রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারী নিহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনার পর আড়াই ঘণ্টা মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল। এর আগে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরও ফার্মগেটে মেট্রোলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। ওইদিনও আগারগাঁও–মতিঝিল মেট্রোরেল চলাচল প্রায় ১১ ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
অভিযোগ উঠেছে, এসব বিয়ারিং প্যাড মানহীন। দুর্ঘটনায় নগরবাসীর নিরাপত্তা ঝুঁকি, ভবিষ্যৎ করণীয়, ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-ই বা কতটা ঝুঁকিমুক্ত? এসব নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যলয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. সামছুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মো. নাহিদ হাসান।
- জাগো নিউজ: অভিযোগ উঠেছে মেট্রোরেলের এই বিয়ারিং প্যাডগুলো মানহীন। দুর্ঘটনার মূল কারণ কি মানহীন সামগ্রী ব্যবহার নাকি অন্যকিছু?
ড. মো. সামছুল হক: দুর্ঘটনার সঙ্গে মানহীন বিয়ারিং প্যাডের সম্পর্ক নেই। মানহীন প্যাড লাগালে এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। যেটি ১৫ বছর অতিক্রম করার কথা ছিল সেটি হয়তো ১০ বছরের মধ্যেই পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু পড়ে যাবে কেন? পড়ে যাওয়া তো অন্য বিষয়, এখানে ঝুঁকিপূর্ণ কনস্ট্রাকশন হয়েছে। নির্মাণে কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ল্যাপস এবং গ্যাপস ছিল- এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এটা যাদের দেখে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল তারা টাকা ছাড় দিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, জাপানিদের রাখা হয়েছিল, কারণ তাদের অভিজ্ঞতা বেশি। কিন্তু তারা দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন না করে অর্থছাড় দিয়ে দিয়েছে। ঘটনা তো একটি নয়, পরপর দুটি দুর্ঘটনা ঘটলো। এখন শঙ্কা জাগে অন্যান্য জায়গায়ও এরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য কনসালট্যান্টকে (বিশেষজ্ঞ) দায়বদ্ধ করতে হবে যে নিম্নমানের কাজ (নির্মাণজনিত ত্রুটি) দীর্ঘস্থায়ী হবে কী হবে না। দুর্বল এবং নিম্নমানের কনস্ট্রাকশন ছিল এটা বোঝা যায়। নাট-বল্টু যেভাবে লাগানো হয়েছিল সেগুলো ঠিকভাবে লাগেনি।
আরও পড়ুন
ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যু
আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু
এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ট্রেনের ট্র্যাকের মধ্যে যেসব যন্ত্রাংশ থাকে, ঝাঁকুনি খেয়ে সেগুলো নড়ে যায়। এজন্য প্রতিনিয়ত এগুলোকে দেখভাল করতে হয়। এজন্য অতিসত্বর একটা রেসকিউ অডিট করা উচিত। আর কনসালট্যান্টকে দায়বদ্ধ করতে হবে। মানহীন হলেও এত তাড়াতাড়ি পড়ার কথা নয়। এটা কনস্ট্রাকশন জনিত সমস্যা। নির্মাণের ত্রুটি ছিল বলেই এটি ওপর থেকে পড়ে গেছে। যে কর্তৃপক্ষ কাজটি বুঝে নিয়েছে তাদেরও ঘাটতি আছে।
- জাগো নিউজ: মেট্রোরেল নির্মাণের সঙ্গে জাপান জড়িত ছিল। তাদের কাজের মান তো ভালো, কিন্তু আমাদের দেশে এমন খারাপ উদাহরণ তৈরি হলো কেন?
ড. মো. সামছুল হক: মেট্রোরেল নির্মাণে যে ত্রুটি তার দায় সরাসরি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে নিতে হবে। এর আগে যিনি মেট্রোরেলের এমডি ছিলেন, উনি না বুঝেই কাজগুলো করেছেন। কারণ উনি নন-টেকনিক্যাল পারসন। এই নন-টেকনিক্যাল লোকটা পুরোপুরি কনসালট্যান্টের ওপর ট্রাস্ট করেছিলেন। যার ফলে জাইকা নির্মাণের জন্য টাকা নিয়েছে বেশি এবং পরামর্শর্কের জায়গায় অতি মূল্যায়িত হয়েছে। তারা যখন দেখেছে এখানে বুঝে নেওয়ার মতো প্রতিযোগিতামূলক মেধাবী লোক নেই, তখন তারা তাদের মতো করে করে গেছে। এখন বুঝতেই পারছেন, একটা জিনিস পড়ে মানুষ মারা গেলে নিরাপত্তাঝুঁকি কতটা বেড়ে যায়।
আমি বলবো মেট্রো একটা নিরাপদ বাহন। কিন্তু এটার ওপর যদি পারসেপশন খারাপ হয়ে যায়, সরকারকে তার দ্বায়বদ্ধতার জায়গা স্পষ্ট করতে হবে।
আরও পড়ুন
আরও ১২ এক্সপ্রেসওয়ে ও ১০ এলিভেটেড নির্মাণের পরিকল্পনা
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড স্থাপনের কাজ শুরু
মেট্রোরেলে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা: রেল উপদেষ্টা
- জাগো নিউজ: মেট্রোরেল পুরোটাই উড়াল সড়কের ওপরে নির্মিত। নিচে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। নগরবাসীর জীবনের নিরাপত্তা কতটুকু ?
ড. মো. সামছুল হক: ঢাকা পুরোটাই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। আর মেট্রোরেল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই চালু করা হয়। কিন্তু কী ধরনের নিরাপত্তা থাকবে সে সবকিছু হয়তো আমাদের প্ল্যান এবং ডিজাইন আছে। আমি এটিই বলছি যে, মেট্রো যে একটা আশা জাগানিয়া প্রজেক্ট হয়েছে, এখন মেট্রো সম্পর্কে যদি অনিরাপদ পারসেপশন চলে আসে তাহলে খারাপ একটা উদাহরণ তৈরি হবে।
‘এখন আমাদের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা যাদের রাখি আমাদের কাজগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য, তারা সঠিকভাবে কাজগুলো করেনি। যারা ছিলেন তারা নন-টেকনিক্যাল লোক। যেসব নন-টেকনিক্যাল লোক ছিলেন তাদের আইনের সম্মুখীন করতে হবে। পৃথিবীর কোথাও এমন হয়নি যে প্রযুক্তিনির্ভর এমন কাজে একজন নন-টেকনিক্যাল লোককে এমডি বানানো হয়েছে।’
- জাগো নিউজ: মেট্রোরেলে দুর্ঘটনার পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে কি শঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে?
ড. মো. সামছুল হক: এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও একই অবস্থা। সেখানে যেসব বিয়ারিং প্যাড আছে, দুই/একটা ছবিও শেয়ার করা হয়েছে, প্যাডগুলো যে জায়গায় থাকার কথা সেই জায়গায় নেই। আমি মনে করি, যারা এসব প্রজেক্ট বানায় এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা, তারা যদি এই ধরনের ঘটনায় দায়বদ্ধ কাউকে না দেখে পরে মেইনটেন্যান্সে (রক্ষণাবেক্ষণ) আরও ওভারলুকের ঘটনা ঘটবে। মেনটেন্যান্সের কাজ করার জন্য স্পেশাল ডিভাইস লাগবে।
তিনি বলেন, মেট্রোরেল প্রতিদিন যাত্রা শুরুর আগে আগে দুইটা ট্রিপ দেয় যে ঠিক আছে কি না। একইভাবে অবকাঠামো ঠিক আছে কি না, এটা এত তাড়াতাড়ি দেখার কথা ছিল না। এখন তো ভয় ঢুকে গেছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে একটি রেসকিউ অডিট করা উচিত। তাহলে বোঝা যাবে অন্য কোনো জায়গায় ঝুঁকি তৈরি হয়ে আছে কি না। এগুলো দ্রুত আইডেন্টিফাই (শনাক্ত) না করলে আরও জনগণকে হয়তো প্রাণ দিতে হবে। যেসব মানুষ এগুলোর সঙ্গে জড়িতই নন, তারা মারা যাবেন এটা খুবই দুঃখজনক। বিদেশেও আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, তারা ভাববে নির্মাণে আমরা কিছুই পারি না। পুরো বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা আমাদের গুণগতমান নিশ্চিত করতে পারিনি।
এনএস/ইএ/জিকেএস

2 weeks ago
9









English (US) ·