লোকলজ্জা উপেক্ষা, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান সুলতানা

1 week ago 7

আধুনিক বিশ্বে নারীরা এখন আর বোঝা নয়, বরং সক্ষমতার প্রতীক। এই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন পাবনার ফরিদপুরের বাসিন্দা সুলতানা খাতুন। সংসারের বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পর সমাজের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে তিনি বেছে নিয়েছেন অটোভ্যান চালানোর পেশা। কোমল হাতে ভ্যানের হ্যান্ডেল ধরে সুলতানা কেবল নিজের উপার্জনই করছেন না, বরং তিনি হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

সুলতানা খাতুন (২৫) পাবনার ফরিদপুর উপজেলার বনওয়ারীনগর ইউনিয়নের সোনাহারা গ্রামের দরিদ্র মুনতাজ আলী ও বেলে খাতুন দম্পতির বড় মেয়ে। তার বাবা একজন দিনমজুর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অত্যন্ত দরিদ্রতার মাঝে বেড়ে ওঠা সুলতানার। তারপরও আর পাঁচটা নারীর মতো তারও স্বপ্ন ছিল বিয়ের পর বাঁধবেন সুখের ঘর। সাড়ে চার বছর আগে সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ি এলাকার এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তবে সেই সংসারে সুখের দেখা পাননি সুলতানা। স্বামী অটোভ্যান কেনার কথা বলে সুলতানার বাবার থেকে টাকা নিয়ে বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় পালিয়ে যান। এর এক বছর পর ফরিদপুর উপজেলার বিলচাদু গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে পারিবারিকভাবে আবার বিয়ে দেওয়া হয় সুলতানাকে। তবে সুলতানার কপালে বোধহয় সুখ ছিল না।

বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই মাদকাসক্ত দ্বিতীয় স্বামীর নির্মম নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হন। পরে বিয়ের ৩-৫ মাসের মাথায় স্বামীর সংসার ছাড়তে বাধ্য হন সুলতানা। এসে ওঠেন দরিদ্র বাবার বাড়িতে। বাবার বাড়তি বোঝা হয়ে ফিরে এসেছেন সুলতানা— শুরুতে তাকে শুনতে হয় এমন কটূকথা। কিন্তু সুলতানা বোঝা হয়ে থাকতে রাজি নন। তাই শুরু করেন সংগ্রামের জীবন। কোমল হাতে শক্ত করে ধরেন ভাড়ায়চালিত অটোভ্যানের হ্যান্ডেল।

লোকলজ্জা উপেক্ষা, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান সুলতানা

তবে ভ্যান চালিয়ে উপার্জিত আয়ে চলা কষ্টসাধ্য ছিল তার। রোদ-বৃষ্টিতে সারাদিন ছুটে চলার আয়ের বড় অংশ চলে যেতো ভ্যান ভাড়া দিতে। ওই সামান্য টাকায় আত্মনির্ভরতার জীবন শুরু। পরে মেয়ের কষ্ট দেখে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সুলতানাকে একটি অটোভ্যান কিনে দেন বাবা। সেই ভ্যানে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বনওয়ারীনগরসহ উপজেলার বিভিন্ন সড়কে ছুটে চলেন সুলতানা। দিন শেষে তার আয় ২০০-৩০০ টাকা। এ দিয়ে জীবন ও জীবিকা পরিচালনা হয় তাদের।

সুলতানার পরিবার জানায়, শুরুতে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মেয়ে হয়ে ভ্যান চালানোকে ভিন্নভাবে দেখতো প্রতিবেশী ও সমাজের অধিকাংশ। অনেকেই পরিবার ও সুলতানাকে নিয়ে কটূ কথাও শোনাতেন। দোকানপাট বা আড্ডাখানায় তাকে নিয়ে নানা ধরনের কথা হতো। কিন্তু এখন সেটি অনেকটাই কমেছে। সুলতানাকে অন্য সব শ্রমিক বা ভ্যানচালকের মতো স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখতে শুরু করেছেন তারা।

সুলতানার মা বেলে খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে। আমরা গরিব, তাই ওর কষ্টটা বেশি। ও এখন ভ্যান চালায়। এটা শুনে অনেকেই হাসে, কিন্তু আমি গর্ব করি। আমার মেয়ে নিজের শ্রমে সংসার চালাচ্ছে।’

এ বিষয়ে সুলতানা খাতুন বলেন, ‘শুরুতে সবাই হাসাহাসি করতো। বলতো মেয়ে মানুষ ভ্যান চালাবে? সবার নানা রকম ঠাট্টা-বিদ্রুপে বিব্রত হতাম। কিন্তু এখন আর সেটি খুব একটা হই না। আর আমিতো কাজ করছি, কোনো অন্যায় করছি না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব। আমাদের শুয়ে আরাম-আয়েশে জীবন চলে না। তাই নিজ শ্রমে ঘামে নিজের সংসার চালাচ্ছি। তাতে কারোর সাহায্য না পেলেও আমি থামবো না। কারও বোঝা হয়ে না থেকে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।’

সুলতানার প্রশংসা করে প্রতিবেশী আমেনা বেগম বলেন, ‘একটা মেয়ের রাস্তাঘাটে ভ্যান চালানো স্বাভাবিক কিছু নয় বলেই সবাই জানে। একে অনেকে লজ্জা শরমের বিষয় হিসেবেও দেখে। এটা অসম্ভব বলেই আমাদের ধারণা ছিল। কিন্তু সুলতানাকে দেখে সেই ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভ্যান চালায় কিন্তু মুখে কোনো অভিযোগ নেই। এমন মেয়ে সচরাচর কয়টা হয়? আমরা এখন তাকে নিয়ে গর্ববোধই করি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘যুগ পাল্টেছে। এখন নারী-পুরুষ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। নারীরা এখন আর ঘরে বসে নেই। এটি খারাপ কিছু নয়। সুলতানা একটি উদাহরণ। সে খুব পরিশ্রমী ও সাহসী মেয়ে।’

এ বিষয়ে ফরিদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুব হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে কেউ অন্যায় ব্যতীত যে কোনো ধরনের কাজ করতে পারেন। এটিকে নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। যারা দেখেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো উচিত। সুলতানার এ পরিশ্রমকে আমরা সম্মান জানাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘তার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। সে কিভাবে তার জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে চায়, সে বিষয়ে আলাপ করেছি। পরে সে অনুযায়ী তার থেকে একটা লিখিত আবেদন নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছি। আশা করছি, দ্রুতই সহজ আয়ের একটি ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারবো।’

আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসআর/জিকেএস

Read Entire Article