বিশ্ব রাজনীতিতে এক সময় ‘সমাজতন্ত্র’ ছিল এক প্রজন্মের কাছে স্বপ্নময় এক আদর্শ, আবার পাশ্চাত্যে এটি হয়ে উঠেছিল এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার প্রতীক। শীতল যুদ্ধের শেষে যখন পুঁজিবাদ বিজয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন মনে হয়েছিল—সমাজতন্ত্রের আলো নিভে গেছে, চিরদিনের জন্য।
কিন্তু আজ, একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, সেই নিভু-নিভু আলো আবারও যেন জ্বলতে শুরু করেছে—খোদ পশ্চিমের দেশগুলোতেই। এবার তার শিখা উঠছে এমন এক সমাজে, যে সমাজটি পুঁজিবাদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি বলে বিবেচিত—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
২.
সম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জোহরান মামদানি—যিনি নিজেকে প্রকাশ্যে একজন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এই বিজয় আমেরিকার ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্ত, এবং বলা যায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিজয়। কারণ নিউইয়র্ক কেবল একটি শহর নয়—এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক হৃৎপিণ্ড এবং বহু ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় নগর। এমন এক নগরীতে সমাজতান্ত্রিক ধারার কোনো নেতার নির্বাচিত হওয়া মানে আমেরিকার আগ্রাসী রাজনৈতিক চেতনায় এক স্পষ্ট প্রতিবাদ, এবং প্রকারান্তরে এক নতুন রাজনৈতিক দিকনির্দেশের সূচনা।
মামদানির নিউইয়র্ক বিজয়, স্যান্ডার্সের ভাবাদর্শ ও ওকাসিও-কর্তেজের তরুণ নেতৃত্ব—সব মিলিয়ে আমেরিকা আজ সমাজতন্ত্রের এক নতুন সংজ্ঞার দিকে এগোচ্ছে। খোদ আমেরিকাতেই সমাজতন্ত্র এখন আর অতীতের ব্যর্থ আদর্শ নয়; বরং ক্রমে তা হয়ে উঠছে আগামীর বিকল্প পথ।
মামদানির প্রচারণা ছিল স্পষ্ট ও মানবিক—“সবার জন্য মর্যাদা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা।” তিনি সমাজতন্ত্রকে কোনো তাত্ত্বিক ভাষায় নয়, বরং বাস্তব জীবনের সংকটের সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর বার্তা ছিল পরিশ্রমী মানুষের ও তরুণ প্রজন্মের হৃদয় স্পর্শ করা এক স্পষ্ট উচ্চারণ- রাষ্ট্রের কাজ ধনীদের সম্পদ রক্ষা নয়, সাধারণ মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা।
এই ভাবনার মূলে আছে এক নতুন সমাজ বিনির্মাণের আহ্বান, যার ভিত্তি সমাজতান্ত্রিক চেতনায়। এই চেতনা লাল ঝান্ডা বা বিপ্লবের নয়; বরং আমেরিকার সমাজের গভীর থেকে উঠে আসা মানুষের স্পন্দন। সেই স্পন্দনের বীজ রোপণ করেছিলেন আরেক রাজনীতিবিদ বার্নি স্যান্ডার্স ও সমাজকর্মী অ্যালেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ (AOC)।
৩.
বার্নি স্যান্ডার্স, যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যের সিনেটর, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন কাটিয়েছেন প্রান্তিক অবস্থানে—কখনো করপোরেট দাতা বা দলের কেন্দ্রীয় প্রভাবের আশ্রয়ে যাননি। তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের আসল মুহূর্ত আসে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট প্রাইমারিতে, যখন তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থিতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রথমবারের মতো বলেন, “I am a Democratic Socialist.” আমেরিকান রাজনীতিতে এই উক্তি ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক বিস্ফোরণ। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে 'Socialist' শব্দটি দীর্ঘদিন ধরে শীতল যুদ্ধের আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু স্যান্ডার্স একে নতুন অর্থে ব্যাখ্যা করেন:“Democratic socialism is about creating an economy that works for all, not just for the wealthy few.” অর্থাৎ তাঁর সমাজতন্ত্র কোনো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের তত্ত্ব নয়; এটি গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ন্যায়ের ধারণা—যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে, ধনীদের স্বার্থে রাষ্ট্র বন্দি থাকবে না।
স্যান্ডার্সের নেতৃত্বে তরুণ প্রজন্ম নতুনভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। 'Medicare for All', 'Free College Tuition', 'Green New Deal', 'Tax the Billionaires'—এইসব স্লোগান সমাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে এক নৈতিক ও বাস্তব রাজনীতির ভাষায়। সমাজতন্ত্র আর বিপ্লবের রোমান্টিক কৌতূহল নয়; এটি হয়ে ওঠে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব প্রশ্নের উত্তর।
৪.
২০১৮ সালে নিউইয়র্কের ১৪তম জেলা থেকে কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়ে অ্যালেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ (এওসি AOC) যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে তরুণ নারী প্রতিনিধি হন। তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল সাধারণ মানুষের জীবন থেকে—একজন বারটেন্ডার ও ওয়েট্রেস হিসেবে। সেই জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁকে শিখিয়েছে: আমেরিকান স্বপ্ন সবার জন্য সমান নয়।
এওসি নিজেও Democratic Socialists of America (DSA)-এর সদস্য। তাঁর রাজনীতি বার্নি স্যান্ডার্সের ভাবনারই এক তারুণ্যনির্ভর, নারীবাদী এবং বহুসাংস্কৃতিক রূপ। তিনি বলেন— “Democratic socialism is not about the government taking over everything, it’s about the people taking power back.”
তাঁর প্রস্তাবিত 'Green New Deal' জলবায়ু, ন্যায়বিচার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও কর্মসংস্থানের নতুন ধারণাকে একত্রিত করে উপস্থাপন করে। এটি এমন এক সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন, যেখানে পরিবেশ রক্ষা ও সামাজিক সমতা একে অপরের পরিপূরক।
এওসি তাঁর স্বচ্ছ বক্তব্য, সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়তা, ও সাহসী অবস্থানের কারণে আজ আমেরিকান রাজনীতির সবচেয়ে জনপ্রিয় তরুণ কণ্ঠে পরিণত হয়েছেন। তিনি সমাজতন্ত্রকে এক নারীবাদী, পরিবেশবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষায় নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন
৫.
তিনজনের আদর্শ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—মামদানি, স্যান্ডার্স ও ওকাসিও-কর্তেজ এক গভীর আদর্শিক সূত্রে বাঁধা, যদিও তাঁদের প্রজন্ম ও প্রেক্ষাপট আলাদা। স্যান্ডার্স সমাজতন্ত্রকে 'নিষিদ্ধ শব্দ' থেকে ফিরিয়ে এনেছেন আমেরিকার রাজনৈতিক আলোচনায়। ওকাসিও-কর্তেজ সেই ধারণাকে তরুণ প্রজন্মের বাস্তব রাজনীতিতে রূপ দিয়েছেন—যেন সমাজতন্ত্র কেবল তত্ত্ব নয়, জীবনের ন্যায্যতার ভাষা হয়। আর মামদানি দেখিয়েছেন, সেই ভাষা এখন ভোটের রাজনীতিতেও কার্যকর হতে পারে—এমনকি নিউইয়র্কের মতো শহরে।
এই তিনজন মিলে সমাজতন্ত্রকে দিয়েছেন এক নতুন রূপ—যা বিপ্লবের নয়, বরং সমাজ সংস্কারের ভাষা; সহমর্মিতা ও মর্যাদার রাজনীতির ভাষা। তাঁরা দেখিয়েছেন, সমাজতন্ত্রকে আবারও উচ্চারণ করা সম্ভব—সব সময় বিপ্লবী হতে হবে এমন নয়; মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করেই সমাজতন্ত্র হতে পারে বাস্তব রাজনৈতিক দর্শন।
৬.
প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ভিত্তি শ্রেণিসংগ্রাম, রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও বিপ্লবের ডাকের ওপর দাঁড়িয়ে। তৃতীয় বিশ্বের একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতে এখনও সেই ধারণাই প্রভাবশালী। কিন্তু আমেরিকার Democratic Socialism তার থেকে ভিন্ন। এটি এমন এক ধরনের নৈতিক সমাজতন্ত্র—যার মূলে আছে সমতা, পরিবেশের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার, এবং করপোরেট নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে নাগরিক শক্তি।
এই নতুন ভাষায় সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব নয়, বরং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার রাজনীতি। এখানে সমাজতন্ত্র মানে এমন এক নাগরিক মানবতা, যেখানে সাফল্য পরিমাপ হবে না সম্পদের অঙ্কে, বরং সমাজ কতটা ন্যায্য ও মানবিক তার ভিত্তিতে।
৭.
সারা বিশ্বে যখন সমাজতন্ত্রের আলো নিভু-নিভু—এমনকি আমেরিকার পাশের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যেমন কিউবা বা ভেনেজুয়েলা যখন মার্কিন আগ্রাসনে টালমাটাল—তখন আমেরিকার মতো দেশে সমাজতন্ত্রের এই নতুন উত্থান এক প্রতীকী শুভ বার্তা। এটি প্রমাণ করে, সমাজতন্ত্রের ভাষা পুরোনো হয়ে যায়নি—শুধু তার উচ্চারণ বদলেছে। আজ পশ্চিমা সমাজে সমাজতন্ত্রের নতুন উচ্চারণ হচ্ছে, মানবিক রাষ্ট্র, ন্যায়সঙ্গত অর্থনীতি, এবং টেকসই পৃথিবী। এই ভাষা হয়তো রাতারাতি বিপ্লব ঘটাবে না, কিন্তু এটি ধীরে ধীরে মানুষের চেতনায় ফিরিয়ে আনবে নৈতিকতার রাজনীতি।
মামদানির নিউইয়র্ক বিজয়, স্যান্ডার্সের ভাবাদর্শ ও ওকাসিও-কর্তেজের তরুণ নেতৃত্ব—সব মিলিয়ে আমেরিকা আজ সমাজতন্ত্রের এক নতুন সংজ্ঞার দিকে এগোচ্ছে। খোদ আমেরিকাতেই সমাজতন্ত্র এখন আর অতীতের ব্যর্থ আদর্শ নয়; বরং ক্রমে তা হয়ে উঠছে আগামীর বিকল্প পথ।
লেখক : বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট ।
এইচআর/জিকেএস

8 hours ago
5








English (US) ·