসে ২২ দিন অবরোধ থাকে সাগর ও নদীতে। এই ২২ দিন মা ইলিশ সংরক্ষণে অভিযান চালানো হয়ে থাকে। এই ২২ দিন সাগর-নদীতে সকল প্রকার জাল ফেলা ও মাছ ধরা বন্ধ থাকে জেলেদের। এসময়ও জেলেরা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকায় কার্ডধারী জেলেদের প্রত্যেককে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়।
এসব অবরোধ ছাড়াও প্রতি বছর ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। এ সময়টাতে জাটকা ইলিশ সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। নিষেধাজ্ঞার এ লম্বা সময়ে কার্ডধারী জেলেরা দুই ধাপে চাল সহায়তা পেয়ে থাকেন। প্রথম দপায় ৮০ কেজি আর দ্বিতীয় দফায় ৮০ কেজি করে চাল পান জেলেরা। তবে এ সময়টাতে জাটকা বাদে অন্যান্য মাছ ধরতে পারে জেলেরা।

স্থানীয় জেলে জাহিদ ব্যাপারী, চয়ন বিশ্বাস ও সিরাজ শিকদার বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও নদীতে নৌকা ও জাল-দড়ি বেয়েছে। আমরাও তাই করছি। কিন্তু এখনতো নদীতে আগের মতো মাছ নেই। তাই খোরাকীতো দূরে থাক, জাল-নৌকা বানানোর টাকাই ওঠে না। আর বন্ধের সময় যে চাল সহায়তা পাই, তা দিয়ে আমাদের চলে না। খুব কষ্ট হয়।
জেলে মো. কামাল হোসেন ও ওহিদুল শেখ বলেন, আমরা আর কত বছর মাছ ধরলে জেলে কার্ড পাবো। ২৫-৩০ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরি, কিন্তু আজ পর্যন্ত জেলে কার্ড পাইনি। যাদের কার্ড আছে তারাতো কিছু হলেও সাহায্য-সহযোগিতা পায়, আমরাতো কিছুই পাই না। আমাদের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানোর মতো টাকা আয় করতে পারি না। তারাও নদীতে জাল ফেলে।
জেলে আ. রশিদ ও ইস্রাফিল বয়াতী বলেন, সারা বছর ধরেই ধাপে ধাপে সাগর-নদীতে নিষেধাজ্ঞা থাকে। নিষেধাজ্ঞার সময় আমাদের ঘরে বেকার বসে থাকতে হয়। নদীতে নামলে অভিযানে জাল-নৌকা নিয়ে যায়। আমরাতো ছোটবেলা থেকেই এ পেশায় জড়িত, অন্যকিছু করতেও পারি না। সরকার যদি আমাদের বিকল্প কর্মের ব্যবস্থা করতো, তাহলে খেয়ে পরে অন্তত বেঁচে থাকতে পারতাম।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা শাখার সভাপতি বিদ্যুৎ মন্ডল বলেন, এ এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার জেলে রয়েছে। যাদের মধ্যে ১৫ হাজার জেলে নিবন্ধিত হওয়ার যোগ্য। কিন্তু এখানে নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৬ হাজারের একটু বেশি। বাকিরা আবেদন দিয়েই যাচ্ছে, কিন্তু কার্ড পাচ্ছে না। আর যাদের কার্ড আছে তাদের অনেকেই আবার জেলে না। তাই প্রকৃত জেলেরা যাতে কার্ড পায় সেই দাবি জানাই মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে। এছাড়া যারা কার্ডধারী রয়েছে তারা সবাই কিন্তু সহায়তা পান না। আর যে সহায়তা পান তা দিয়ে তাদের চলেও না। তাই সহায়তার পরিমাণও বাড়ানো খুব প্রয়োজন। সেইসঙ্গে অনিবন্ধিত জেলেদেরকেও দ্রুত নিবন্ধনের আওতায় আনা উচিত। অবশ্য এ বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের কঠোর তদারকি প্রয়োজন।
এছাড়া সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও মাছের প্রজননের জন্য টানা তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা থাকে বনবিভাগের। প্রতি বছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলে এ নিষেধাজ্ঞা। যদিও এ সময়টাতে কোনো ধরনের সহায়তাই পান না জেলেরা।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, মোংলায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৬৩৯৮ জন। আরও আবেদন যাচাই-বাছাই চলছে। মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া নিষেধাজ্ঞাকালে জেলেদের চাল সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে বনবিভাগের যে নিষেধাজ্ঞা থাকে সেসময় জেলেদের কোনো কিছু দেওয়া হয় না। তবে বনবিভাগ এবার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছে তাদের নিষেধাজ্ঞাকালীন ভুক্তভোগীদের কিছু সহায়তা করার। আশা করা যাচ্ছে আগামী বছর থেকে জেলেরা বনবিভাগের কাছ থেকে কিছু সহায়তা পাবেন।
এফএ/এমএস

16 hours ago
4









English (US) ·