বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতে কিছুদিন পরপরই শোনা যায় পদদলনে হতাহতের খবর। কখনো মন্দির, কখনো রেলস্টেশন, আবার কখনো রাজনৈতিক সমাবেশে দেখা গেছে এমন প্রাণঘাতী ঘটনা। দেশটিতে গত ১৫ বছরে এ ধরনের অন্তত ২২টি বড় দুর্ঘটনায় ৭৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হলেও আশ্চর্যজনকভাবে এর জন্য আজ পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, সাজা হয়নি একজনেরও।
এই দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে অতিরিক্ত ভিড়, দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রশাসনিক অবহেলা প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে প্রতিবারই শুধু তদন্ত, কমিশন রিপোর্ট এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে বিষয়গুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘দায়হীনতার সংকট’ বলে অভিহিত করছেন, যা জনস্বাস্থ্যের অধিকারকে স্পষ্টতই লঙ্ঘন করে।
১৫ বছরের কালো অধ্যায়
গত ১৫ বছরে এই দুর্ঘটনাগুলো প্রধানত মন্দির, কুম্ভমেলা এবং বিভিন্ন উৎসবে ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালই সবচেয়ে ভয়াবহ। এ বছরই ভারতে পদদলিত হয়ে ১৫০ জনের বেশি মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে। নিচে প্রধান ঘটনাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো:
- ৪ মার্চ ২০১০, প্রতাপগড়, উত্তর প্রদেশ: রাম জানকি মন্দিরে প্রসাদ বিতরণের জন্য ভক্তদের ভিড় জমায় পদদলিত হয়ে ৬৩ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ২০ জনের বেশি। সংকীর্ণ গেট এবং অতিরিক্ত ভিড় ছিল দুর্ঘটনার কারণ।
- ১৪ জানুয়ারি ২০১১, সাবরিমালা, কেরালা: পূণার্থীদের সেতু ভেঙে পড়ায় পদদলিত হয়ে ১০৬ জন মারা যান। আহত হন আরও শতাধিক। অতিরিক্ত ভিড় এবং দুর্বল সেতু অবকাঠামোকে এর জন্য দায়ী করা হয়।
- ৮ নভেম্বর ২০১১, হরিদ্বার, উত্তরাখণ্ড: হরিদ্বারের হর-কি-পৌড়ি ঘাটে পদদলিত হয়ে ২০ জন নিহত হন।
- ১৯ নভেম্বর ২০১২, পাটনা, বিহার: পাটনায় ছট পূজা উৎসবের সময় ভিড়ের চাপে ২০ জন নিহত হন।
- ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, এলাহাবাদ, উত্তর প্রদেশ: ২০১৩ সালে কুম্ভমেলার সময় এলাহাবাদ রেলস্টেশনে অতিরিক্ত ভিড়ের ফলে ৪২ জন নিহত হন।
- ১৩ অক্টোবর ২০১৩, রতনগড়, মধ্য প্রদেশ: নবরাত্রির উৎসবের সময় সিন্ধু নদীর সেতু ভেঙে পড়ার গুজবে ১১৫ তীর্থযাত্রী নিহত এবং ১১০ জন আহত হন।
- ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪: মালাবার হিল, মুম্বাই: মালাবার হিলে পদদলিত হয়ে ১৮ জনের মৃত্যু হয়।
- ৩ অক্টোবর ২০১৪, পাটনা, বিহার: দশহরা উৎসবে গান্ধী ময়দানে পদদলিত হয়ে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ২৬ জন। গুজব এবং অসংগঠিত ব্যবস্থাপনাকে এর জন্য দায়ী করা হয়।
- ১৪ জুলাই ২০১৫, রাজহমুন্ড্রি, অন্ধ্র প্রদেশ: গোদাবরী পুষ্করম উৎসবে নদীতে স্নানকালে সংকীর্ণ ঘাটে পদদলনে ২৭ জন মারা যান, আরও অন্তত ২০ জন আহত হন।
- ১৫ অক্টোবর ২০১৬, উত্তর প্রদেশ: বারাণসীর কাছে একটি ধর্মীয় শোভাযাত্রার সময় সেতুতে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ২৪ জন নিহত হন।
- ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মুম্বাই, মহারাষ্ট্র: এলফিনস্টোন রেলস্টেশনে ভারী বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা এবং একটি ওভারব্রিজ ধসে পড়ার গুজবের জেরে ২৩ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৩৬ জন।
- ১ জানুয়ারি ২০২২, বৈষ্ণো দেবী মন্দির, জম্মু: নতুন বছরের উৎসবে সংকীর্ণ পথে ১২ জন মারা যান।
- ২ জুলাই ২০২৪, হাথরাস, উত্তর প্রদেশ: ভোলা বাবার সৎসঙ্গে অতিরিক্ত ভিড় ও খারাপ আবহাওয়ার জেরে ১২১ জনের প্রাণহানি ঘটে, যা এই দশকের অন্যতম মারাত্মক দুর্ঘটনা।
- ৮ জানুয়ারি ২০২৫, তিরুপতি, অন্ধ্র প্রদেশ: বালাজি মন্দিরে ফ্রি টিকিটের জন্য গেট খুললে ভিড়ের চাপে ছয়জন মারা যান, আরও ৩৫ জন আহত হন।
- ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, প্রয়াগরাজ মহাকুম্ভ: মৌনী অমাবস্যায় লাখ লাখ তীর্থযাত্রীর স্নানকালে ব্যারিকেড ভেঙে ৩০ জনের মৃত্যু হয়, আরও ৬০ জনের বেশি আহত হন।
- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, দিল্লি রেলস্টেশন: কুম্ভমেলার যাত্রীদের ভিড়ে ফুট ওভারব্রিজে ১৮ জন মারা যান।
- ৩ মে ২০২৫, শিরগাঁও, গোয়া: লাইরাই দেবী উৎসবে ঢালু পথে পদদলিত হয়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়, ৮০ জনের বেশি আহত হন।
- ২৯ জুন ২০২৫, পুরী গুন্ডিচা মন্দির, উড়িষ্যা: রথযাত্রায় ভিড়ে অন্তত তিনজন মারা যান।
- ৪ জুন ২০২৫, বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক: আইপিএলে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর (আরসিবি) শিরোপা জয় উদযাপনকালে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে।
- ২৭ জুলাই ২০২৫, হরিদ্বার, উত্তরাখণ্ড: মনসা দেবী মন্দিরে বিদ্যুৎতারের গুজবে পদদলিত হয়ে অন্তত ছয়জন মারা যান।
- ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, করুর, তামিলনাড়ু: অভিনেতা বিজয়ের রাজনৈতিক সমাবেশে পদদলিত হয়ে অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়, আরও অর্ধশতাধিক আহত হন।
- ১ নভেম্বর ২০২৫, শ্রীকাকুলাম, অন্ধ্র প্রদেশ: নবনির্মিত শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর স্বামী মন্দিরে পদদলনের ঘটনায় অন্তত নয়জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও ৩১ জন।
দুর্ঘটনার নেপথ্যে অবহেলা, গুজব এবং অদক্ষতা
এই দুর্ঘটনাগুলোর প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত ভিড় এবং দুর্বল অবকাঠামো। যেমন- লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও সংকীর্ণ গেট, দুর্বল সেতু বা ব্যারিকেড দুর্ঘটনা ডেকে আনে।
দ্বিতীয়ত, গুজব ও আতঙ্ক। পাটনা বা হরিদ্বারের মতো ক্ষেত্রে মিথ্যা আতঙ্ক ছড়ানোয় অরাজকতা তৈরি হয়।
তৃতীয়, প্রশাসনিক অবহেলা: ভিড় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত পুলিশ এবং অবৈধ নির্মাণ (করুরের মতো) দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।
দায়হীনতার অভাব: নেই সাজা, আছে শুধু প্রতিশ্রুতি
ভারতে পদদলন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে হতাশাজনক অংশ হলো দায়বদ্ধতার অভাব। দেড় দশকে সাড়ে সাতশর বেশি মৃত্যুর পরও দোষী সাব্যস্তের সংখ্যা পুরোপুরি শূন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের, জুডিশিয়াল কমিশন গঠন এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ (২-২৫ লাখ রুপি) দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই আইনি প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ:
- হাথরাস ২০২৪: ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (কলপাবল হোমিসাইড) দেওয়া হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়া এখনো চলমান। তবে অভিযুক্তদের সবাই জামিনে রয়েছেন।
- তিরুপতি ২০২৫: কমিশন দুই কর্মকর্তাকে দায়ী করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নির্দেশ দেয়। কিন্তু কোনো ফৌজদারি সাজা হয়নি।
- করুর ২০২৫: সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু এখনো সাজা নেই।
- অন্যান্য (যেমন সাবরিমালা, পাটনা): তদন্ত হয়েছে, কিন্তু ‘অবহেলা নেই’ বলে তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীরা শুধু আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে কোনো নির্দিষ্ট পদদলন প্রতিরোধ আইন নেই। এটি দায়হীনতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তাদের মতে, পদদলনে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩০৪এ (অবহেলায় মৃত্যু) প্রযোজ্য হলেও ‘গ্রস নেগলিজেন্স’ প্রমাণ করা কঠিন। তাছাড়া, এ ধরনের দুর্ঘটনায় ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা থাকলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দায়হীনতা এড়িয়ে যাওয়া হয়।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, দ্য হিন্দু, ভাস্কর, উইকিপিডিয়া
কেএএ/

16 hours ago
3









English (US) ·