বিশ্বজুড়ে কী ঘটবে যদি আগামী শুক্রবার জাতিসংঘ বিলুপ্ত হয়ে যায়!

5 hours ago 5

প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পেরিয়ে জাতিসংঘ এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আন্তর্জাতিক আইন, মানবিক সহায়তা, শান্তিরক্ষা, কূটনীতি, সবখানেই রয়েছে এই সংগঠনের ভূমিকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলা থেকে শুরু করে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে সহায়তা পর্যন্ত জাতিসংঘের প্রভাব বিস্তৃত।

তবে বছর বছর বাড়ছে এই সংস্থার সমালোচনাও। কেউ কেউ বলছেন, জাতিসংঘ পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থই বেশি রক্ষা করছে; বৈশ্বিক দক্ষিণ বা দরিদ্র দেশগুলোর কথা কমই শোনা হয় সেখানে। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার গণহত্যা, কিংবা সুদানের দারফুরে জাতিগত নিধন- এসব ঠেকাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতাও বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে সংগঠনটিকে।

এমনকি, গাজা যুদ্ধেও জাতিসংঘকে প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় দেখা গেছে। ইসরায়েল তার বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থে যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে অনেকে এখন জিজ্ঞেস করছেন- জাতিসংঘের দরকারই বা কী? রাষ্ট্রগুলো কি নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে পারে না?

এমন বাস্তবতায় ‘যদি জাতিসংঘ হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে বিশ্বে কী ঘটবে- এমন প্রশ্ন নিয়ে বিশ্বের একাধিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। আসুন দেখে নিই, এমনটি হলে আসলেই কী কী ঘটতে পারে...

অভিবাসন ও শরণার্থী সংকট

এক বিশেষজ্ঞ বলছেন, যদি আগামী শুক্রবার জাতিসংঘ ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে সোমবারই আবার সেটিকে নতুনভাবে গঠনের প্রয়োজন দেখা দেবে। কারণ বর্তমান বিশ্বের বড় সমস্যা, যেমন শরণার্থী ও অনিয়মিত অভিবাসনের কোনোটিই কোনো একক রাষ্ট্রের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

বর্তমানে অন্তত ১০ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত বা শরণার্থী। জাতিসংঘের সহায়তা কমলে খাদ্যসংকট বাড়বে, পুষ্টিহীনতা ও সামাজিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। অনেক শরণার্থী ক্যাম্প থেকে শহরমুখী হবে, যা স্থানীয় অর্থনীতি ও অবকাঠামোর ওপর নতুন চাপ তৈরি করবে।

জাতিসংঘ না থাকলে ধনী রাষ্ট্রগুলো শরণার্থীদের মানবাধিকার রক্ষার দায় এড়িয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের একক নীতির মতো স্বেচ্ছাচারিতা ছড়িয়ে পড়বে। আর জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার চাকরিও এক রাতে হারিয়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক আইনের ভবিষ্যৎ

বড় দেশগুলোর কাছে সার্বভৌমত্ব সবসময়ই আন্তর্জাতিক আইনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। জাতিসংঘ বিলুপ্ত হলে সেই প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মতো প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের প্রভাব কমে আসছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘ না থাকলেও আন্তর্জাতিক আইন পুরোপুরি হারিয়ে যাবে না। এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা ও জাতীয় আদালতগুলো তখন আরও বেশি ভূমিকা নিতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠন ‘আল-হাক’ এরই মধ্যে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করছে, যারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে।

তবে জাতিসংঘের তদারকি ছাড়া এসব আইনের প্রয়োগ অনেকটাই নির্ভর করবে রাষ্ট্র, করপোরেশন ও নাগরিক সমাজের ওপর, যা কঠিন এক ভারসাম্যের কাজ হবে।

শান্তিরক্ষা মিশনের বিকল্প কী হবে?

জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব রমেশ ঠাকুর বলেন, এই সংগঠনের অনুপস্থিতিতে এককভাবে কোনো দেশের ‘শান্তিরক্ষা’ কার্যক্রম অনেক সময়ই আসলে দখলদারিত্বে পরিণত হয়। আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো আঞ্চলিক সংগঠনগুলো কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু তারাও শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের অনুমোদনের দিকেই চেয়ে থাকে।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর কাছে বৈধতার প্রতীক। তবে রমেশ ঠাকুরের মতে, সেই বৈধতা এখন হুমকির মুখে। এটি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না বা নিতে চায় না। বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনকে রীতিমতো হাস্যকর করে তুলেছে।

রমেশ ঠাকুর বলেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মতো প্রতিষ্ঠান থাকতেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

জাতিসংঘের সাবেক এই সহকারী মহাসচিব বলেন, এত সমালোচনা থাকার পরও আমরা এই জাতিসংঘকে ছাড়া চলতে পারি না। তবে যদি আমরা এখন এটিকে নতুন করে গঠন করতাম, তাহলে সম্ভবত এটি ১৯৪৫ সালের কাঠামো থেকে পুরোপুরি আলাদা হতো। কারণ বিশ্ব তখনকার তুলনায় বর্তমানে খুবই ভিন্ন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিইএইচও) ছাড়া বিশ্ব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি শুক্রবার ডব্লিউএইচও বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে তার পরের দিন থেকেই অর্থাৎ শনিবার থেকেই তা পুনর্গঠনের চেষ্টা শুরু হবে। কারণ এই সংস্থার মূল শক্তি হলো, প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের সমান অধিকার।

বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলো ডব্লিউএইচও’র ওপর নির্ভরশীল, কারণ তাদের নিজস্ব ওষুধ অনুমোদন বা টিকা মূল্যায়নের সক্ষমতা নেই। সংস্থা না থাকলে অনিরাপদ বা ভেজাল ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে পড়বে, প্রাণহানি ঘটবে।

এছাড়া ডব্লিউএইচওর বৈশ্বিক ভাইরাস পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ৫০ বছর ধরে বিশ্বের নানা সংক্রমণ নজরদারি করে আসছে। এর অনুপস্থিতিতে মহামারি মোকাবিলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কোভিড-১৯ এর সময় যেভাবে দরিদ্র দেশগুলো টিকার অভাবে ভুগেছিল, তা আবার ঘটতে পারে।

সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম

নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জেমস টমাস। তিনি ‘বাট আই মিনট ওয়েল: আনলার্নিং কলোনিয়াল ওয়েজ অব ডুইং গুড’ বইয়ের লেখক।

জেমস টমাস বলেন, জাতিসংঘের অনুপস্থিতি বিশ্বকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করবে যে আমরা কতটা নির্ভরশীল এই সংস্থার ওপর। জাতিসংঘ, ডব্লিউএইচও বা ইউএসএআইডির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে বিশাল তহবিল, অবকাঠামো ও অভিজ্ঞতা। স্থানীয় এনজিওগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তারা একই মাত্রায় কাজ করতে পারে না।

এই সংস্থার এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, আমি ইউএসএআইডি সপ্তাহে এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ডলারের স্বাস্থ্য প্রকল্প পরিচালনা করতাম। পরে বুঝেছি, এসব প্রকল্প আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল।

তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘ ও অনুরূপ সংস্থাগুলো শুধু সহায়তা দেয় না; তারা গ্লোবাল নর্থের অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বের ‘আমরা উন্নত, তোমরা অনুন্নক। অগ্রগতি করতে হলে তোমাদের আমাদের মতো হতে হবে’ এই আখ্যান আরও শক্তিশালী করে।

অধ্যাপক টমাস বলেন, এই কাঠামোটি এখনো উপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে। সহায়তাকে উপনিবেশমুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু সেগুলো অসম ও অসম্পূর্ণ। যদি
তার মতে, জাতিসংঘ হঠাৎ চলে যায়, তবে আমরা ছোট, আরও স্থানীয় সংস্থাগুলো দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ছুটব। এটি সাহায্যকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলবে। তবে একই সঙ্গে এটি আরও খণ্ডিত, ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত হবে। আসল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সত্যিই ভিন্ন কিছু কল্পনা এবং তৈরি করা।

কূটনীতি ও বৈশ্বিক রাজনীতি

জাতিসংঘ বিলুপ্ত হলে বিশ্ব কূটনীতি আরও খোলাখুলি লেনদেনভিত্তিক হয়ে পড়বে। দেশগুলো পারস্পরিক বা আঞ্চলিক চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ মেটাবে। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটছে। যেমন ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ‘লেনদেনভিত্তিক” কূটনীতি চালাচ্ছে।

তবে জাতিসংঘ এখনো একধরনের নৈতিক চাপ তৈরি করে, যা সংকটে থাকা দেশগুলোর জন্য আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। এটি হারালে সেই সামান্য বৈশ্বিক ঐক্যও ভেঙে পড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো সংস্থা কিছুটা ভূমিকা নিতে পারবে, কিন্তু জাতিসংঘের সার্বজনীন বৈধতা তারা পাবে না।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক লক্ষ্য

জলবায়ু ইস্যুতে জাতিসংঘ এখনো একমাত্র বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সবাই একসঙ্গে কথা বলতে পারে। প্যারিস চুক্তি ও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো উদ্যোগগুলোর মূল ভিত্তি এই সংস্থা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘ না থাকলে ধনী দেশগুলো নিজেদের বাজারমুখী নীতিতে ফিরে যাবে, দরিদ্র দেশগুলো পেছনে পড়ে থাকবে। বৈশ্বিক ন্যায্যতা ও পরিবেশ-ন্যায়বিচারের ধারণা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

জাতিসংঘ মানে ‘বিশ্বের ওয়াই-ফাই’

এক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেন, জাতিসংঘ শুধু নিরাপত্তা পরিষদ নয়; এটি অনেক ছোট ছোট সংস্থার জটিল এক জাল। টেলিকম, মেধাস্বত্ব, খাদ্য, কৃষি- সব ক্ষেত্রেই এসব সংস্থার ভূমিকা রয়েছে।

তার ভাষায়, এগুলো হলো বহুপক্ষের ‘ওয়াই-ফাই’। যতক্ষণ কাজ করে, কেউ খেয়াল করে না। কিন্তু একবার বন্ধ হলে বুঝবেন, কতটা নির্ভরশীল ছিলাম আমরা।

সূত্র: আল-জাজিরা

এসএএইচ

Read Entire Article