পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুর বাজার। এ বাজারে রয়েছে স্থানীয় জহিরুল ইসলামের তিনতলা ভবন। ভবনের তিন হাজার স্কয়ার ফুটের বিশাল ছাদ। সে ছাড়েই গড়ে উঠেছে কৃত্রিম চিড়িয়াখানা। আশপাশের অন্তত ৪০ গ্রামের মানুষ সময় কাটাতে আসেন ব্যতিক্রমী এ চিড়িয়াখানায়।
স্থানীয়রা জানান, দুই যুগ আগে ব্যবসা ছেড়ে অবসর জীবন বেছে নেন ৭০ বছর বয়সী উদ্যোক্তা জহিরুল ইসলাম। পেশাগত জীবনের আয়ে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুর বাজারে তিন তলার একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। নাম দিয়েছেন জহির সুপার মার্কেট। তিন তলা ভবনের প্রথম দুটি তলায় গড়েছেন মার্কেট এবং তৃতীয় তলায় পরিবারসহ নিজে বাস করেন। এর ঠিক ওপরে অর্থাৎ তৃতীয় তলার ছাদে তিনি গড়ে তুলেছেন এ কৃত্রিম ছাদ চিড়িয়াখানা। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা এ চিড়িয়াখানায় প্রবেশে লাগে না কোনো ফি। ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের পাশে হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা ভালো থাকলেও এ এলাকাসহ আশেপাশে তেমন বিনোদন কেন্দ্র নেই। আবার জেলা শহর থেকে অর্ধশত কিলোমিটারেরও বেশি দুরে হওয়ায় সেখানকার বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও যেতে পারেন না দর্শনার্থীরা। শিশুদের জন্যও নেই তেমন শিশু পার্ক। এসব সংকট ও শূন্যতা কিছুটা কাটানোর অভিপ্রায়েই এ চিড়িয়াখানা ও শিশু পার্ক গড়ার উদ্যোগ নেন জহিরুল ইসলাম।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের পাশের কাশিনাথপুর বাজারের জহির সুপার মার্কেটে অসংখ্য লোক প্রবেশ করছেন। বিকেলে আগতদের সংখ্যা আরও বাড়ে। দেখে মনে হবে হয়তো প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে সেখানে অবাধ যাতায়াত তাদের। কারণ মার্কেটের প্রথম দুটি তলায় বিভিন্ন দোকান রয়েছে। কিন্তু মূল বিষয় সেটি নয়। ওই মার্কেটে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের বড় একটি অংশ প্রথম দুটি তলা অতিক্রম শেষে একেবারে তৃতীয় তলার ছাদে উঠছেন। কারণ তাদের লক্ষ্য ওই কৃত্রিম ছাদ চিড়িয়াখানা ও শিশু পার্ক। সেখানে প্রবেশ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি পেশার মানুষ ঘুরে ঘুরে চিড়িয়াখানার কৃত্রিম চিড়িয়া বা ভাস্কর্য দেখছেন। শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন রাইডিং সহ বাঘ, সিংহ, হরিণ, বক, সাপ, উট, হাঙর, শিয়াল, পেঙ্গুইন, পেঁচা, ডলফিন, মাছরাঙা, ক্যাঙারু, হাতি, ঘোড়া ও জেব্রাসহ অন্তত ৫০টি প্রাণীর ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে এ চিড়িয়াখানায়। এছাড়া রয়েছে কৃষিকাজ, গৃহস্থালি ও পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী কলের গান, হুক্কা, রেডিও, মাথাইল, শিঙা, পাখা, পাহাড়ি গাছের ফল, হারিকেন, লাঙল, একতারা, দোতারা, দোয়াত, খড়ম, বেতের তৈরি খালই, ঝুড়ি, ঝাঁকা, বাঁশের তৈরি গরুর মুখে ব্যবহার করা টুনাসহ ৫০ থেকে ৬০ বছরের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী প্রায় ৮০০ পণ্য। যা দেখে মুগ্ধ হবার পাশাপাশি ঐতিহ্যকে স্মরণ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।
আরও পড়ুন
মনোরম পরিবেশে বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক
চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কে আসছে ২৮ প্রাণি
মেঘলার বুকে ভ্রমণের আনন্দ
দর্শনার্থী আরিফ বলেন, হয়তো খোলা জায়গার মত এতোটা বড় পরিসরে এটি করা হয়নি। তবুও এতে বিনোদনের কমতি নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এখানে রাখা ঐতিহ্যবাহী পণ্য বা জিনিসগুলো। অবশ্যই এগুলো বেশ কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি টানের জায়গা থেকেই এটি করা হয়েছে।

চিড়িয়াখানা প্রসঙ্গে এ দর্শনার্থী বলেন, দেখুন ঢাকা বা সমৃদ্ধ অন্যান্য নগরীর মত বড় চিড়িয়াখানা হয়তো এটি নয়। হয়তো এখানে জীবন্ত বাঘ ভাল্লুক নেই। রয়েছে কনক্রিট বা প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপাদানে তৈরি প্রাণীর ভাস্কর্য। এরমধ্য দিয়ে হলেও বিনামূল্যে উদ্যোক্তা আমাদের একটু ভিন্ন মুহূর্ত উপহার দিতে চেয়েছেন। এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তাছাড়া এখানে এসে খারাপ লাগেনি। বেশ ভালোই লেগেছে।
বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে আসা হাসিম বলেন, আমাদের আশপাশে তেমন শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা বা বিনোদন কেন্দ্র নেই। ফলে বাচ্চাদের নিয়ে একটু আলাদা সময় কাটানোরও তেমন সুযোগ নেই। তবে ছাদে স্বল্প পরিসরে হলেও এখানে এ পার্ক বা চিড়িয়াখানাটি থেকে অনেক ভালো হয়েছে। অন্তত বাচ্চাদের নিয়ে আসা যায়। টুকটাক যা রাইড বা এরকম কিছু আছে তা দিয়ে বাচ্চারা একটু বিনোদন পায়। এসব বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে এ জাতীয় বা পূর্ণাঙ্গ আরও বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত।
কাশিনাথপুর বিজ্ঞান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী পার্থ ও মীম জানায়, ছাদে ফুল-ফল বা কৃষি বাগান হয় বলে অনেক জানা বা শোনা যায়। তবে ছাদে এধরনের কৃত্রিম চিড়িয়াখানা করা যায় এটি শুধু এ এলাকাসহ আশপাশের নয় পুরো জেলায় বিরল। বলা যায়, একমাত্র কৃত্রিম চিড়িয়াখানা ও জাদুঘর এটি। বর্তমানে সচরাচর দেখা যায় না এমন অনেক জিনিস এখানে আছে। সবমিলিয়ে এখানে তাদের ঘুরতে ভালো লাগে বলে জানান এ শিক্ষার্থীরা।
উদ্যোক্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, জীবনে ব্যবসা বাণিজ্য কম বেশি যা করার করেছি। সবশেষ যুগ দুয়েক আগে বিশ্রামে যাবার সিদ্ধান্ত নেবার পর মাথায় আসল এ এলাকায় তেমন কোনো বিনোদন কেন্দ্র নাই। বাচ্চারা যে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে সেরকম কোনো জায়গা নেই। তখন চিন্তা করলাম স্বল্প পরিসরে হলেও একটা বিনোদন কেন্দ্র গড়ব। সেখান থেকে এ উদ্যোগ।
তিনি বলেন, শুধু এই এলাকায় নয়, পাবনাতে তেমন চিড়িয়াখানা, জাদুঘর এ জাতীয় কিছুই নেই। তাই ২০২০ সাল থেকে এযাবৎ হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে এমন ঐতিহ্যবাহী নানা জিনিস দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে এখানে স্থান দিয়েছি। এটিকে কৃত্রিম চিড়িয়াখানা, ছোট শিশু পার্ক আবার জাদুঘরও বলা যাবে। অল্প করে হলেও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ রেখেছি। শুধুমাত্র মানুষকে স্বস্তি ও বিনোদন দেবার উদ্দেশ্যেই এটি করা বলেও জানান তিনি।
আরএইচ/এমএস

2 weeks ago
15









English (US) ·