সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সমাজ ও রবীন্দ্রনাথ

1 hour ago 6

এখনকার প্রজন্ম কী করে জানি না, কিন্তু আমাদের শৈশবে বাড়ির থেকে অনতিদূরে ছোট নদীর ধারে গেলেই চোখের সামনে ভেসে উঠতো পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠায় একটি আঁকাবাঁকা নদী, পাশে ছোট বাড়ি, কয়েকটি কিশোরের জলকেলির স্থির ছবি। সেই ছবির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতা জীবন্ত হয়ে উঠতো। বিকেলে বা সন্ধ্যায় মায়ের হাত ধরে মধ্যবিত্ত কোনো শিক্ষিত পরিবারে বেড়াতে গিয়ে দেখতাম, মাথাভরা চুল, লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা রবীন্দ্রনাথ দেয়ালের ফ্রেমের ভেতর থেকে বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছেন আমারই দিকে। শৈশব-কৈশোরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামেও এই মানুষটিই মুখ্য, অপরিহার্য হয়ে উঠতেন। রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের করে ধারণ করা শুরু সেখান থেকেই। দেশকে ভালোবাসার প্রথম পাঠ বা দেশপ্রেম কী তা প্রথম আমরা অনুধাবন করেছি স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ‘আমার সেনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি/ চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’ গাইতে গাইতে। 

এই রাবীন্দ্রিক আবহেই আমার মত দেশের অনেক সন্তান বড় হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বয়স বেড়েছে। কেউ কবি, কেউ লেখক, কেউ সচিব বা কূটনীতিক হয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে এসে জীবনের সূর্য যখন চূড়ায় উঠে ঢলে পড়তে শুরু করেছে, তখন দেখতে পাই ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের ছবি ফিকে হয়ে আসছে। একদিকে সমাজে রবীন্দ্র চর্চা সীমিত হয়ে গেছে, অন্যদিকে চলছে তাকে অপ্রাসঙ্গিক করার জোর প্রয়াস-আয়োজন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চূড়ান্তভাবে রবীন্দ্রনাথকে আওয়ামী লীগার বানানোর অপচেষ্টা চলছে; ভাস্কর্য

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে দেখা গেছে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য, ছবি ভাঙচুর করা হয়েছে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের পরিস্থিতি এখন এমন যে কেউ না জানলে মনে করবে, লম্বা দাড়ি-চুলের এই মানুষটি বুঝি শেখ হাসিনার দলের মন্ত্রী অথবা ঘোর সমর্থক ছিলেন! একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি এই বিদ্বেষ, এই ভাস্কর্য ভাঙার মানসিকতা এই সমাজে নতুন নয়, ৫ আগস্টের পর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মাত্র। ২০১৭ সালে তথাকথিত প্রগতিশীল আওয়ামী লীগের সময়ে পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয় রবীঠাকুরের দেশপ্রেমের কবিতা-গান ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’।

শেখ হাসিনার শাসনামলেই তথ্য প্রযুক্তির সুবাদে ভিডিও দেখেছি, ইউটিউবে ধর্মের লেবাসধারী একাধিক লোককে বিষোদ্‌গার করতে দেখেছি, যাদের সঙ্গে কবিগুরুর কোনোই লেনদেন নাই। রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, ‘আকাশ কী তোর বাপের!’ অথচ এই সমাজে ওই ব্যক্তিরা তিরস্কৃত নয়। শুধু এই লোক বা ইউটিউবার নয়, দেশে অর্ধ-শিক্ষিত অশিক্ষিত এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত কিছু মানুষও লিখে ফেলছেন, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিল এবং হিন্দুর সাহিত্যই কেবল রচনা করেছেন। তিনি কখনো মুসলমানদের নিয়ে লেখেননি! এবং বলতে বলতে এই ধারণা  অসংখ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।

এক ধরনের দেখতে শিক্ষিত লোকও ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে চোখ বড়বড় করে বলে আসছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছেন। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস মাত্র। কোনো প্রমাণ বা রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখায় এমন কোনো দৃষ্টিভঙ্গির চিহ্নমাত্র নেই! রবীন্দ্রনাথ জীবনে তিনবার ঢাকা সফর করেছিলেন। এর দুবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর। ১৯২৬ সালে তিনি যখন ঢাকায় আসেন তখন কে তাকে কাছে রাখবেন, কে তাকে আপ্যায়ন করবেন তা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিখ্যাত অধ্যাপক আর সি মজুমদার, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র এবং ঢাকা কলেজের অধ্যাপক অপূর্ব কুমার চন্দসহ আরো অনেকে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ তাদেরই বাড়িতে থাকবেন।

যারা রবী ঠাকুরের ‘গোরা’ অথবা ‘ঘরে বাইরে’ পড়েছেন তারা জানেন রবীন্দ্রনাথ মুসলমান চরিত্রকে কতটা ইতিবাচকভাবে বর্ণনা করেছেন। এক ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মত সম্প্রীতির গল্প বাংলা সাহিত্যে কয়টি সৃষ্টি হয়েছে? গল্পের রহমত খাঁ চরিত্রের প্রতি দরদের কারণে মানুষের মধ্যে কাবুলিদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গিয়েছিল। আরো আছে- বিশ্বভারতীতে আরবি সাহিত্য ও দর্শনের অধ্যাপক নিয়োগের জন্য হায়দারাবাদের নিজাম রবীন্দ্রনাথকে অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন। বিশ্বভারতীতে আজও আরবি, ফারসি ও ইসলামিক স্টাডিজের একটি বিভাগ রয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইয়ের নাতনি এনা দেবী থাকেন ঢাকায়। তিনিও চাইলেন কবি তার বাড়িতে থাকুন। কিন্তু রবিঠাকুর মনস্থির করেছিলেন, তিনি ঢাকার নবাবদের ‘তুরাগ’ নামের হাউসবোটে থাকবেন। কিছু লোক রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতার কথা সত্য বলে প্রমাণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ১৯১২ সালে গড়ের মাঠে বিরাট জনসভা হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। প্রমাণিত সত্য হল, রবীন্দ্রনাথ তখন অসুস্থ হয়ে শিলাইদহে অবস্থান করছিলেন। অসংখ্য কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ কবি এই শিলাইদহে বসেই লিখেছেন। ‘আমাদের ছোট নদী’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ এই শিলাইদহে বসেই লেখা। রবী ঠাকুরকে নিয়ে এই ভূমিতে মিথ্যাচারের আরো অনেক প্রমাণ আছে।

কেন রবীন্দ্রনাথের উপর এই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে পাঠ করা থেকে বাংলাদেশের সমাজকে বঞ্চিত করত চেষ্টা করা হচ্ছে তা একেবারে অজানা নয়। যে অল্পসংখ্যক মানুষ রবীন্দ্রনাথকে বুঝেছেন বা বোঝার সৌভাগ্য হয়েছে; যাদের যৎসামান্য রবীন্দ্র পঠন-পাঠন আছে তারা জানেন, বিদ্বেষ তো নয়ই, বরং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যাপারে কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা দিলেই যে কেউ অনুধাবন করবেন সত্যটা কী। ১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইতে ‘পয়গম্বর দিবস’ পালন করা হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি আলি আকবর খাঁ। সেই উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি বাণী পাঠান যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘জগতে যে সামান্য কয়েকটি মহান ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম তাদেরই অন্যতম।’

১৯৩৪ সালে তিনি নবী মুহাম্মদ(স.)-এর জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের যে বাণী বেতারে সম্প্রচারিত হয়, সেখানে তিনি বলেছিলেন, “ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে তার অনুবর্তিগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাদের সাক্ষ্য দিতে হবে। ....আজকের এই পুণ্য অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মুসলিম ভাইদের সঙ্গে একযোগ ইসলামের মহাঋষির উদ্দেশে আমার ভক্তি উপহার অর্পণ করে উৎপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তাঁর আশীর্বাদ ও সান্ত্বনা কামনা করি।”

যারা রবী ঠাকুরের ‘গোরা’ অথবা ‘ঘরে বাইরে’ পড়েছেন তারা জানেন রবীন্দ্রনাথ মুসলমান চরিত্রকে কতটা ইতিবাচকভাবে বর্ণনা করেছেন। এক ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মত সম্প্রীতির গল্প বাংলা সাহিত্যে কয়টি সৃষ্টি হয়েছে? গল্পের রহমত খাঁ চরিত্রের প্রতি দরদের কারণে মানুষের মধ্যে কাবুলিদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গিয়েছিল। আরো আছে- বিশ্বভারতীতে আরবি সাহিত্য ও দর্শনের অধ্যাপক নিয়োগের জন্য হায়দারাবাদের নিজাম রবীন্দ্রনাথকে অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন। বিশ্বভারতীতে আজও আরবি, ফারসি ও ইসলামিক স্টাডিজের একটি বিভাগ রয়েছে।

নিজের শরীর দিয়ে মানুষের বর্জ্যের গন্ধ বের হয়  যার, সেও রবীন্দ্রনাথের মলের মধ্যে গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই প্রবণতা ভালো নয়। এই প্রবণতা আমাদের কেবল অন্ধকারেই ঠেলে দেবে। তাকে টেনে এনে এই দেশ থেকে বিতাড়িত করে আপনারা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন? রাজনীতিতে অনেক ওলটপালট হয়, সব দেশেই। তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা হতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আওয়ামী ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা শুধু সংকীর্ণতা ও হাস্যকরই নয়, জাতির জন্য এক ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা। এই চেষ্টা কিন্তু দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

লেখক:  সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article