বাবা টাকা পাঠানোর পর সালাম নিও!

2 weeks ago 8

মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে পরিবারকে বলা হয় নৈতিকতার প্রথম বিদ্যালয়। বাবা-মা সন্তানের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে বাবা-মায়ের মমতা, ত্যাগ ও দিকনির্দেশনাই নির্ধারণ করে তার ভবিষ্যৎ। অথচ আজ আমরা এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি। আধুনিকতার অন্ধ প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিনির্ভরতা ও অর্থকেন্দ্রিক জীবনের প্রভাবে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কেও আসছে অদ্ভুত পরিবর্তন। এরই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় একটি সাধারণ কিন্তু হৃদয়বিদারক বাক্যে যদি হল বা হোস্টেল থেকে কারো সন্তান চিঠি বা ই-মেইলে লিখে— বাবা টাকা পাঠানোর পর সালাম নিও!

হঠাৎ এই বাক্যটি শুনলে যে কারো কাছে শুধু হাস্যরস মনে হবে। কিন্তু এটি আমাদের সমাজের জন্য এক ভয়ংকর সংকেত। এখানে লুকিয়ে আছে সন্তানের নৈতিক অবক্ষয়, দায়িত্ববোধহীনতা, স্বার্থপরতা এবং পারিবারিক সম্পর্কের অবমাননা। যেখানে বাবা-মা অর্থনৈতিক সহায়তার উৎসে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন, আর সন্তান আবেগ-অনুভূতি ভুলে কেবল টাকার সাথে সম্পর্ক মাপতে শুরু করে।

মানুষের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় হঠাৎ করে তৈরি হয় না। এর পেছনে সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত অনেক কারণ রয়েছে। আজকাল কর্মব্যস্ত বাবা-মা সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। সেহেতু সন্তানের সঙ্গে আবেগি সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ কমে যায়। বাবা-মা ভেবে নেন অর্থই সন্তানের সব চাহিদা মেটাবে। এতে করে সন্তানের চোখে অর্থই হয়ে ওঠে আসল সংযোগ। গ্লোবালাইজেশনের কারণে পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতি তরুণদের মনে এমন ধারণা তৈরি করছে। তারা মনে করতে শুরু করেছে জীবন মানেই ভোগ। যখন সন্তানের জীবনধারা ভোগকেন্দ্রিক হয়, তখন সে বাবা-মাকেও দেখে আর্থিক উপকরণ পাবার উৎস ও সংগ্রাহক হিসেবে।

মানুষের সবচেয়ে পবিত্র ও স্বাভাবিক সম্পর্ক হলো বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক। জন্মের পর শিশুটি যখন প্রথম হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে, তখন বাবা-মায়ের হাতই তাকে পথ দেখায়। এই সম্পর্কের ভিত্তি থাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগে। কিন্তু যখন এই সম্পর্ক অর্থের সঙ্গে বাঁধা পড়ে, তখন তা আর সম্পর্ক থাকে না; হয়ে ওঠে এক ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন। সন্তানের কাছে বাবা তখন কেবল বিদেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিক কিংবা শহরে ব্যস্ত কর্মচারী, যার একমাত্র কাজ মাস শেষে টাকা পাঠানো।

এর সাথে রয়েছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল আসক্তি সন্তানকে বাস্তব সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের রঙিন ছবি দেখে সে বাস্তবের বাবা-মায়ের মমতাকে তুচ্ছ করে ফেলেছে।

শিশুকাল থেকে নানা কারণে বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে তারা। ফলে পারিবারিক মমতা ও নৈতিক শিক্ষা থেকে উপেক্ষিত হয়ে দূরের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। আমাদের বিদ্যালয় ও সমাজে নৈতিক শিক্ষা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাবা-মা জানতেই পারছেন না তার সন্তান কার কাছে কী শিখছে। শিশুরা শিখছে পারছে না কীভাবে প্রতিযোগিতায় এগোতে হয়, কিন্তু কীভাবে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। বিশেষত: কোচিং টাইপের বিদ্যালয়ে তা শেখানো হচ্ছে না।

বাংলাদেশের সমাজে প্রায়ই দেখা যায় প্রবাসী শ্রমিকেরা বছরের পর বছর দেশের পরিবারের জন্য অর্থ পাঠান। অথচ তাদের সন্তানদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। সন্তানরা বাবাকে মনে করে কেবল টাকা পাঠানোর মেশিন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাবা দেশে ফিরে আসার পরও সন্তান তার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না।

অন্যদিকে, শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও বাবা-মা-কে অবজ্ঞা করে। কারণ বাবা-মা সময় দেন না, শুধুই টাকা দেন। ফলে সন্তানের মনে হয় সম্মান দেখানোও অর্থের বিনিময়ে করতে হবে। নৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে হলে পরিবার, শিক্ষা ও সমাজ সব স্তরে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে বাবা-মা শুধুই অর্থের উৎস নন। তারা জীবনের মূল ভিত্তি। বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও ত্যাগ কোনো টাকায় মাপা যায় না। যদি আমরা এখনই পরিবার, শিক্ষা ও সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ পুনর্গঠন না করি, তবে আগামী প্রজন্মের হাতে আমরা এক নির্মম, স্বার্থপর ও অমানবিক সমাজ তুলে দেব। অতএব, সন্তানদের মনে কৃতজ্ঞতা জাগাতে হবে, শ্রদ্ধাবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান যদি কেবল অর্থের বিনিময়ে হয়, তবে তা সম্পর্ক নয়, ব্যবসা। আমাদের সমাজে এই ব্যবসার প্রবণতা ভেঙে দিতে হবে। যাতে প্রতিটি সন্তান বাবা-মাকে নিঃস্বার্থ শ্রদ্ধা দিয়ে বলতে পারে বাবা, তুমি আমার কাছে শুধু টাকা পাঠানো মানুষ নও। তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।

ডিজিটাল এই সময়ে অর্থকেন্দ্রিক সম্পর্কের অমানবিক রূপ প্রবলভাবে বিরাজমান। সন্তান যখন বাবাকে কেবল টাকা পাঠানোর মেশিন হিসেবে দেখে, তখন সম্পর্ক আর সম্পর্ক থাকে না, হয়ে ওঠে ব্যবসায়িক লেনদেন। বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করছেন বিদেশে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এই বিপুল অর্থ দেশে অর্থনীতির প্রাণশক্তি হয়ে দাঁড়ালেও প্রবাসী বাবাদের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। অনেক সন্তানের কাছে বাবা কেবল বিদেশে থাকা অর্থপ্রদায়ী ব্যক্তি, যিনি টাকা পাঠালেই খোঁজ নেওয়ার যোগ্য। দেশে ফিরে বাবারা যখন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চান, তখন সেই আলিঙ্গন হয় অচেনা ও কৃত্রিম। এই অবস্থা হঠাৎ তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক কারণ।

শুধু প্রবাসী নয়, শহরের কর্মব্যস্ত বাবাদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। বাবা দিনরাত অফিস, ব্যবসা বা চাকরির ব্যস্ততায় সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। তারা ভেবে নেন অর্থই সন্তানের সব চাহিদা পূরণ করবে। কিন্তু সন্তান ধীরে ধীরে শিখে যায় বাবার প্রতি ভালোবাসা নয় বরং টাকাই জীবনের মূল বিষয়।

ঢাকার বাইরে গ্রামে প্রবাসী বাবাদের পরিবারে প্রায়ই দেখা যায় সন্তান বাবার ছবি টাঙিয়ে রাখে। কিন্তু তার সঙ্গে মনের আবেগি সম্পর্ক নেই। কোনো কোনো পরিবারে বহুবছর পর বাবা দেশে ফিরে আসলে সন্তান মনে করে অর্থ পাঠানো মানুষ এসেছেন। দীর্ঘদিন দূরে থাকার এই বিস্তর ফারাকের কারণে তারা বাবার হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে না।

অন্যদিকে রাজধানী ঢাকা, রাজশাহী বা চট্টগ্রামের মতো শহরে বা দেশের অনেক শহরে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়াশুনা করতে এসে বাবা-মায়ের দেওয়া অর্থে বিলাসী জীবনযাপন করছে। অথচ বাবা-মা ব্যস্ততায় তাদের সময় দেন না। ফলে সন্তানরা মনে করছে, বাবা-মায়ের কাজ শুধু টাকা দেওয়া। সম্পর্কের আবেগ বা মমতা কোনো গুরুত্ব বহন করে না।

আমরা যদি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে তাকাই তাহলে জানতে পারবো সব ধর্মেই বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম স্পষ্টভাবে বলেছে, তোমরা বাবা-মায়ের প্রতি উফ্ শব্দও উচ্চারণ করো না। অর্থাৎ বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা নিছক টাকার বিনিময়ে নয় বরং এটি এক নিঃশর্ত দায়িত্ব। নৈতিক দর্শনেও বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধকে মানবিকতার প্রথম শর্ত বলা হয়েছে। অ্যারিস্টটল থেকে কান্ত পর্যন্ত সব দার্শনিকই পারিবারিক সম্পর্ককে নৈতিকতার মূলভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

অতএব, সময় এসেছে সন্তানদের মনে নৈতিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলার। বাবা কেবল অর্থদাতা নন, তিনি জীবনের শিক্ষক, প্রথম বন্ধু ও নিরাপদ আশ্রয়। বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা যদি নিঃশর্তভাবে প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এক ঠান্ডা, হৃদয়শূন্য সমাজের মুখোমুখি হবে।

মানুষের সবচেয়ে পবিত্র ও স্বাভাবিক সম্পর্ক হলো বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক। জন্মের পর শিশুটি যখন প্রথম হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে, তখন বাবা-মায়ের হাতই তাকে পথ দেখায়। এই সম্পর্কের ভিত্তি থাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগে। কিন্তু যখন এই সম্পর্ক অর্থের সঙ্গে বাঁধা পড়ে, তখন তা আর সম্পর্ক থাকে না; হয়ে ওঠে এক ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন। সন্তানের কাছে বাবা তখন কেবল বিদেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিক কিংবা শহরে ব্যস্ত কর্মচারী, যার একমাত্র কাজ মাস শেষে টাকা পাঠানো।

বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে আবেগীয় দূরত্ব প্রজন্মান্তরে মূল্যবোধের ভাঙন ডেকে আনছে। একজন প্রবাসী বাবা বছরের পর বছর মধ্যপ্রাচ্যে কষ্টের শ্রমে উপার্জন করে পরিবারের কাছে অর্থ পাঠান। তার সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়ে, ভালো পোশাক পরে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কিন্তু সেই বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় সন্তান বলে, বাবা, টাকা পাঠিয়েছ? অথবা বাবা টাকা পাঠাও, তারপর কথা হবে। এ কথার ভেতরে কোনো মমতা বা কৃতজ্ঞতা নেই। আবার শহরের আরেক পরিবারে দেখা যায়, বাবা-মা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলেও সন্তানের কাছে তাদের গুরুত্ব সীমিত থাকে টাকা দেওয়া পর্যন্ত। সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে একবেলা খাওয়ার চেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেতে বেশি আনন্দ পায়।

যদি আমরা এখনই সম্পর্ককে অর্থের শর্ত থেকে মুক্ত না করি তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দেব এক নির্মম, লোভী ও স্বার্থপর সমাজ। বাবা-মা শুধু অর্থপ্রদায়ক নন। তারা সন্তানের প্রথম শিক্ষক, প্রথম বন্ধু এবং সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article