ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অর্থদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত করা হয় এরশাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এরশাদ আলীকে। দেশের ট্রান্সপোর্ট ও স্টিল খাতের অন্যতম বড় এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় হয়রানি করে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাট ও দখল করার অভিযোগ উঠেছে।
এই লুটপাটে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার বড় ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান জ্যোতির বিরুদ্ধে।
এছাড়া, এই অপকর্মে আরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান খান লিটনের বিরুদ্ধে। তাদের হাতিয়ার ছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ- ডিবির একাধিক কর্মকর্তা। রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠা পুলিশ ও দেশের প্রভাবশালী এই রাজনৈতিক চক্রের থাবায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন এক সময়ের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এরশাদ আলী।
শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর মগবাজারে একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এরশাদ আলী এসব অভিযোগ তোলেন।
তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান জ্যোতি, নারায়ণগঞ্জের গডফাদার এমপি শামীম ওসমান, রাজশাহীর সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনসহ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ষড়যন্ত্র করে আমাকে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে উৎখাত করেছে। আমাকে বিএনপির অর্থদাতা তকমা দিয়ে একের পর এক রাজনৈতিক মামলা, হামলা চালানো হয়। আমার প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়, বাসা, ট্রাক, গুদাম ও স্টিল কারখানার শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভুক্তভোগী এই ব্যবসায়ী বলেন, পৈত্রিক সূত্রে ১৯৯২ সালে ব্যবসার হাল ধরি। দেশের শীর্ষ ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠান শাহ মখদুম ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা থেকে শুরু হয় যাত্রা। দুই শতাধিক ছোট-বড় ট্রাকের মাধ্যমে দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালামাল পরিবহন করতাম। এই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করে সুনাম অর্জন করেছি ও পুরস্কৃত হয়েছি। এভাবে ২০১০ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে বেশ কয়েকটি সিস্টার কনসার্নের মাধ্যমে ‘এরশাদ গ্রুপ’ দেশের শিল্পক্ষেত্রে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে। গ্রুপের ১০ থেকে ১২টি প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং দেশ-বিদেশ থেকে বহু পুরস্কার অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার ছেলের দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর রাজনৈতিক বিরোধের জেরে আমাকে বিএনপির অর্থদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একের পর এক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার ও কারাবন্দি করা হয়। সব মিলিয়ে মামলার সংখ্যা এখন ৪২টি। ২০১০ সাল থেকে একে একে এরশাদ গ্রুপের কলাবাগানের নাসির ট্রেড সেন্টারের প্রধান কার্যালয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে জ্যোতি দখল করে। ধানমন্ডির বাসভবন তাদের ক্যাডার গোল্ডেন খোকনকে দিয়ে দখল করায়, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের গুদাম দখল করে নেয়। এছাড়া সোনারগাঁওয়ের জংদারি-রোলিং মিলস ও ডেমরার স্টিল মিল শামীম ওসমানের সহযোগী ও শীর্ষ সন্ত্রাসী আজিজুর রহমান আজিজ দখলে নেন। এই আজিজের নেতৃত্বে আমার দুই কারখানার আড়াইশো কোটি টাকার মেশিনসহ মালামাল লুট করা হয়। এমনকি আমার ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার ১৩৭টি ট্রাক এখনো তাদের দখলে রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ২০ বিঘা জমির মাটি লুট করে জলাশয়ে পরিণত করা হয়েছে।
সম্প্রতি দেশ ছেড়ে পালানোর সময় দর্শনা সীমান্ত থেকে আটক করা হয় আজিজুর রহমান আজিজকে। পরে তাকে মিন্টো রোড ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরে চাঁদাবাজির মামলায় আজিজকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালত পাঠানো হলে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। আজিজের বিরুদ্ধে হত্যা ও গুমসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় এখনো তার ২৫ থেকে ৩০টি ক্যাডার বাহিনী সক্রিয় বলে জানান ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী এরশাদ আলী।
তিনি বলেন, আজিজ বাহিনীর লোকেরা এলাকায় মহড়া দিচ্ছে। আজিজের হাতে নির্যাতিতরা এখন মুখ খুলছে। আমরা চাই আদালত যেন এই সন্ত্রাসীকে জামিন না দেন। তারা টাকা দিয়ে বের হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা চাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আদালত যেন তাকে জামিন না দেন।
তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমি দেশবাসীর কাছে ন্যায়বিচার চাই। যারা আমার প্রতিষ্ঠানের লুটপাট ও দখলের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে বারবার মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন এই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে আমাকে অনেকবার ডিবি অফিসে নিয়ে গেছে। টাকার কারণে আমি বেঁচে ফিরেছি। ২০১৭ সালে এভাবে তিনবার আমাকে তুলে নেওয়া হয়। প্রতিবার ৫০ লাখ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। সেই সময়ে ডিবির ডিসি আব্দুল বাতেন ও এডিসি লাকী আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে। টাকা পেলে তারা ছেড়ে দিত। টাকা না দিতে পারলে আমার লাশটাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত না। এভাবেই আমার ব্যবসা, টাকা-পয়সা সব শেষ। এখন শুধু আমার মেধা ও মার্কেটে শুনাম ছাড়া কিছুই নেই। আমি পুলিশ কর্মকর্তাসহ সবার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আদালতের মাধ্যমে আমি সঠিক বিচার পেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবো। আবার ব্যবসা শুরু করতে পারলে আমার মাধ্যমে দেশের মানুষ উপকৃত হবে। আবার কর্মসংস্থান ফিরে আসবে। এখন আমার যে জায়গা জমি আছে তা বিক্রি করা ছাড়া ব্যবসা চালু করতে পারবো না। আপনাদের মাধ্যমে আমি ন্যায়বিচার চাই।
ভুক্তভোগী এই ব্যবসায়ীর হয়ে মামলা লড়ছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহম্মদ জিয়াউদ্দিন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এরশাদ গ্রুপের মামলা আমি পরিচালনা করেছি। তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনেক রাজনৈতিক মামলাতে ওনাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। অনেকগুলো মামলা বিচারধীন অবস্থায় বিভিন্ন আদালতে আছে। তাকে হয়রানি করা পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেছিল, সেগুলো বিচারাধীন আছে। বিশেষ করে যে আজিজ স্টিল মিলের সব মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় তিনি মুখ খুলতে পারেননি। নানা ধরনের হুমকি দিয়েছে, একাধিকবার মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছিল। এখন যেন অন্তত তিনি আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পান সেই আশা। আদালত সবসময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে আসছেন।
শুধু আর্থিকভাবে নয় মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন উল্লেখ করে এরশাদ আলী বলেন, দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকায় আমার কিডনি ৮০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছি। বর্তমানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছি। তবুও আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছেন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবো।
কেআর/এএমএ/এএসএম

15 hours ago
4









English (US) ·