কিছুদিন আগে খবরের শিরোনামে এসেছিল—ফেসবুকে একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দুই তরুণের মধ্যে শুরু হয় তর্কাতর্কি, পরে তা রূপ নেয় মারামারিতে, আর শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারান একজন। এমন ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত। কোনো রাজনৈতিক পোস্টে মতের অমিল, কোনো ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্ক, কিংবা কেবল ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি—এ সামান্য বিষয়গুলোই আজ সমাজে ঘৃণা, হিংসা ও হত্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যা হওয়ার কথা ছিল মতপ্রকাশের মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, তা আজ অনেক সময় পরিণত হচ্ছে ঘৃণার কারখানায়।
অসহিষ্ণু বিশ্বের প্রতিচ্ছবি
বিশ্বজুড়ে আজ এক ধরনের অদৃশ্য বিভাজন বেড়ে উঠছে। রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি কিংবা মতাদর্শ—সবখানেই দেখা যাচ্ছে ভিন্নমতের প্রতি অনীহা ও অসহিষ্ণুতা। ডিজিটাল যুগে তথ্যের প্রাচুর্য থাকলেও মানুষ ক্রমে একপাক্ষিক হয়ে পড়ছে। কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে ‘শত্রু’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতি কখনো একমুখী চিন্তার ফল নয়; বরং বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও যুক্তিনির্ভর আলোচনাই সমাজকে সমৃদ্ধ করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহিষ্ণুতার ক্ষয়
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সহাবস্থানের ভূমি। এই দেশের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ধর্মীয় ও সামাজিক বহুত্ববাদে। লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম শিখিয়েছেন—ভিন্ন চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধা ও মানবতার প্রতি বিশ্বাসের শিক্ষা।
কিন্তু সাম্প্রতিক বাস্তবতা বলছে, আমরা ধীরে ধীরে সেই ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্যের ভিন্নতায় শত্রুতা, রাজনীতিতে মতানৈক্যের নামে সহিংসতা, এবং ধর্মীয় বিভাজন—সব মিলিয়ে সমাজে অসহিষ্ণুতার গভীর ছায়া নেমে এসেছে।
তরুণ প্রজন্ম, যারা একসময় পরিবর্তনের প্রতীক ছিল, তারাই এখন অনেক সময় ডিজিটাল বিভাজনের শিকার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, রাজনৈতিক অঙ্গনে, এমনকি অনলাইনেও দেখা যায়—আলোচনার জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে, জায়গা নিচ্ছে ‘আমি ঠিক, তুমি ভুল’ মানসিকতা।
এই মনোভাব কেবল যুক্তির পরিসরই সংকুচিত করছে না, সমাজের মানসিক সুস্থতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বিশ্বের সহিষ্ণু সমাজের শিক্ষা
বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে—সহিষ্ণুতা সমাজ পরিবর্তনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও কানাডার মতো দেশে ‘Tolerance Education’ শিশুদের পাঠ্যক্রমের অংশ। তারা শেখে—ভিন্নমত মানে শেখার সুযোগ, ঘৃণার কারণ নয়।
আবার দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা দেখিয়েছেন, প্রতিশোধ নয়, ক্ষমাই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। নিউজিল্যান্ডেও দেখা গেছে, সহানুভূতি ও সহিষ্ণুতা কীভাবে জাতীয় সংহতির প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
এই উদাহরণগুলো আমাদের শেখায়—রাষ্ট্রের অগ্রগতি কেবল প্রযুক্তি বা অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে না; তা নির্ভর করে সমাজ কতটা মানবিক ও সহিষ্ণু হতে পেরেছে তার ওপর।
তরুণদের ভূমিকা ও করণীয়
বাংলাদেশের তরুণরা দেশের জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ। তাই সহিষ্ণু সমাজ গড়ার প্রথম দায়িত্বও তাদের কাঁধেই। তরুণদের শিখতে হবে—ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, শোনা, এবং যুক্তি দিয়ে উত্তর দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক ক্লাব, পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক সংগঠন কিংবা অনলাইন কমিউনিটিগুলো হতে পারে এ চর্চার ক্ষেত্র।
শিক্ষাব্যবস্থায়ও সহিষ্ণুতা শেখানোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পাঠ্যক্রমে মানবিকতা, সংলাপ ও যুক্তিনির্ভর চিন্তার জায়গা তৈরি করতে হবে। মিডিয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে এমন পরিবেশ গঠনে, যেখানে মতের পার্থক্যকে দমন নয়, উৎসাহ দেওয়া হবে।
আগামীর মানবিক বাংলাদেশ
একটি সহিষ্ণু বাংলাদেশ মানে এমন এক সমাজ, যেখানে মতের ভিন্নতা বিভাজন নয়, বরং উদ্ভাবনের অনুপ্রেরণা। যেখানে ধর্ম, রাজনীতি বা ভাষার পার্থক্য সত্ত্বেও মানুষ মানুষকে সম্মান করবে।
সহিষ্ণুতা দুর্বলতা নয়—এটি সভ্যতার শক্তি। যারা সহিষ্ণু, তারাই আসলে শক্তিশালী; কারণ তারা চিন্তা ও মতের বৈচিত্র্যকে ভয় পায় না। আজকের তরুণদের মধ্যে যদি আমরা সেই মানবিক শক্তি জাগাতে পারি, তবে আগামীর বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র।
সহিষ্ণু সমাজ গঠনের লড়াই আসলে মননের লড়াই। সেই লড়াইয়ে তরুণদের হাতে থাকতে হবে যুক্তি, সহমর্মিতা ও মানবিকতার আলোকবর্তিকা। এই চর্চাই গড়ে তুলবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু বিভেদ থাকবে না; থাকবে শুধু বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা ও মানবতার জয়গান।
লেখক : রানা সরকার, ইয়ুথ অ্যাক্টিভিস্ট ও শিক্ষার্থী আইন বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

2 hours ago
2









English (US) ·