আধ্যাত্মিকতার প্রাণপুরুষ হাসান বসরী (রহ.)

15 hours ago 4

মওলবি আশরাফ

আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে প্রতিটি সিলসিলা যার মধ্যস্থতায় আল্লাহর রাসুল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছায়, যিনি তাসাউফকে এক নতুন ভাষা দিয়েছিলেন, খোদাপ্রেমকে স্থাপন করেছিলেন চিন্তার কেন্দ্রে—তিনি হলেন হজরত হাসান বসরী (রহ.)তিনি সেই বিরল মানুষদের একজন—যিনি অন্তরের পরিশুদ্ধি, আত্মার শৃঙ্খলা ও আল্লাহর প্রেমকে একত্রে রূপ দিয়েছিলেন এক জীবন্ত দর্শনে। আমরা এখানে তার জীবন সম্পর্কে খানিকটা ধারণা নেব।

জন্ম ও পরিচয়

তার মূল নাম হাসান। পরিণত বয়সে তিনি ইরাকের বসরা নগরীতে বসবাস করেন, সেখানেই ইলমি খেদমত করেন—এ কারণে তার নামের শেষে ‘বসরী’ যোগ করা হয়।

তার জন্ম ২১ হিজরিতে (৬৪২ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত ওমর ফারুকের (রা.) খেলাফতকালে। তার বাবা আবুল হাসান ইয়াসার ছিলেন আনসারি সাহাবি যায়েদ ইবনে সাবেতের (রা.) মুক্ত দাস, আর মা খায়রাহ ছিলেন আল্লাহর রাসুলের (সা.) সম্মানিত স্ত্রী উম্মে সালামার (রা.) খাদেমা। (মিন আলামিস সালাফ, আহমদ ফরিদ, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩)

শৈশব ও কৈশোর

হাসান বসরীর (রহ.) শৈশব কেটেছে মদিনার ওয়াদি আল-কুরা এলাকায়। তিনি বেড়ে ওঠেন সাহাবিদের ছায়ায়, তাদের দোয়া ও সান্নিধ্যে। শৈশব থেকেই তার হৃদয়ে বপিত হয় ইলমের বীজ ও তাকওয়ার নুর। তার মা নবীজির (সা.) স্ত্রী উম্মে সালামার (রা.) খাদেমা হওয়ায় নবীপরিবার ও বড় বড় সাহাবিগণের পরিবারে যাতায়াত ছিল। প্রায় এমন হতো, ছোট্ট হাসান কাঁদলে উম্মে সালামা (রা.) স্নেহভরে তাকে কোলে নিতেনএকদিন তাকে হাজির করা হয় ওমর ইবনুল খাত্তাবের (রা) দরবারে। তিনি শিশুটির মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন—হে আল্লাহ, তাকে দ্বীনের গভীর ইলম দিন, আর মানুষের কাছে তাকে প্রিয় বানান। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৬৪–৫৬৫)

কৈশোরে তিনি ইতিহাসের বাঁকবদলের সাক্ষী হন। তৃতীয় খলিফা ওসমান ইবনে আফফানের (রা.) শেষ দিনগুলোতে তিনি মসজিদে নববিতেই জুমার নামাজ পড়তেন, সরাসরি খলিফার মুখ থেকে খুতবা শুনতেন। বিদ্রোহীরা যখন খলিফাকে শহীদ করে, সেই দুঃসময়ে তিনি মদিনাতেই ছিলেন, তার বয়স তখন চৌদ্দ বছর।

ইলম অর্জন

হাসান বসরী (রহ.) কোরআন তিলাওয়াত শিখেছেন হিত্তান ইবনে আবদুল্লাহ রাক্কাশির (রহ.) কাছে। এ ছাড়া তিনি প্রায় ১৩০ জন সাহাবিকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। সাহাবি ও তাদের ছাত্রদের কাছ থেকে তিনি হাদিস, ফিকহ, তাফসির ও ভাষার জ্ঞান অর্জন করেছেন।

ব্যক্তিত্ব

হাসান বসরী (রহ.) ছিলেন জ্ঞানের প্রতীক, ত্যাগ ও সংযমের প্রতিমূর্তি, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের এক বিরল সংমিশ্রণ।

মুহাম্মাদ ইবনে সা‘দ তাকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে—হাসান বসরী (রহ.) ছিলেন জ্ঞানী, মর্যাদাশালী, বিশুদ্ধ ফকিহ, নির্ভরযোগ্য, দলিলপ্রমাণে শক্তিশালী, আমানতদার, পরহেজগার, দুনিয়াবিমুখ, প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী, বাগ্মী, সুন্দর ও আকর্ষণীয়।

তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী ও সুদর্শন। তার চেহারা ছিল দীপ্তিময়। আওয়াম ইবনে হাওশাব বলেন, নবী-রাসুলগণ যেমন ছিলেন চেহারায় সুন্দর ও চরিত্রে সর্বোত্তম, বাক্যে অনুপম—হাসান বসরীও ছিলেন তেমনই।  

ইউনুস ইবনে উবাইদ বলেন, আমি এমন কাউকে দেখিনি যার কথা ও কাজ এতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমনটি হাসান বসরীর ক্ষেত্রে দেখেছি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৭৩)

ইলমের খেদমত ও আমল

হাসান বসরীর (রহ.) জীবন ছিল এক জীবন্ত মাদরাসা—যেখানে ইলম, আমল এবং দুনিয়াবিমুখতা একসঙ্গে বিকশিত হয়েছিল। তার ঘরে নিয়মিত আত্মশুদ্ধির মজলিস হতো যেখানে তিনি ইমান-আমল, আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আলোচনা করতেন। মসজিদে তিনি হাদিস, ফিকহ, কোরআন ও আরবি ভাষার দরস দিতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৭৭–৫৭৯)

হাসান বসরী (রহ.) নিয়মিত রোজা রাখতেন—বিশেষ করে আইয়ামুল বিজ (মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ), হারাম মাসগুলোতে (মুহাররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ মাসে), এবং প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার। জীবনে তিনি দুবার হজ করেছেন।

তার জীবন ছিল দুনিয়াবিমুখতা ও সংযমে পূর্ণ। কেউ একবার তার ঘরে গিয়ে দেখেছিল—ঘরে কিছুই নেই, শুধু একটি পুরনো খাট। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৮২–৫৮৫)

হাদিসশাস্ত্রে তার অবদান

হাসান বসরী (রহ.) ছিলেন তাবেঈদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি ওসমান ইবনে আফফান (রা), তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহসহ (রা.) বহু সাহাবিকে সরাসরি দেখেছেন। তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন ইমরান ইবনে হুসাইন, মুগিরা ইবনে শো‘বা, আবদুর রহমান ইবনে সামুরা, সামুরা ইবনে জুনদুব, আবু বাকরাহ সাকাফি, নুমান ইবনে বশির, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, আনাস ইবনে মালেক, ইবনে আব্বাস, ওমর ইবনে তাগলিব, মা’কিল ইবনে ইয়াসার, আসওয়াদ ইবনে সারিসহ (রা.) আরও বহু সাহাবি থেকে।

অন্যদিকে, তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন আইয়ুব আস সাখতিয়ানি, ইউনুস ইবনে উবাইদ, ইবনে আউন, হুমায়দ আত-তাওয়িল, সাবিত বানানি, মালেক ইবনে দিনার, হিশাম ইবনে হাসান, জারির ইবনে হাজেম, রাবি ইবনে সাবেহ, ইয়াজিদ ইবনে ইবরাহিম আত তুস্তারি, মুবারক ইবনে ফাজালা, হাজম আল কাতি, সালাম ইবনে মাসকিন, শামিত ইবনে আজলান, সালেহ আবু আমির আল-খাজ্জাজ, ও ইবাদ ইবনে রাশিদ (রহ)। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৬৬)

ইন্তেকাল

হাসান বসরী (রহ.) মৃত্যুবরণ করেন ১১০ হিজরির রজব মাসের প্রথম দিকে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় আশি বছর। তার জানাজা ছিল বিরাট সমাবেশের মতো। জুমার নামাজের পর বসরার মানুষ দলে দলে তার জানাজায় অংশ নেয়। তার জানাজায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়েছিল যে ওই দিন জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করা সম্ভব হয়নি।

বর্ণিত রয়েছে, মৃত্যুর আগে তিনি কিছুক্ষণ অচেতন ছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর বললেন, তোমরা আমাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুললে—যেখানে ছিল জান্নাতের সম্মানিত স্থান, মনোরম বাগান ও নদী। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৮৭)

ওএফএফ

Read Entire Article