বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। অর্থ আত্মসাতের এই ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চারটি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলার আসামি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থেকে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা এই প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা ও আত্মসাৎ করা অর্থ উদ্ধারে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলার আসামি, অর্থ আত্মসাতকারী, অর্থ আত্মসাতে জড়িত ব্যক্তি এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিমা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে অপসারণ করে স্বচ্ছ পরিচালনা পর্ষদ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
সম্প্রতি এই রাষ্ট্রীয় গোপন প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা পড়েছে। প্রতিবেদনের সুপরিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৫ আগস্ট ‘অর্থ আত্মসাৎ মামলার আসামি-স্বজনরাই ফারইস্ট লাইফের পরিচালনা পর্ষদে’ শীরনামে জাগো নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে দুদকের মামলার আসামি, তাদের স্বজনদের বিস্তারিত তথ্য উপস্থান করা হয়।
জাগো নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশ করার প্রায় দুই মাস পর সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। আইডিআরএ-এর নিয়োগ করা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সিরাজ খান বসাক এন্ড কোং এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তে অর্থ আত্মসাতের এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিভিন্ন খাতে অর্থ আত্মসাতের এই ঘটনায় দুদক জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চারটি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলার আসামি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থেকে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। ফলে অর্থ আত্মসাতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও অর্থ উদ্ধারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। দফায় দফায় পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন হলেও নামে-বেনামে বা আত্মীয়-স্বজনদের নামে অর্থ আত্মসাতকারীরা পরিচালনা পর্ষদে রয়ে গেছেন। এতে করে আত্মসাৎ করা অর্থ উদ্ধার না হওয়ায় গ্রাহকরা চরম হয়রানিতে রয়েছেন। অন্যদিকে বিমা কোম্পানিটিও রয়েছে হমকির মুখে- এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে গোপনীয় প্রতিবেদনে।
আরও পড়ুন
অর্থ আত্মসাৎ মামলার আসামি-স্বজনরাই ফারইস্ট লাইফের পরিচালনা পর্ষদে
দুদক মামলার আসামি-আত্মীয়দের অপসারণ চেয়ে বিএসইসিতে চিঠি
এতে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিমা কোম্পানির ৩৬, তোপখানা রোডস্থ ৩৩.৫৬ শতাংশ জমি এবং তদস্থিত বিল্ডিং প্রায় ২০৭ কোটি টাকায় ক্রয়-বিক্রয় করে বিক্রিত মূল্য থেকে ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য কোম্পানিটির ১৪ জন পরিচালকসহ ২৪ জনকে আসামি করে বাদী সৈয়দ আতাউল কবির, উপপরিচালক দুদক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা একটি মামলা (মামলা নং- ৩৫, তারিখ ৩১/০৭/২০২৫, সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১) দায়ের করেন।
বিমা কোম্পানিটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে এই মামলার আসামি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নাম এবং পরিচালনা পর্ষদে তাদের প্রভাব প্রতিবেদলে তুলে ধরা হয়েছে।
মো. মোবারক হোসেন
মো. মোবারক হোসেন বর্তমানে বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নিরপেক্ষ পরিচালক পদে রয়েছেন। তিনি আলহাজ মো. হেলাল মিয়ার (বিমা কোম্পানিটির সাবেক পরিচালক ও দুদকের মামলার ২ নং আসামি) ভাই। তিনি আলহাজ মো. হেলাল মিয়ার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হযরত আমানত শাহ সিকিউরিটিজ লিমিটেডের (ব্রোকার হাউজ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি ব্রোকার হাউজটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ১৩৩ কোটি টাকা ব্রোকার হাউজটিতে শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। এতে বিমা কোম্পানিটির ৬০ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা লোকসান হয়। যার বিও অ্যাকাউন্ট নাম্বার হলো (১২০৪৫৭০০১১৯০৩৯২৮)। এই লোকসানের তথ্য বিমা কোম্পানিটির ২০১৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে লোকসান হিসেবে প্রভিশন দেখানো হয়।
অথচ বিমাকারীর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইনের পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা সংক্রান্ত ৬.৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘রিলেটেড পার্টি ট্রানজেকশন’ অর্থাৎ পরিচালকদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যেকোনো আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পূর্ব ঘোষণা দিতে হয়। কিন্তু বিমা কোম্পানিটির সাবেক পরিচালক আলহাজ মো. হেলাল মিয়ার মালিকানাধীন ব্রোকার হাউজটিতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার পূর্ব ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
এছাড়াও বিমাকারীর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইনের পরিচালনা পর্ষদের আচরণবিধি সংক্রান্ত ৬.৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে, পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যকে নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে উক্ত সদস্য বিমাকারীর পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন না। তিনি বিমা কোম্পানিটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে থেকে আলহাজ মো. হেলাল মিয়ার সব অনিয়ম-দুর্নীতি, অনৈতিক আর্থিক সুবিধাগুলোকে বৈধতা দিতে পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব বিস্তার করছেন, যা বিমাকারীর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইনের পরিচালনা পর্ষদের আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
প্রকৃতপক্ষে আলহাজ মো. হেলাল মিয়া কোম্পানির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে না থাকলেও তার প্রক্সি হয়ে উঠেছেন মো. মোবারক হোসেন। ফলে তাকে অপসরণ না করা হলে বিমা কোম্পানিটির কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আসবে না।
নাজনীন হোসেন
নাজনীন হোসেন দুদকের মামলার ৪নং আসামি এবং বর্তমানে বিমা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক পদে রয়েছেন। বিমা কোম্পানিটির যেসব জমি ক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়, সেই জমি ক্রয়ের কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। ফলে তিনি বিমা কোম্পরিটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে থাকায় বিমাকারীর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইনের পরিচালনা পর্ষদের আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়াও তিনি পরিচালনা পর্ষদে থাকলেও তার স্বামী মোশারফ হোসেন পুস্তী কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে উপস্থিত থাকেন এবং কোম্পানিটির সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ভূমিকা রাখেন, যা বিমা আইন-২০১০ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ড. মোকাদ্দেস হোসেন
ড. মোকাদ্দেস হোসেন বর্তমানে বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। দুদকের মামলার ৬নং আসামি ডা. মো. মনোয়ার হোসেন (মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক) এবং ১১নং আসামি মোজাম্মেল হোসেন দুজনই তার বড় ভাই। অথচ বিমাকারীর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইনের পরিচালনা পর্ষদের আচরণবিধি সংক্রান্ত ৬.৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে, পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যকে নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে উক্ত সদস্য বিমাকারীর পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন না। এই বিধান অনুসারে, তিনি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থেকে বিমাকারীর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইনের পরিচালনা পর্ষদের আচরণবিধির লঙ্ঘন করছেন।
শেখ মোহাম্মদ শোয়েব নাজির
শেখ মোহাম্মদ শোয়েব নাজির বিমা কোম্পানিটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে নিরপেক্ষ পরিচালক পদে রয়েছেন। দুদকের মামলার ৬ নং আসামি ডা. মো. মনোয়ার হোসেন তার ভায়রা ভাই এবং ডা. মোকাদ্দেস হোসেন তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এ কারণে তার বিমা কোম্পানিটির বর্তমান পর্ষদে নিরপেক্ষ পরিচালক হিসেবে থাকা বিমাকারীর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইনের ৬.৩ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে। একই সঙ্গে এই গাইডলাইনের পরিচালনা পর্ষদের আচরণবিধি সংক্রান্ত ৬.৫ অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন হচ্ছে।
গোপনীয় এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমা কোম্পানিটির পরিচালকদের আর্থিক দুর্নীতির ফলে কোম্পানির আর্থিক ভিত দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়েছে। এতে কোম্পানির দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম নষ্ট হয়েছে। পরিচালকদের এই দুর্নীতিতে সহযোগিতাকারী চক্রের সব সদস্যকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অন্য কোম্পানিগুলোও এহেন গর্হিত কাজে উৎসাহিত হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু মামলার আসামিরা আপাতদৃষ্টিতে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত সেহেতু পরে আরও অন্যান্য অনিয়মে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও আসামিদের নিকটাত্মীয় যারা পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন তাদের দ্বারা মামলার কার্যক্রম ব্যহত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। তাই তাদের বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদে না রাখাই শ্রেয়। পরে মামলার আসামিরা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নির্দোষ বা নিরপেক্ষতা প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে তাদের আবারও বোর্ডে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে।
এই গোপনীয় প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা ও আত্মসাৎ করা অর্থ উদ্ধারে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলার আসামি, অর্থ আত্মসাতকারী, অর্থ আত্মসাতে জড়িত ব্যক্তি এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিমা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে অপসারণ করে স্বচ্ছ পরিচালনা পর্ষদ গঠনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আইডিআরএ ও বিএসইসিকে সুপারিশ প্রদান করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভগের উপসচিব আফরোজা আক্তার রিবা জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রতিবেদনটি আইডিআরএ-কে পাঠিয়েছি। এখন আইডিআরএ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এমএএস/ইএ/জিকেএস

1 day ago
8









English (US) ·