ঢাকার জনপ্রিয় গণপরিবহন মেট্রোরেলের পিলার থেকে এক বছরের ব্যবধানে দুবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা ঘটলো। গত বছর প্রথমবার ফার্মগেটে ঘটা এ ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল ট্রেন চলাচল। কিন্তু রোববার (২৬ অক্টোবর) সেই ফার্মগেটেই খুলে পড়া আরেক বিয়ারিং প্যাডের আঘাতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন আবুল কালাম (৩৫) নামে এক পথচারী।
এই ঘটনা দেশব্যাপী ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে দুর্বল তত্ত্বাবধান, ডিজাইন ত্রুটি এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবকে দায়ী করেছেন। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী অনুরূপ ঘটনার ছায়া
ঢাকার মতো এ ধরনের দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত বিরল, যেখানে বিয়ারিং প্যাড খুলে পথচারীর ওপর পড়ে প্রাণহানি ঘটে। তবে, কাঠামোগত ব্যর্থতা-সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে অতীতে।
উত্তরা গার্ডার দুর্ঘটনা (বাংলাদেশ, ২০২২)
প্রথম উদাহরণটা বাংলাদেশকে দিয়েই শুরু করা যাক। ২০২২ সালে উত্তরায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিআরটি লাইন-৩ প্রকল্পের একটি গার্ডার ধসে পড়ে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হন। এ ঘটনায় চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না গেজহৌবা গ্রুপ নিহত পরিবারের জন্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। এ দুর্ঘটনায় বিদেশি ঠিকাদারদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের চুক্তি ও প্রকল্প তদারকির ঘাটতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরবর্তীতে সরকার নিরাপত্তা নির্দেশনা ও প্রকল্প স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়।
আরও পড়ুন>>
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড কী, বারবার খুলে পড়ছে কেন
মেট্রোরেলে নির্মাণত্রুটি আছে, কনসালট্যান্টকে দায়বদ্ধ করতে হবে
মেট্রোরেলে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা: রেল উপদেষ্টা
এটা দুর্ঘটনা নয় হত্যা, টাকা-চাকরি দিয়ে ক্ষতিপূরণ হবে না
গুজরাটের মর্বি সেতু দুর্ঘটনা (ভারত, ২০২২)
২০২২ সালে গুজরাটের মর্বি এলাকায় একটি পুরোনো সাসপেনশন সেতু ধসে অন্তত ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়। তদন্তে জানা যায়, রক্ষণাবেক্ষণে থাকা ওরেভা গ্রুপ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পরীক্ষা ছাড়াই সেতুটি খুলে দেয়। গুজরাট হাই কোর্ট কোম্পানিটিকে নিহত প্রতি পরিবারকে ১০ লাখ রুপি এবং আহতদের দুই লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেন। কোম্পানি প্রাথমিকভাবে পাঁচ কোটি রুপি ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দেয়, যা আদালত অপর্যাপ্ত বলে মন্তব্য করে।
ভিসাখাপট্টনম ক্রেন দুর্ঘটনা (ভারত, ২০২০)
২০২০ সালে ভারতের ভিসাখাপট্টনমে হিন্দুস্তান শিপইয়ার্ড লিমিটেডের একটি ক্রেন ধসে পড়ে অন্তত ১১ শ্রমিক নিহত হন। কর্তৃপক্ষ নিহতদের পরিবারের জন্য ৫০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে এবং পরিবারের এক সদস্যকে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দুর্ঘটনার পর নির্মাণ সাইটে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি এবং তদারকির দুর্বলতা নিয়ে তীব্র প্রশ্ন ওঠে।
নিকল হাইওয়ে ধস (সিঙ্গাপুর, ২০০৪)
সিঙ্গাপুরে মেট্রো নির্মাণের সময় নিকল হাইওয়ে ধসে চার কর্মী নিহত এবং তিনজন আহত হন। সরকার দ্রুত তদন্ত কমিশন গঠন করে এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পাশাপাশি নিরাপত্তা মান সংস্কার করতে বাধ্য করে। নিহতদের পরিবারকে ৩০ হাজার সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার (প্রায় ২৮ লাখ টাকা) করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এছাড়া দায়ী তিন প্রকৌশলী ও এক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। এই দুর্ঘটনার পর সিঙ্গাপুরে নির্মাণ কোড আরও কঠোর করা হয়, যা আজও বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ নির্মাণ মান হিসেবে স্বীকৃত।
অ্যালেকজান্ডার এল. কিয়েল্যান্ড তেল রিগ দুর্ঘটনা (নরওয়ে, ১৯৮০)
১৯৮০ সালে উত্তর সাগরে একটি তেল রিগ ভেঙে পড়ে ১২৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। চার দশক পর ২০২৫ সালে নরওয়ের পার্লামেন্ট নিহতদের পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণের নতুন স্কিম অনুমোদন করে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিপূরণ বঞ্চিত পরিবারগুলোর প্রতি ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ওপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কর্তৃপক্ষ দ্রুত তদন্ত এবং নিরাপত্তা অডিটের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হয়েছে মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতিপূরণও। উন্নত দেশগুলোতে আইনের মাধ্যমে এ ধরনের অধিকার সুরক্ষিত থাকলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তার যথাযথ প্রয়োগের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, এনডিটিভি, উইকিপিডিয়া, টাইমস অব ইন্ডিয়া
কেএএ/

2 weeks ago
6









English (US) ·