জুলাই সনদ বাস্তবায়নের তরিকা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টাকে যে তিন দফা সুপারিশ দিয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মূলত সংসদ তথা জনপ্রতিনিধিদের অধিকার খর্ব করে গণভোটের মতো এটি বিতর্কিত পদ্ধতিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—যে পদ্ধতির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার জামায়াত ও এনসিপি। যাদের কাছে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার গঠন তথা জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিচার তথা দল হিসেবে তাদের নির্মূল করে দেওয়া; বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতি বাতিলসহ এর আমূল পরিবর্তন এবং মুক্তিযুদ্ধসহ ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নতুন বয়ান প্রতিষ্ঠা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে। একইসঙ্গে এই সনদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং এই কমিশনের সভাপতি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও স্বাক্ষর করেন।
জাতীয় নাগরিক-পার্টি এনসিপি এই সনদে স্বাক্ষর করেনি এই যুক্তিতে যে, এই সনদের আইনি ভিত্তি এবং সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা নেই। বস্তুত সনদের আইনি ভিত্তি, বাস্তবায়নের রূপরেখা এবং জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার ও আহতদের আইনগত দায়মুক্তির দাবিতে ওইদিন দিনভর সংসদ ভবন এলাকায় বিক্ষোভ করেন জুলাইযোদ্ধা পরিচয়ে একদল ব্যক্তি। তারা সংসদ ভবনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুরও চালান। পুলিশের সাথে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
বিক্ষোভের মুখে ওইদিনই, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের কিছু সময় আগে কমিশনের সহ-সভাপতি জুলাই সনদের একটি অঙ্গীকার সংশোধনের ঘোষণা দেন এবং এটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। যে জুলাই সনদ তৈরি করা হয়েছে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কয়েক মাসের ধারাবাহিক আলোচনার মধ্য দিয়ে, সেই সনদের একটি অঙ্গীকার কোনো ধরনের দৃশ্যমান আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে তখনই প্রশ্ন ওঠে। ঐকমত্য কমিশনের এই এখতিয়ার আছে কি না, সেটি নিয়েও বিতর্ক হয়। তাছাড়া একটি পক্ষের দাবির মুখেই যদি সনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার সংশোধন করে দেওয়া যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এত মাস ধরে আলোচনার কী প্রয়োজন ছিল বা এই ধরনের তৎপরতার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকেই উপেক্ষা করলো কি না—সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এরকম বাস্তবতায় গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার কাছে যে তিন দফা সুপারিশ দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে যদি সংসদ তা করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে কোনো যুক্তিতেই সংসদের সাথে তুলনা করা বা সংসদের মর্যাদা দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং, কমিশন মানেই হলো সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান। তারা যে সুপারিশ করবে, সরকার সেটি মানতে বাধ্য নয়। আবার সরকারি যেকোনো সিদ্ধান্ত বাতিলের এখতিয়ার রয়েছে সংসদের। তার মানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ গঠিত হবে, সংবিধানের যেকোনো পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন হতে হবে সংসদেই।
বাস্তবতা হলো, জুলাই সনদে অনেকগুলো সুপারিশ সরাসরি সাংবিধানিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। সাংবিধানিক পরিবর্তন কখনো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস হয় না। বরং যে-কোনো সাংবিধানিক পরিবর্তন হতে হয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে। পৃথিবীর অনেক দেশে সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে সংসদে অনুমোদনের পরে গণভোটের বিধান রয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটি স্পষ্টতই সংসদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। সংসদ সদস্যরা যেহেতু জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, অতএব এটি জনগণের ক্ষমতাকেও খর্ব করে। কেননা, গণভোটের একটি বিতর্কিত পদ্ধতি কখনো সংসদে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের চেয়ে বড় হতে পারে না।
তাছাড়া বাংলাদেশে অতীতের তিনটি গণভোটে (১৯৭৭, ১৯৮৫, ১৯৯১) কী হয়েছে; কতজন মানুষ ওইসব ভোটে অংশ নিয়েছে- সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। ইতিহাস বলছে, জনগণের মতামতের বদলে ওইসব গণভোটে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। কাগজে-কলমে ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ ভোট পড়লেও বাস্তবে ২০ শতাংশ মানুষও যে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। সুতরাং জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে গণভোটের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কী ঘটবে, তা সহজে অনুমেয়।
তাছাড়া ৮৪টি সুপারিশ ও ৭টি অঙ্গীকারসম্বলিত যে সনদের অনেক বিষয়ের সঙ্গেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত আছে, সেটি কী করে গণভোটে দিয়ে পাস করা যাবে এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ বা সংসদ সেগুলো অনুমোদন না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস হয়ে যাবে—এমন বিধান পৃথিবীর আর কোনো আছে কি না সন্দেহ আছে।
বস্তুত ঐকমত্য কমিশন গঠন করাই হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত করা। জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংস্কার শেষ করে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কীভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়—সেই পথ বের করা। যে কারণে এই কমিশনের সভাপতি হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজেই। আর এই ঐক্য স্থাপন এবং জুলাই সনদ নামে একটি রাজনৈতিক দলিল তৈরির জন্য প্রায় ৮ মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনা করলো এবং বেশ কিছু জায়গায় অনেক দলের নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিসহ জুলাই সনদে সবাই স্বাক্ষর করলো। কিন্তু দেখা গেলো, ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশ করেছে, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।
নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিসমূহ বাদ দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশের বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু শনিবার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে অবশ্য এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার যুক্তি হলো, ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই নোট অব ডিসেন্টসহই তাদের কার্যবিবরণী প্রস্তুত করেছে। কিন্তু কমিশন যখন সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, সেখানে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়েছে। এটা তাদের এখতিয়ার।
উদাহরণটা এরকম যে, কোনো একটি অফিসে একজন কর্মীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বোর্ডের ৭ সদস্যের মধ্যে ৫ জন ওই কর্মীকের চাকরিচ্যুত করা এবং দুজন তাকে বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। কিন্তু কার্যবিবরণীতে এটাও উল্লেখ থাকলো যে, বোর্ডের দুজন সদস্য তাকে বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। মঞ্জু মনে করেন, জুলাই সনদের কার্যবিবরণীতে নোট অব ডিসেন্টর বিষয়ে উল্লেখ করলেও তারা যখন এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে তাদের অবস্থান বা সিদ্ধান্ত জানালো, সেখানে তারা নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেনি। কেননা নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার চেয়ে না দেওয়া দলের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কমিশন এই সুপারিশ বা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
অবশ্য এ বিষয়ে বিএনপি বা নোট অব ডিসেন্ট দানকারী অন্য দলগুলোর পাল্টা যুক্তি কী, সেটি পরিষ্কার নয়। তবে এখানে একটা জটিলতা আছে। সেটা হলো, জুলাই সনদকে যদি সংবিধানের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে সেটি বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনকে সংসদের মর্যাদা দিতে হবে। সংসদেরই কেবল এই এখতিয়ার আছে যে সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে কতটুকু সংশোধন আনা হবে। সুতরাং জুলাই সনদে সংবিধানের কোথায় কতটুকু পরিবর্তন আনা হবে, এই প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়ে সুপারিশ করার অর্থই হলো, ঐকমত্য কমিশন নিজেদের সংসদের মতো মর্যাদাবান মনে করেছে। সংসদ হলো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। আর ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তির সমন্বয়ে। তাদের মধ্যে একাধিক সদস্য দ্বৈত নাগরিক।
সুতরাং, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে কোনো যুক্তিতেই সংসদের সাথে তুলনা করা বা সংসদের মর্যাদা দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং, কমিশন মানেই হলো সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান। তারা যে সুপারিশ করবে, সরকার সেটি মানতে বাধ্য নয়। আবার সরকারি যেকোনো সিদ্ধান্ত বাতিলের এখতিয়ার রয়েছে সংসদের। তার মানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ গঠিত হবে, সংবিধানের যেকোনো পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন হতে হবে সংসদেই। এমনকি সংসদ গঠনের আগে গণভোটে জুলাই সনদ অনুমোদনের প্রস্তাবটিও অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/জিকেএস

1 day ago
4









English (US) ·