গয়েশ্বরের আসনে ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’

2 hours ago 5

কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ায় জমে উঠেছে নির্বাচনি আমেজ। অনেকে মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেও শেষ পর্যন্ত দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ে আস্থা রেখেছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রার্থীও প্রচার-প্রচারণায় চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনি এলাকা।

তবে, আসনটিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের বড় ভোটব্যাংক প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারণ করতে পারে বলে মনে করেন ভোটাররা। তারা বলছেন, আসনটিতে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’ আছে। এই ভোট যেদিকে ঘুরবে সেই প্রার্থী জয়ী হবেন।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার আগানগর, জিনজিরা, শুভাঢ্যা, কোন্ডা ও তেঘরিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ঢাকা-৩ আসন। কেরানীগঞ্জের আরেক অংশ ও সাভারের একাংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা-২।

গয়েশ্বরের আসনে ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’

সরেজমিনে দেখা যায়, নির্বাচনী এলাকা ছেয়ে গেছে পোস্টার, ব্যানার, তোরণ ও লিফলেটে। তবে অধিকাংশ পোস্টারই বিএনপি সমর্থিতদের। গয়েশ্বর ছাড়াও এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী রেজাউল কবির পলের পোস্টার চোখে পড়েছে। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের প্রার্থীর পোস্টারও দেখা গেছে এলাকাজুড়ে। তবে সেভাবে চোখে পড়েনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্ভাব্য প্রার্থীর বাহ্যিক প্রচারণা।

এ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে লড়বেন অধ্যক্ষ মো. শাহীনুর ইসলাম। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী শেখ ফয়সাল। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটির দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার সভাপতি ব্যবসায়ী সুলতান আহমেদ খানকে। এ আসনে ধর্মভিত্তিক এ দলটির অবস্থান মোটামুটি ভালো। বিশেষ করে কেরানীগঞ্জের আগানগর এলাকার গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে বলে জানা যায়।

গয়েশ্বরে আস্থা বিএনপির

যুবদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল কবির পল ছিলেন এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। পল কেরানীগঞ্জে তরুণদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিলেন। ফলে বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে পলের সমর্থকদের মধ্যে। পলের অনুসারীর কেউ কেউ বলছেন, পল স্বতন্ত্র হিসেবে ভোট করলেও জয়ী হবেন।

গয়েশ্বরের আসনে ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’

বিএনপির বড় অংশের নেতাকর্মীরা হেভিওয়েট নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ঘিরেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গয়েশ্বর বিএনপির দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন।

বিএনপির কর্মসূচি সফল করতে হামলারও শিকার হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে আলোচিত প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের মতে, কঠিন সময়ে তিনি দলকে সংগঠিত রেখেছেন, হামলা-মামলার ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে থেকেছেন এবং কেরানীগঞ্জে বিএনপির ঘাঁটি ধরে রেখেছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দখলবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের মতে, এসব কারণে গয়েশ্বরের জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন
কে হতে পারেন দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী
ঢাকা-৪ আসন/মনোনয়ন দৌড়ে বিএনপির দুই নেতা, মাঠে সক্রিয় জামায়াত-এনসিপিও
ঢাকা-১৩ আসন/ববি হাজ্জাজে ছন্দপতন বিএনপিতে, মোবারকে ফুরফুরে জামায়াত
গাজীপুর-১/৪ ভাগে বিভক্ত বিএনপি, নির্ভার জামায়াত

জিনজিরা হাউলিয়ার বাসিন্দা আজিজুর রহমান খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ধানের শীষের ভোট বেশি। গয়েশ্বর দাদা ও পল মিয়া আলোচনায় থাকলেও দাদাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।’

কদমতলীর বাসিন্দা সজল বলেন, ‘আমাদের এখানে গয়েশ্বর বাবু টিকিট পেয়েছেন। আমরা শুনছি পল মিয়া আলাদা করে ভোট করবেন।’

গয়েশ্বরের আসনে ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’

সাংগঠনিকভাবে এলাকায় শক্ত অবস্থানের পাশাপাশি নেতাকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের। কেরানীগঞ্জের সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের সন্তান গয়েশ্বর শুরুতে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। পরে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে দীর্ঘদিন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

বারবার মনোনয়নবঞ্চিত হলেও ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর টেকনোক্র্যাট কোটায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পেলেও দলের যুগ্ম মহাসচিব মনোনীত হন। এরপর প্রায় এক দশক ধরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন গয়েশ্বর।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নিজ এলাকার তৃণমূলে শক্ত সাংগঠনিক ভিত গড়ে তোলার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদেরও রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তবে ঢাকা-৩ থেকে বারবার মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েও প্রার্থিতার সুযোগ পাননি তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে আমানউল্লাহ আমান ঢাকা-২ আসনের প্রার্থী হন। এ সুযোগে ঢাকা-৩ আসনে প্রার্থিতার সুযোগ পান গয়েশ্বর। অবসান ঘটে তার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। কিন্তু প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়েই তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী নসরুল হামিদ বিপুর কাছে পরাজিত হন। এ আসনটি গয়েশ্বরের জন্য বরাদ্দ হওয়ার খুশিতে প্রথমবারের পরাজয় নিয়ে খুব একটা গ্লানি নেই তার কর্মী-সমর্থকদের। অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্তে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেননি গয়েশ্বর।

অপরদিকে, স্থানীয়ভাবে পরিচ্ছন্ন নেতা হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল কবির পল। কয়েক বছর ধরে তিনি রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তাকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে যুব ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল। গয়েশ্বরকে মনোনয়ন দেওয়ায় আশাহত পলের সমর্থকরা। এ বিভক্তি কাজে লাগাতে চান জামায়াত ও এনসিপি প্রার্থী।

গয়েশ্বরের আসনে ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’

স্থানীয় সন্তান শাহীনুরে চাঙা জামায়াত

আসনটিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ মো. শাহীনুর ইসলাম। তিনি ঢাকা জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির। এ আসনে কিছুটা বিভক্ত বিএনপির সুযোগটা কাজে লাগাতে চায় জামায়াত। প্রচারণায় গিয়ে শাহীনুর ইসলাম বলছেন, ‘আমি আপনাদের সন্তান, আপনাদের ভাই। কেরানীগঞ্জের সন্তান হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়েছি। দাঁড়িপাল্লা মার্কায় দোয়া ও ভোট চাই। আগামীর বাংলাদেশ গড়তে আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। ন্যায় ইনসাফভিত্তিক সমাজ গড়তে সবার ভোট ও দোয়া চাই।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কারও সমালোচনা নয়, আপনাদের সেবা করার সুযোগ চাই।’

কোন্দল কাজে লাগাতে চায় এনসিপিও

নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) লিফলেট বিতরণ, গণসংযোগ ও পথসভা করছে নিয়মিত। ঢাকা-৩ আসনের প্রতিটি ইউনিয়নে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে এনসিপি। তাদের দাবি, বিএনপি কোন্দলে ব্যস্ত, এই সুযোগ তারা কাজে লাগিয়ে জয় পেতে চায়। ঢাকা-৩ আসনে এনসিপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী শেখ ফয়সাল। তিনি ঢাকা জেলা দক্ষিণ যুবশক্তির আহ্বায়ক।

গয়েশ্বরের আসনে ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’

শেখ ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির তিনটি গ্রুপিং। আমরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জয় পাবো। আমাদের প্রত্যাশা আমরাই জয়ী হবো। গয়েশ্বর বাবুর জনপ্রিয়তা থাকলেও তার প্রতিকূলতা আছে। ওনাদের চারটি বিভক্তি আছে। জামায়াত-বিএনপিকে মানুষ একই মনে করে। আমাদের মাঠ ফ্রেশ। ওনাদের বিদ্রোহ আছে, আমাদের নেই। বিএনপি টেম্পোস্ট্যান্ড দখল, ভাগ-বাটোয়ারায় ব্যস্ত। অনেকে চাঁদাবাজি করছে। আমরা কোনো কিছুর মধ্যে নেই। আমরা জনগণের সেবা দিতে চাই। আমরা নতুন কিছু করতে চাই।’

ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের নীরব ভোট

২০০৮ থেকে টানা ক্ষমতায় থাকায় এখানে আওয়ামী লীগেরও একটি বড় ভোটব্যাংক রয়েছে। আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা এলাকাছাড়া হলেও দলটির নীরব সমর্থক রয়েছে অনেক। এই সমর্থক যেদিকে যাবে সেদিকে জয়ের পাল্লা ভারী হবে বলে মনে করেন অনেকে।

কেরানীগঞ্জ কদমতলী পূর্ববন্দ ডাকপাড়ার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগের অনেক ভোট আছে। আওয়ামী লীগের ভোট যেদিকে যাবে তারাই জয়ী হবে।’

আরেক বাসিন্দা চা দোকানি শায়ের হোসেন বলেন, ‘এ আসন বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে বিগত কয়েক বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তাদেরও অনেক ভোটার তৈরি হয়েছে। অনেক নেতা এলাকাছাড়া। তবে সমর্থকরা তো আছেন। তারা অনেকেই নীরবে ভোট দেবেন। তাদের ভোট এ আসনে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে।’

এলাকাবাসীর চাওয়া

এ আসনের প্রধান সমস্যা গ্যাস সংযোগ থাকলেও দিনে গ্যাস থাকে না। ফলে গ্যাসের লাইন থাকা সত্ত্বেও সিলিন্ডার প্রধান ভরসা। দীর্ঘদিন ধরে সড়কে কোনো ধরনের সংস্কার হয়নি। ফলে সড়কের বিটুমিন উঠে পাথর ও ইট বের হয়ে আসছে। এই সড়কে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের। এছাড়া চাঁদাবাজি, জুয়া ও মাদক এ এলাকার অন্যতম সমস্যা। অলিগলিতে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। ফলে মাদকের কারণে বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যা হলেই বেড়ে যায় চুরি-ছিনতাই। এলাকাবাসী এসব থেকে পরিত্রাণ চান।

গয়েশ্বরের আসনে ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগের ‘নীরব ভোট’

ভোটের হিসাব-নিকাশ

১৯৯১ সাল থেকে চারটি নির্বাচনে অবিভক্ত কেরানীগঞ্জ আসনটি ছিল ধানের শীষের দখলে। এ আসনে প্রতিবারই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আমানউল্লাহ আমান। ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সবশেষ খসড়া ভোটার তালিকা অনুসারে, ঢাকা-৩ নির্বাচনি এলাকায় মোট ভোটার ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৪৯ জন। এর মধ্যে নারী ১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৫৩, পুরুষ ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৪ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের দুজন।

এমওএস/এএসএ/এমএফএ/এএসএম

Read Entire Article