• চট্টগ্রামের ব্যস্ততম সড়ক বিমানবন্দর সড়ক
• এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণে কাটা হয়েছে সড়ক
• ভাঙা সড়ক মেরামতের দায় নিচ্ছে না চউক-চসিক
• চলাচলে দুর্ভোগ চরমে, নির্বিকার প্রশাসন
ব্যবসা-বাণিজ্যের নগরী চট্টগ্রামের ব্যস্ততম সড়ক হলো শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার প্রধান সড়কটি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের সময় কেটে ফেলা অংশগুলো সংস্কার না করায় সড়কের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক এখন খানাখন্দে ভরা। প্রতিদিন ছোট-বড় যানবাহন ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে এ পথে। এতে সাধারণ যাত্রী ও স্থানীয়দের ভোগান্তি চরমে পৌঁছালেও নজর নেই কর্তৃপক্ষের।
নগরীর সদরঘাট, মাঝিরঘাট, বারিক বিল্ডিং, সল্টগোলা ক্রসিং, ইপিজেড মোড় ও সিমেন্ট ক্রসিং হয়ে এ সড়ক বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠগড় হয়ে আউটার রিং রোড কিংবা টানেল সড়ক দিয়েও যাওয়া যায় বিমানবন্দর।
আরও পড়ুন:
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বদলে দেবে চট্টগ্রামের যোগাযোগ-বাণিজ্য
চট্টগ্রাম গিয়ে একদিনেই ঘুরে আসতে পারবেন যে ৬ সমুদ্রসৈকতে
চট্টগ্রাম বন্দরে যানবাহন প্রবেশে বাড়তি মাশুল স্থগিত
সড়কজুড়ে, বিশেষ করে ইপিজেড থানার ব্যারিস্টার কলেজের সামনে এবং সিমেন্ট ক্রসিং সংলগ্ন নারিকেলতলা এলাকায় চলছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) নির্মিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প তৈরির কাজ। এতে ওই অংশের সড়কে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। খানাখন্দে ভরা এই পথে ঝুঁকি নিয়ে চলছে সব ধরনের যানবাহন।
তবে এসব গর্ত ও সড়কের করুণ অবস্থা নিরসনে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না চউক বা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। নাগরিক ভোগান্তি লাঘবে সড়ক মেরামত নিয়ে দুই সংস্থার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, সড়কটি দ্রুত মেরামতের সম্ভাবনা নেই। ফলে নাগরিক ভোগান্তি শিগগির কমারও কোনো লক্ষণ নেই।
চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে আমদানি-রপ্তানিবাহী পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এ সড়কটি। সড়কটি ঘিরে রয়েছে দেশের দুটি বৃহৎ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড)। বন্দর কিংবা ইপিজেড এলাকার পণ্য বেশি আনা-নেওয়া হয় বন্দর ঘিরে আশপাশের এলাকার গড়ে ওঠা বেসরকারি ডিপোগুলোতে। যে কারণে এ সড়কটি দিয়ে চলে পণ্যবাহী ভারী ভারী যানবাহন। আবার পতেঙ্গা বিচ কিংবা বিমানবন্দরগামী লোকজনের চলাফেরাও এই সড়কে।
সম্প্রতি বিমানবন্দর সংলগ্ন পুরো এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইপিজেড মোড়ের কাছে ব্যারিস্টার কলেজের সামনে সড়কের দুই পাশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠানামার র্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে। ইপিজেড মোড়ে নামার র্যাম্পটির ফাইলিং হয়ে পিলারও তৈরি হয়েছে। বিপরীতে সড়কের অন্যপাশে ওঠা র্যাম্পের পাইলিংয়ের কাজ চলছে। এখানকার আধা কিলোমিটারজুড়ে গর্ত আর গর্ত। ভারী যানবাহন চলাচল করার কারণে প্রতিদিন আরও বড় হচ্ছে এসব গর্ত। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই, কাদা-পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হয় সাধারণ মানুষকে।
আরও পড়ুন:
বর্ধিত ট্যারিফ নিয়ে সংকট, চট্টগ্রাম বন্দর অচল হওয়ার আশঙ্কা
বর্ধিত বন্দর মাশুলে চাপে ব্যবসা-বাণিজ্য, ভুগবে সাধারণ মানুষ
চট্টগ্রামে যানজট কমাতে বিমানবন্দর সড়কে ফ্লাইওভার করতে চায় চসিক
সড়ক সংলগ্ন এলাকায়ই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল সিইপিজেড। ইপিজেডে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিনই সকালে কিংবা বিকেলে শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার জটলা তৈরি হয়। শত শত বাস, লেগুনা ভিড় করে ইপিজেডের মোড়ে। ফলে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয় রাস্তা পারাপারে।
ইপিজেড কারখানায় কাজ করেন কাকলি চাকমা। কাকলি বলেন, ‘আমার বাসা ব্যারিস্টার কলেজ রোডেই। ইপিজেড ছুটির সময় এ সড়কটি দিয়ে হাঁটাও যায় না। কোনো ফুটপাত নেই। সড়কটিতে বড় বড় গর্ত। এখানে বৃষ্টি না হলেও নালার পানিতে বেশির ভাগ সময় রাস্তা টইটম্বুর থাকে। তখন পানির কারণে গর্তগুলো দেখা যায় না। পদে পদে মৃত্যু ঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীদের, যারা সকালবেলা স্কুলে যায়।’

আরেক কারখানায় কর্মরত প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে ইপিজেডের কার্যক্রম শুরুর সময় যানজট এড়াতে বাসা থেকে আগের চেয়ে এক ঘণ্টা আগে বের হতে হয়। অফিস ছুটির পরে বাসায় ফিরতেও বেশি সময় ব্যয় হয় শুধু ইপিজেড মোড় থেকে সিমেন্ট ক্রসিং জ্যামের কারণে। শত শত লরি, কাভার্ডভ্যান রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলো ঠেলে বাসগুলো এগোতে পারে না। অথচ সড়কটি মেরামত করা হলে এ ভোগান্তি আর থাকতো না।’
অন্যদিকে, সিমেন্ট ক্রসিং সংলগ্ন নারিকেলতলা এলাকার আধা কিলোমিটারজুড়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের কাজ চলছে। এখানে চওড়া সড়কটি ভেঙে গর্ত হয়ে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। নারিকেলতলার সামান্য দূরেই কর্ণফুলী ইপিজেডের অবস্থান। এই ইপিজেডেও প্রায় এক লাখ শ্রমিক কাজ করেন। যাদের বড় অংশই আশপাশের এলাকায় বসবাস করেন। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে কর্মস্থলে যাতায়াতে তাদের নিত্য-দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
নগরীর কালুরঘাট রাস্তার মাথা থেকে কাঠগড় ১০ নম্বর রুটে বাস চালান আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, ‘সিমেন্ট ক্রসিং থেকে ইপিজেড মোড় এবং নারিকেলতলা এলাকায় দুই অংশে সড়কটি একেবারে গর্তে ভরে গেছে। রোদ থাকলে ধুলো, বৃষ্টি হলে কাদা পানিতে রাস্তা সয়লাব হয়ে যায়। গাড়ি চালানো দুষ্কর। দিনের বেশিরভাগ সময়ে কোনো না কোনো যানবাহন নষ্ট হয়ে এখানে আটকা থাকে। এতে দীর্ঘ সময় যানজট তৈরি হয়। যানজটে পড়লে আমাদের বাসে যাত্রী নেমে যায়। পুরো সড়কটি যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।’
নাগরিক দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করলেও সড়কটি মেরামতে চউক ও চসিক দুই সরকারি সংস্থার মধ্যে রশি টানাটানি চলছে।

চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠগড় পর্যন্ত পুরো সড়কটি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করি। এরমধ্যে যেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে ওই অংশ ছাড়া। ব্যারিস্টার কলেজ ও নারিকেলতলায় দুই স্থানে র্যাম্প নির্মাণ কাজের কারণে রাস্তা-ফুটপাত নালা কেটেছে চউক। এগুলো মেরামতের কাজ তারাই (চউক) করবে। তাদের কাজের মধ্যেই এসব মেরামতের ব্যয় ধরা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ওই দুই স্থানে সড়ক মেরামতে আমাদের মেয়রের সঙ্গে চউক চেয়ারম্যানের কথাও হয়েছে। তখন চউকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওই দুই অংশের সড়ক তারা দ্রুত মেরামত করবেন। ওই দুই অংশ বাদে পুরো সড়কে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলমান।’ সড়কটির অন্য কোথাও রাস্তায় সমস্যা নেই বলেও দাবি তার।
তবে সড়কটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা চউকের দায়িত্ব নয় বলে দাবি করেন লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সিটি করপোরেশনে হস্তান্তর করেছি। এখন র্যাম্প নির্মাণ হচ্ছে। প্রকল্প হস্তান্তরের পর পুরো সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব।’

চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। ওই সময় এ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। তবে তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হয়নি। এরপর সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়ানো হয়। দুই দফা ব্যয় বৃদ্ধি করে বর্তমানে প্রকল্পের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩১৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ তৃতীয় দফায় সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
চউক ও চসিক পরস্পরকে দোষারোপ না করে দ্রুত বিমানবন্দর সড়কটি সংস্কারে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা একটি পরিকল্পিত নগরীর কথা অনেকদিন ধরে বলে আসছি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে জনগণের টাকায়। চউক কিংবা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চলে জনগণের করের টাকায়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হোক কিংবা সড়ক ভেঙে যাওয়া, নাগরিক হিসেবে দাবি এ সড়ক মেরামত হোক, জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হোক। এখন কে কাজ করবেন, কে করবেন না, এটা তো জনগণ চায় না। জনগণ চায়- দুর্ভোগ লাঘবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত ব্যবস্থা নিক।’
সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ইপিজেড মোড় কিংবা সিমেন্ট ক্রসিং এলাকার সড়কটি খানাখন্দে ভরে গেছে, চউক-সিটি করপোরেশন দুই প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।
এমডিআইএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

2 weeks ago
17









English (US) ·