সুখী পরিবার গঠনে কোরআনের নির্দেশনা

2 weeks ago 18

অনুবাদ: মওলবি আশরাফ

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র। সুতরাং তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে গমন করো এবং নিজেদের জন্য ভবিষ্যতের বন্দোবস্ত কর, আল্লাহকে ভয় করো, আর জেনে রেখো যে, তোমাদেরকে তার কাছে হাজির হতে হবে। আর ইমানদারদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। (সুরা বাকারা: ২২৩)

এ আয়াতের একটি অর্থ তো অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর একান্ত সম্পর্ক নিয়ে। পাশাপাশি এ আয়াতটিকে পারিবারিক জীবন সুখময় করার সবচেয়ে কার্যকর উপদেশ হিসেবেও গ্রহণ করা যায়।

দেখুন, ‘স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র’—এই বাক্যটি এক গভীর ও অর্থবহ উপমা। শস্যক্ষেত্র সব সময় ভবিষ্যতের শস্যের জন্য হয়। একজন পুরুষ যখন কোনো নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে, তখন সে আসলে নিজের ভবিষ্যতের জন্য একটি শস্যক্ষেত্র বেছে নেয়—যেখানে সে এমন এক শস্য ফলাবে, যা তার দুনিয়ার জীবনেও কল্যাণ বয়ে আনবে, আখেরাতেও সওয়াবের কারণ হবে।

একজন পুরুষ যখন বিয়ে করে কোনো নারীকে ঘরে আনে, তখন প্রথমদিকে সেই নারী থাকে তার গৃহসঙ্গী বা home partner। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সে হয়ে ওঠে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্গী বা intellectual partner।

পারিবারিক জীবনের জন্য নারী প্রকৃতিগতভাবেই প্রস্তুত থাকে, কিন্তু চিন্তা, উপলব্ধি ও জীবনবোধে স্বামীর ‘সহধর্মিণী’ হয়ে উঠতে হলে তাকে তৈরি করতে হয়। এই দায়িত্ব পুরুষের। সে যেন বিয়ের পর স্ত্রীর ভেতরের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে—যেন দুজনেই একে অপরকে বুঝতে শেখে, পরস্পরের চিন্তা ও বিশ্বাসে অংশ নেয়, এবং একসঙ্গে সেই পথে চলে, যা আল্লাহ তাদের জন্য ঠিক করে রেখেছেন। এভাবেই তারা পৌঁছাতে পারবে সেই সুন্দর জীবনে—যা আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী দুনিয়াতেও শান্তির, আর আখেরাতেও সফলতার।

অনেকের জীবনই এমন হয়—বিয়ের পর শুরুতে স্ত্রীকে অনেক ভালো লাগে, তার প্রতি খুবই আকর্ষণ কাজ করে, কিন্তু কিছুদিন পর সেই আকর্ষণ ম্লান হয়ে যায়। এর কারণ স্ত্রী নয়, তার কোনো দোষ নেই; বরং আকর্ষণ হারানোর আসল কারণ হলো: সেই পুরুষটি কখনও স্ত্রীকে এমনভাবে গড়ে তোলেনি যে সে তার দীর্ঘ জীবনের intellectual partner বা বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্গী হতে পারে।

উল্লখিত আয়াতের মূল শিক্ষা এই কথায় নিহিত—‘নিজেদের জন্য ভবিষ্যতের বন্দোবস্ত করো’ অর্থাৎ বিবাহিত জীবনকে শুধু দেহের সম্পর্ক হিসেবে নয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণের উপায় হিসেবে গড়ে তোলো। স্ত্রীকে এমনভাবে প্রস্তুত করো যেন সে শুধু ঘরের সঙ্গিনী নয়, চিন্তা, উপলব্ধি ও জীবনের পথেও তোমার প্রকৃত সহচর হতে পারে। এই সম্পর্কই হবে তোমাদের ভবিষ্যৎ—দুনিয়ার কল্যাণে ও আখেরাতের সাফল্যে।

বাস্তবতা হলো—যদি কোনো পুরুষ সত্যিকার অর্থে নিজের স্ত্রীকে intellectual partner বা বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্গী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তবে সে জীবনে এমন এক বুদ্ধিমান সঙ্গী পায় যে সর্বক্ষণ তার পাশে থাকে—চিন্তার সময়, সিদ্ধান্তের মুহূর্তে, সুখে-দুঃখে, আলাপ-আলোচনায়। এমন একজন সঙ্গী নিঃসন্দেহে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

অনেক স্বামীরা স্ত্রীকে গৃহসঙ্গী বা home partner হিসেবেই দেখে থাকে—এটি সঠিক নয়। স্ত্রীকে জীবনসঙ্গী বা life partner হিসেবে দেখতে হবে। দাম্পত্যের লক্ষ্য শুধু সংসার টিকিয়ে রাখা নয়, বরং এমন এক যৌথ জীবন গড়া, যেখানে দুজন মানুষ একে অপরের চিন্তা, দায়িত্ব ও ভবিষ্যতের অংশীদার হয়।

স্বামী ও স্ত্রী—দুজনেরই কর্তব্য হলো সংসার জীবনকে আরও বিস্তৃত পরিসরে দেখা। আল্লাহর সৃষ্টির পরিকল্পনা অনুযায়ী মানুষের জীবন কেবল এই দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মৃত্যুর পরের জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই এই পার্থিব জীবনে আমাদের এমনভাবে চলতে হবে, যেন এই জীবনের প্রতিটি দিন আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে সফলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দাম্পত্যজীবনও সেই প্রস্তুতিরই অংশ—যেখানে দুজন মানুষ একে অপরকে জান্নাতের পথে সহযাত্রী করে তোলে।

লেখক: বিশ্বখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক

ওএফএফ

Read Entire Article