টরন্টোর বুকে সুউচ্চ দানব!
ভ্রমণ
অনিন্দ্য মামুন 2025-11-05বিমান যখন নামছে টরন্টো পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, জানালার কাচঘেঁষে তাকিয়ে দেখি শহরের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক সুউচ্চ দানব! রোদে ঝলমল করছে ধাতব দেহ, মাথায় মেঘের ছায়া। হঠাৎ মনে হলো, এই কি সেই বিখ্যাত সিএন টাওয়ার? যাকে বলা হয় কানাডার গর্ব, টরন্টোর প্রাণ। ছবিতে আগেই দেখেছি স্থাপনাটি। সে কারণে কিছুটা ধারণা করতে পারছিলাম এটিই সেই সিএন টাওয়ার।
টাওয়ারের প্রথম দেখা
সিএন টাওয়ারটি কেবল ইস্পাত, কাচ আর কংক্রিটের স্তম্ভ নয়–এটিকে বলা হয় টরন্টোর আত্মা। স্থানীয়রা বলে, ইফ ইউ হ্যাভন’ট সিএন টাওয়ার, ইউ হ্যাভন’ট সিএন টরেন্টো। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন–কেউ পরিবারের সঙ্গে, কেউ প্রিয়জনের হাত ধরে, কেউবা নিঃসঙ্গ ভ্রমণকারী হয়ে নিজের মনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। ফিরে যান একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। টরন্টোতে নেমে একদিন বিশ্রাম শেষে প্রথমেই পরিকল্পনায় ছিল সিএন টাওয়ার দেখার। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া। লেক অন্টারিওর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে দূর থেকে যখন টাওয়ারটি চোখে পড়ল, তখন মনে হলো, যেন আকাশ ছুঁয়ে থাকা কোনো জাহাজের মাস্তুলকে দেখছিলাম। কাছাকাছি আসতেই মাথা ঘুরে যায়–এত উঁচু! ৫৫৩ মিটার বা এক হাজার ৮১৫ ফুট। ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়-মাথা ব্যথা হওয়ার উপক্রম। তবে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকা শেষ হয় না।
_1762330405.jpg)
১৯৭৬ সালে নির্মিত এই টাওয়ার একসময় ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ মানবনির্মিত স্থাপনা। যদিও এখন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা সেই খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছে। তবুও টরন্টোবাসীর গর্বে কোনো ঘাটতি নেই। বিশ্বের অন্যতম আধুনিক এ শহরটিতে পা রাখলেই কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে সিএন টাওয়ারের প্রশংসা করতে ভোলেন না; যেন শহরের হৃদয়ে গভীরভাবে খোদাই করা একটি গর্বিত প্রতীক এটি। স্কাইপড পর্যবেক্ষণ ডেক থেকে টরন্টোর বিশাল লেক অন্টারিও পর্যন্ত বিস্তৃত প্যানোরামিক দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ পাওয়া যায় এ টাওয়ারটি থেকে; যেখান থেকে জলের পৃষ্ঠটি একটি বিশাল আয়নার মতো লাগে।
ইতিহাসের আকাশছোঁয়া অধ্যায়
সত্তরের দশকের প্রথম দিকে কানাডিয়ান ন্যাশনাল রেলওয়ে কোম্পানি টাওয়ারটি নির্মাণ করে তাদের যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রতীক হিসেবে। নামের শুরুতে থাকা সিএন আসলে সেই কানাডিয়ান ন্যাশনালের সংক্ষিপ্ত রূপ। তারা চেয়েছিল এমন একটি টাওয়ার গড়ে তুলতে, যা শুধু টেলিযোগাযোগ নয়, কানাডার উদ্ভাবনী শক্তিরও প্রতীক হবে। ১৯৭৩ সালে শুরু হয়ে মাত্র ৪০ মাসে শেষ হয় এর নির্মাণকাজ। বিষয়টি আরেকটু মনোযোগ দিয়ে ভাবলে অবাক নয়–বিস্ময় জাগানিয়া প্রশ্ন উঠবে মনে। সেই সময়ের প্রযুক্তিতে কত সাহস আর পরিশ্রমের কাজ ছিল এটি; যা হয়তো অনেক দেশ কল্পনাও করতে পারত না। ফলে টাওয়ারটি আজ হয়ে আছে বিস্ময়ের প্রতীক হয়ে।
_1762330436.jpg)
লিফটে চড়ে স্বপ্নের উচ্চতায়
টাওয়ারে প্রবেশ করতে মনে হলো যেন কোনো ভবিষ্যতের জগতে ঢুকে পড়েছি। ভেতরের কাচের লিফট যখন এক ঝটকায় ওপরে উঠতে শুরু করল, তখন বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। ভয় জাপটে ধরছিল পুরো শরীরকে। সেই সঙ্গে রোমাঞ্চও। মাত্র ৫৮ সেকেন্ডে আমরা পৌঁছে গেলাম অবজারভেশন ডেকে। মানে প্রায় ৪৪৭ মিটার ওপরে! নিচে তাকাতেই মাথা ঘুরে গেল। বিশ্বাস হচ্ছিল না পৃথিবী থেকে এত উচ্চতায় আমি। পুরো শহরটা যেন একটা ছোট মানচিত্রের মতো লাগল। গাড়িগুলো পিঁপড়ের মতো ছুটছে, লেক অন্টারিও ধরা দিচ্ছে এক বিশাল আয়নার মতো হয়ে। টাওয়ারের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল গ্লাস ফ্লোর; যার মেঝে পুরোটা কাচের তৈরি। ওপর থেকে তাকালে প্রায় দেড় হাজার ফুট দূরে মাটি। প্রথমে পা রাখতে ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তে নিচে পড়ে যাব, গ্লাস ভেঙে নেহাত দুর্ঘটনার শিকার হবো। যখন বুঝলাম এটি ১৪ সেন্টিমিটার পুরু, ইস্পাতের চেয়েও শক্ত, তখন সাহস করে দাঁড়ালাম। সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমি যেন আকাশে ভাসছি– একটা পাখি, যার নিচে শহর, লেক, নদী আর হাজার হাজার মানুষ।
এখানে হাঁটার দারুণ অভিজ্ঞতা ভুলতে চাইলেও হয়তো ভুলা সম্ভব নয়। এরপর গেলাম টাওয়ারের বিখ্যাত ৩৬০ রেস্তোরাঁয়। এখানে বসে খাবার খেতে খেতে পুরো শহরকে ধীরে ধীরে ঘুরে দেখা যায়। এক ঘণ্টায় পুরোটা একবার ঘুরে আসে। আমি বসেছিলাম জানালার পাশে। এক পাতে স্যালমন ফিশ আর এক কাপ কানাডিয়ান কফি, সামনে শহরের আলোছায়া, দূরে নীল লেক অন্টারিও; যেন হলিউডের কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মধ্যেই যাপন করছিলাম সময়টা। রেস্তোরাঁর কর্মী হাসিমুখে বললেন, ইউ আর ডাইনিং ইন দ্য স্কাই! সত্যিই আকাশে বসে খাবার খাওয়ার মতো অনুভূতি হয় এখানে।
টাওয়ারের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর আকর্ষণ হলো এজ ওয়াক। এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ হ্যান্ডস-ফ্রি ওয়াকওয়ে। অর্থাৎ আপনি কোনো রেলিং না ধরে ৩৫৬ মিটার ওপরে টাওয়ারের কিনারায় হাঁটতে পারবেন। অবশ্যই সেফটি বেল্ট পরে। আমি শুধু নিচ থেকে দেখছিলাম মানুষগুলোকে–তারা যেন মৃত্যুর সঙ্গে হাসিমুখে খেলা করছে। কিন্তু টাওয়ারের এই কিনারা দিয়ে এভাবে হাঁটার সাহস হয়নি। আবার যদি কোনোদিন আসা হয় এই টাওয়ারের উচ্চতায় হয়তো সেদিন সাহস করে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেব। ভবিষ্যতের জন্য ইচ্ছেকে তুলে রাখলাম।
লেখক: সংবাদিক ও লেখক

23 hours ago
2









English (US) ·