আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০-১৫টি আসন দেওয়ার বা বিরোধী দল করার আশ্বাস দিলে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ গণভোটের দাবি থেকে সরে যাবে বলে মনে করেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) ও জার্মান ফাউন্ডেশন ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটুং (এফইএস) আয়োজিত কর্মশালায় নুর এ কথা বলেন।
জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি মনে করেন, বিদ্যমান বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচনের আগে আরেকটি গণভোট আর্থিক ও প্রশাসনিক কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং একইসঙ্গে দুটি ভোট হবে- গণভোট ও জাতীয় ভোট।
নুর বলেন, ‘আমাদের গণভোট আমরা ডিমান্ড করেছিলাম। সেই গণভোট হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে। এখন আবার হঠাৎ করে আগে করতে হবে (বলা হচ্ছে)। এটা একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্ড। টু বি অনেস্ট, কেউ কেউ ১০-১৫টা সিট নিয়ে বার্গেনিং করতেছে। তাকে যদি ১০-১৫টা সিটের আশ্বস্ত দেয়, সে এই (আগে গণভোট) দাবি থেকে সরে যাবে। আবার কেউ কেউ বিরোধী দল হওয়ার জন্য বড় দলগুলোর রিকগনিশন চাচ্ছে। সেটা যদি তারা ভেতরে সেটেল করে, গণভোট তাদের কাছে কোনো ইস্যু না। এই হিপোক্রাসি আমাদের লিডারদের মধ্যে আছে।’
সিজিএস সংলাপ
তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে মতাদর্শভিত্তিক সংলাপ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করার লক্ষ্যে এফইএসের সহযোগিতায় সিজিএস এরই মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে পলিটিক্স ল্যাব শীর্ষক চারটি ধারাবাহিক কর্মশালার আয়োজন করেছে। এর ধারাবাহিকতায় সিজিএস আজ এ জন-সংলাপের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশ নেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, এফইএস বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি ফিলিক্স গ্রাদেস, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা ও সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী। সিজিএসের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সিজিএসের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান বলেন, লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে অনেক দেশ বাংলাদেশের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, যা হতাশাজনক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ অস্থিতিশীল। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনে নাকি ব্যালট বাক্স চুরি হয়ে যেতে পারে এবং পুলিশ ছাড়াই নিজেরা একটি ভালো নির্বাচন আয়োজন করতে পারবেন। এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, তিনি কেমন ধরনের নির্বাচন করতে চান বা তার সক্ষমতা কতটুকু।
জিল্লুর রহমান বলেন, আমাদের উচিত জনগণের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। এই মৌলিক গণতান্ত্রিক দায়িত্ব আমরা এখনো পালন করতে পারিনি, অথচ সুস্থ রাজনৈতিক বিকাশের জন্য সেটিই সবচেয়ে জরুরি।
আরও পড়ুন
চার ক্যাম্পাসে শিবিরের ভূমিধস জয় রহস্যজনক: নুর
বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে কলঙ্কিত করা হয়েছে
হাসিনাকে ফিরিয়ে আইনের মুখোমুখি করুন: ভারতকে ফখরুল
ফিলিক্স গ্রাদেস বলেন, বিশ্বজুড়ে ‘জেন জি’-এর নেতৃত্বে আন্দোলন শ্রীলঙ্কা থেকে মাদাগাস্কার পর্যন্ত ছড়িয়েছে। যেখানে সরকার পতনের পর নতুন প্রজন্ম সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে বহু গভীর সমস্যা রয়েছে, যা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সংলাপ এবং গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র রক্ষার একমাত্র উপায় নয়। নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম এবং গবেষণা খাতকে শক্তিশালী করাই সুশাসনের পথে এগিয়ে যাওয়ার মূল উপায় হতে পারে। তিনি আশা করেন তরুণ রাজনীতিকরা পলিটিক্স ল্যাবের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজের কল্যাণে কাজ করবে।
জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, সংস্কার, বিপ্লব ও নৈরাজ্যের মধ্যে পার্থক্যটি এখনো অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। সংস্কার মানে মেরামত, কিন্তু তার সীমা কোথায়? বিপ্লব ও নৈরাজ্যের মধ্যকার রেখাটাই বা কী? তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে এই বিভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। তবে যখন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতারাও সচেতনভাবে এই অস্পষ্টতাকে উপেক্ষা করেন, তখন সেটি গভীরভাবে বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, প্রকৃত অর্থে সংস্কার করতে হলে মতবিনিময়, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ঐকমত্যের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া জরুরি।
পারভেজ করিম আব্বাসী জানান, তারা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে তরুণ রাজনীতিকদের মতবিনিময়ের সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন পলিটিক্স ল্যাবের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মূল দাবি ছিল সুশাসনের প্রতিষ্ঠা। দেশে ৫১ শতাংশ নারী থাকা সত্ত্বেও অভ্যুত্থানের পর আমরা তাদের অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। অথচ নারীরা আমাদের অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি, এবং অভ্যুত্থানেও তাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এসব সমস্যার মূল কারণ হলো আমরা এখনো সহনশীলতার চর্চা করতে শিখিনি। সেই সহনশীলতা, রাজনৈতিক শিক্ষা এবং দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে বহুত্ববাদের অনুশীলনই পলিটিক্স ল্যাবের মূল উদ্দেশ্য।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, তারা যখন ছাত্র ছিলেন তখন ভিন্ন মতাদর্শের সবার একসঙ্গে বসা তো দূরের কথা, একে অপরের সঙ্গে কথা বলাও প্রায় অসম্ভব ছিল। এখন তরুণ রাজনীতিকরা একসঙ্গে বসতে পারছেন, এটাই একটি বড় পরিবর্তন এবং ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। যারা রাজনীতিকে ঘৃণা করেন, তারা নিজের কাছে প্রশ্ন করবেন রাজনীতি ছাড়া কি চলা সম্ভব?
তিনি আরও বলেন, বাস্তবতা হলো যে মূলধারার দুটি দল ও এনসিপি এখন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। যেখানে বিএনপি যেন সরকারে এবং বাকি দুটি দল বিরোধী দল হিসেবে অবস্থান করছে। কিন্তু এই দুই দল ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন আর দেখা যায় না।
মজিবুর রহমান মঞ্জুর মতে, নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে হবে। তিনি আরও মনে করেন, বাংলাদেশে যদি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো না থাকতো, তাহলে রাজনীতি আরও উন্নত হতো। বিএনপি যদি কিছুটা নমনীয় হয়ে নিজের অবস্থান থেকে সরে এসে সমঝোতার পথে আসতে পারতো তাহলে গণভোট বা জুলাই সনদ নিয়ে এত বিতর্ক থাকতো না। তিনি যোগ করেন, নারীদের সংরক্ষিত আসন বাস্তবায়ন এবং আসন বিন্যাস নিয়ে এখনো মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, যত দ্রুত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তত দ্রুতই গণভোট বিতর্কসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সমস্যা দূর হবে। তিনি জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাসকে তিনি এবং তার দল জুলাই সনদে প্রতিফলিত হতে দেখেননি। সেই কারণেই তাদের দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি, কারণ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিষয়ে কোনো ছাড় তারা দিতে রাজি নন।
তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটির কোনো কার্যকর ক্ষমতা নেই। আর বাকি ছয়টি কমিশনে যেখানে প্রকৃত সংস্কারের প্রয়োজন ছিল, সেখানে সংবিধানকেই কেবল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গণভোটের সমাধান কী হবে বা জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। তিনি আরও বলেন, একটি নির্বাচিত সংসদ গঠন করতে হবে এবং সেই সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে সংস্কারগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, এই সরকার নয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে একত্রে ধারণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
এসএম/একিউএফ/এএসএম

21 hours ago
4









English (US) ·