৪৭তম আসিয়ান সম্মেলনে প্রত্যাশা

2 weeks ago 17

৪৭তম আসিয়ান সম্মেলন এই সপ্তাহে মালয়েশিয়ার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মানচিত্র পুনর্গঠন করছে।

বিরোধী শক্তিগুলোর একই ছাদের নিচে বসার বিরল কয়েকটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে আসিয়ান অন্যতম, যা এবার পরীক্ষায় ফেলবে সংগঠনটির বড় শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলানোর সক্ষমতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জোরদার করা এবং জনগণকেন্দ্রিক এজেন্ডাকে বিশ্বাসযোগ্য রাখার ক্ষমতা।

এই সম্মেলন আবারও আসিয়ানের সমন্বয় শক্তি প্রদর্শন করবে, যেখানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের নেতারা উপস্থিত থাকবেন—যাদের মধ্যে থাকবেন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান এবং এক পরিচিত মুখ, যার উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফের আসিয়ান মঞ্চে আগমন—২০১৭ সালের পর এই প্রথম—সম্মেলনের মূল আকর্ষণ হতে যাচ্ছে।

সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস–ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের জোয়ান লিন বলেন, ট্রাম্পের আগমন যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক ফোরামে ফিরিয়ে আনছে, যেটিকে তারা গত কয়েক বছর দূরত্বে রেখেছিল, যদিও ইন্দো-প্যাসিফিক এখন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু।

তিনি বলেন, মার্কিন শুল্ক আরোপ ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিভক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের অংশগ্রহণ এক আকর্ষণীয় সময়ে এসেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় দৃশ্যমান করে তুলছে। তবে তার উপস্থিতি সম্মেলনের অন্যান্য এজেন্ডাকে ছাপিয়ে যেতে পারে এবং আসিয়ানের বৃহত্তর আঞ্চলিক আলোচনাকে দুর্বল করতে পারে।

লিন আরও বলেন, আসিয়ান নেতারা এই সুযোগে শুল্কনীতি, সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ জানাতে পারেন।

মালয়েশিয়ার সাবেক সিঙ্গাপুর হাইকমিশনার ইলাঙ্গো কারুপ্পানন মনে করেন, এ সম্মেলন হবে ‘নীতির চেয়ে ধারণার যুদ্ধ’।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অনুপস্থিত থাকবেন এবং তার স্থলে প্রিমিয়ার লি চিয়াং উপস্থিত হবেন। এতে ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে এক ধরনের ‘দৃশ্যমান আমেরিকান ঝোঁক’ তৈরি হতে পারে।

ইলাঙ্গো বলেন, ‘যখন ট্রাম্পকে আসিয়ান নেতাদের মাঝে দাঁড়ানো অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে দেখা যাবে, তখন তা দেখাবে যেন আসিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকেছে।’

তবে তিনি যোগ করেন, ‘এই প্রতীকী ভারসাম্যহীনতা আসলে দুই পরাশক্তিকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে আরও আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করবে।’

এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন বেশ কয়েকজন নতুন নেতা—জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি, দক্ষিণ কোরিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লি জে-মিউং এবং নির্বাচনের পর থাইল্যান্ডের নতুন সরকার।

এবারের সম্মেলনের অন্যতম বড় ঐতিহাসিক মুহূর্ত হচ্ছে তিমুর-লেস্তের আসিয়ানের ১১তম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি। লিন বলেন, ‘১৪ বছর আলোচনার পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভৌগোলিক মানচিত্র এখন পূর্ণতা পাচ্ছে। এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বের প্রতীক।’

ইলাঙ্গো যোগ করেন, ‘এটি ১৯৯০-এর দশকের পর আসিয়ানের প্রথম সম্প্রসারণ এবং মালয়েশিয়ার সভাপতিত্বে এক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।’ তবে তিনি সতর্ক করেন, ছোট ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে সংহত করা সংগঠনের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হবে।

ভূ-রাজনীতির ছায়ায় থেকেও অর্থনীতি এবারও সম্মেলনের মূলভিত্তি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল ইকোনমি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, আসিয়ান জিওইকোনমিক টাস্কফোর্স ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্রাটেজি—এই তিনটি বিষয় হবে সম্মেলনের মূল ডেলিভারেবল।

লিন বলেন, ‘এসব কেবল রাজনৈতিক বুলি নয়; বরং শুল্ক ধাক্কা মোকাবিলা ও সরবরাহ চেইন মজবুত করার বাস্তব কাঠামো।’ তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল কাঠামোর আওতায় ভবিষ্যতে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ডিজিটাল বাণিজ্য পরিচালিত হতে পারে—যা ‘অভূতপূর্ব’।

ইলাঙ্গোর মতে, মালয়েশিয়ার বাস্তববাদী নেতৃত্ব আসিয়ানকে কথার চেয়ে কাজে এগিয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন শক্তির প্রতিযোগিতার মাঝেও আসিয়ানের মূলশক্তি থেকে যায় তার মধ্যস্থতা ও শান্তি রক্ষার ক্ষমতা।

লিন বলেন, এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারত ও রাশিয়া একসঙ্গে বসে। এখানেই আসিয়ান আঞ্চলিক সহযোগিতার সুর নির্ধারণ করে।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, কুয়ালালামপুর অ্যাকর্ডের অধীনে থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে—যা আসিয়ানের শান্তি স্থাপন প্রচেষ্টার এক প্রতীকী মুহূর্ত হবে।

ইলাঙ্গো যোগ করেন, মালয়েশিয়ার এই মধ্যস্থতাই দেখায় আসিয়ানের ‘নীরব প্রভাব’ কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখে। উভয় বিশেষজ্ঞই সতর্ক করে বলেছেন, অতিরিক্ত প্রত্যাশা করা উচিত নয়।

ইলাঙ্গো বলেন, আসিয়ান কখনোই ‘বিগ ব্যাং’ কূটনীতি করে না। এটি ধীরে ধীরে, ধারাবাহিকভাবে ফল তৈরি করে—১৯৬৭ সাল থেকে সেটাই আসিয়ানের ধরন।

লিন বলেন, আসিয়ানের শক্তি তার ঐক্যে—যখন ফলাফল ধীরগতির হয়, তখনও সবাইকে আলোচনার টেবিলে রাখাই আসিয়ানের স্থায়ী সাফল্য।

৪৭তম আসিয়ান সম্মেলন মালয়েশিয়ার সভাপতিত্বে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটি যেমন বৈশ্বিক শক্তির প্রতিযোগিতার মঞ্চ, তেমনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐক্য, শান্তি ও অন্তর্ভুক্তির এক নতুন অধ্যায়।

এমআরএম

Read Entire Article