দ্বীপের রানি চর কুকরি-মুকরিতে একরাত

2 weeks ago 11

আবেস ইনতেসার অনিক

ছোটবেলা থেকে আমার ভ্রমণের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। যত বড় হতে থাকি; সেই টান আরও বাড়তে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের রূপ দেখে প্রতিজ্ঞা করি বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে একাডেমিক চাপটা ছিল এ লক্ষ্যের অন্যতম বাধা। সে চাপ পেছনে রেখে ছুটতে থাকি। এক বিকেলে রওয়ানা হয়ে যাই বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলার উদ্দেশ্যে।

ঢাকায় তখন হালকা শীত। এক পড়ন্ত বিকেলে ফুল হাতা টি-শার্ট পড়ে কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য পুরান ঢাকার সদর ঘাট। এক বন্ধুও যোগ দেয় এ অভিযানে। ব্যস্ততম পুরান ঢাকার জ্যাম পেরিয়ে দুজন সন্ধ্যার আগ-মুহূর্তে পৌঁছে যাই সদর ঘাট। এরপর ভোলার বেতুয়াগামী কর্ণফুলী-১৩ লঞ্চে উঠি। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন দুটি করে লঞ্চ বেতুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য লঞ্চে প্রবেশ করে একটি কেবিন নিয়ে নিই। রাত সাড়ে আটটায় সদরঘাট থেকে লঞ্চটি ছুটতে থাকে দ্বীপ জেলা ভোলার বেতুয়ার উদ্দেশ্যে।

লঞ্চটি যতই নদীর গভীরে যাচ্ছিল; ততই ঠান্ডার প্রকোপ বাড়তে থাকে। সকাল ৬টা ২৫ মিনিটে আমাদের লঞ্চটি ভোলার বেতুয়া লঞ্চঘাটে পৌঁছায়। নতুন জেলা, নতুন ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। এসব চিন্তা করতে করতে লঞ্চ থেকে নেমে একটি লোকাল সিএনজিতে চলে যাই দক্ষিণ আইচায়। দক্ষিণ আইচায় সকালের নাস্তা সেরে চলে যাই কচ্চপিয়া ঘাটে। কচ্চপিয়া ঘাট থেকে চর কুকরি-মুকরি যাওয়ার দুটি উপায় আছে। তা হলো স্পিড বোট এবং ছোট লঞ্চ। স্পিড বোটে যদি যাই, তাহলে দ্রুত পৌঁছাতে পারবো ঠিকই কিন্তু আশেপাশের মনোরম প্রকৃতি ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবো না। তাই বেছে নেওয়া হলো ছোট লঞ্চ। বেলা ১১টায় কচ্চপিয়া ঘাট থেকে ছোট লঞ্চটি আমাদের নিয়ে ছুটতে থাকে চর কুকরি-মুকরির দিকে।

দ্বীপের রানি চর কুকরি-মুকরিতে একরাত

লঞ্চটি যতই কুকরি-মুকরির কাছাকাছি যাচ্ছিল; ততই এর সৌন্দর্য দেখে আমরা অবাক হই। ছোট খালের দুপাশ দিয়ে রয়েছে সারি সারি সবুজ গাছ। তার মধ্যদিয়ে ছুটে চলছে আমাদের ছোট লঞ্চ। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। অপরূপ প্রকৃতি দেখতে দেখতে চলে আসি কুকরি-মুকরি ঘাটে। সেখানে আলী মামা আমাদের জন্য একটি অটো পাঠিয়ে রাখেন। আলী মামা মূলত কুকরি-মুকরির স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি এখানে আগত পর্যটকদের রাত যাপনের জন্য তাবু ভাড়া দেন। এ ছাড়া পর্যটকদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থাও করেন অত্যন্ত সুলভ মূল্যে।

এখানে আসার আগে ঢাকা থেকেই তার সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের ঘাটে পৌঁছানোর আগেই একটি অটো পাঠিয়ে দেন। তার পাঠানো অটোতে করে চলে যাই আলী মামার বাড়িতে। একদম আসল গ্রামীণ পরিবেশে আলী মামার বাড়িটি। তখন ভরদুপুর। রোদের আলোও বেশি। আবার বাড়ির ফ্যানটিও বন্ধ ছিল কিন্তু আমাদের একটুও গরম লাগেনি। বাড়ির চতুর্দিকে গাছপালা থাকায় গরম যেন পালিয়ে গেছে।

দুপুরে আলী মামার বাড়ির বারান্দায় বসে আলু ভর্তা, সাদা ভাত আর মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার পর রওয়ানা হয়ে যাই নারিকেল বাগানে। চর কুকরি-মুকরিতে আগত পর্যটকেরা যদি ক্যাম্প করতে চান, তাহলে নারিকেল বাগানে ক্যাম্প করেন। নারিকেল বাগানে পৌঁছে আবারও এর সৌন্দর্য দেখে অবাক হই। একপাশে বঙ্গোপসাগর, আরেক পাশে মেঘনা নদী। বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলা, যাকে অনেকে দ্বীপের রানি বলে থাকেন। দ্বীপ জেলা ভোলার মধ্যে আরেক দ্বীপ হলো চর কুকরি-মুকরি। কুকরি-মুকরির পাশে একটি ছোট দ্বীপ হলো নারিকেল বাগান। নারিকেল বাগানের পেছন দিকে আছে জঙ্গল। জঙ্গলের সামনে সৈকত।

নারিকেল বাগানে পৌঁছে আলী মামা এক স্থানে আমাদের তাঁবুটি স্থাপন করে দেন। সেদিন আমাদের মতো অনেক পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল। পুরো নারিকেল বাগানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই। ইন্টারনেট চালানো তো দূরের কথা। ফোন দেওয়ার মতো বিন্দুমাত্র নেটওয়ার্কও সেখানে পাওয়া যায় না। নেটওয়ার্ক সেখানে না থাকলেও আছে মনোরম প্রকৃতি। যা একবার উপভোগ করা শুরু করলে আর ইন্টারনেট বা নেটওয়ার্কের প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ুন
ভোলার নির্জন চরে এক প্রহর
যাদুকাটা থেকে নীলাদ্রি: একদিনের তাহিরপুর যাত্রা

অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা দ্বীপটি হেঁটে হেঁটে দেখতে দেখতে পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের মাধ্যমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিল। নারিকেল বাগান দ্বীপটায় কোনো বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নেই। মোবাইলের লাইট বা টর্চ লাইটই আলোর মাধ্যম। তবে আমরা যেদিন গিয়েছিলাম; সেদিন পূর্ণিমা রাত থাকায় চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে দ্বীপটি। রাতের কালো অন্ধকার যেন আকাশে থাকা চাঁদের সাদা আলো একাই পরিষ্কার করে দিয়েছে। সেই রাতে পূর্ণিমার আলোয় এতটাই আলোকিত ছিল যে, কোনো প্রকার কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয়নি।

দ্বীপের রানি চর কুকরি-মুকরিতে একরাত

আকাশে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ। সামনে বিলাশ সাগর। সাগরের গভীরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট লাল-নীল আলো। সেগুলো মাছ ধরার ট্রলার। সাগরের পেছনে আমাদের তাঁবু। তাঁবুর পেছনে জঙ্গল। সেই জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। রাত যত বাড়ছিল; শিয়ালগুলোর ডাকাডাকি ততই বাড়ছিল। শিয়ালগুলো পর্যটকদের কোনো ক্ষতি করে না। এভাবে কেটেছিল নেটওয়ার্কবিহীন একটি রাত। রাতটি এতটাই সুন্দর ছিল, যা কোনোভাবে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

সন্ধ্যার আগে তাঁবুর পেছনের জঙ্গল থেকে কিছু ডালপালা কুড়িয়ে আনি। তা দিয়েই তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ার করি। দুপুরে খাবারের পরই আলী মামাকে বলে রাখি, রাতে তাঁবুর পাশে বারবিকিউ করার কথা। আলী মামা রাত আনুমানিক ১০টার দিকে মেওনেট করা মুরগি আর পরোটা নিয়ে আসেন। তাঁবুর সামনে শুরু করে দেন বারবিকিউ। এ অসাধারণ মুহূর্তটা আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে সারাজীবন। বারবিকিউ পর্ব সেরে জীবনে প্রথমবারের মতো তাঁবুতে নিদ্রা যাই।

পরদিন সকাল ৬টায় আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি চারদিকে কুয়াশা। কুয়াশাকে সাথে নিয়ে হেঁটে দেখতে থাকি পুরো দ্বীপটি। নারিকেল বাগানের সবুজ ঘাসে পড়া শিশির বিন্দুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দ্বীপের শেষপ্রান্তে। শেষপ্রান্তের নীরবতা আর অসাধারণ প্রকৃতি সেখানে আটকে রাখে অনেকক্ষণ। দ্বীপটির জঙ্গলে অনেক হরিণ আছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা একটা হরিণেরও দেখা পাইনি। যতই দ্বীপটি দেখছিলাম; ততই অপরূপ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম।

দ্বীপে একটি অস্থায়ী খাবার হোটেল আছে। খাবার হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে আমরা আরও কয়েকজন পর্যটক নিয়ে একটি মাছ ধরার ট্রলার রিজার্ভ করি সরাসরি কচ্চপিয়া ঘাটে যাওয়ার জন্য। জীবনের প্রথম মাছ ধরার ট্রলারে ওঠার অভিজ্ঞতা ছিল এটি। ট্রালারটি বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে গিয়ে একটি খালে প্রবেশ করে। আমরা উপভোগ করি নদীর পাড়ের জীববৈচিত্র্য ও অসাধারণ প্রকৃতি। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে যাই কচ্চপিয়া ঘাটে। সেখান থেকে ভোলার চরফ্যাশন। এরপর বেতুয়া লঞ্চঘাট হয়ে ঢাকাগামী লঞ্চে করে আমরা ঢাকায় ফিরি।

মূলত অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি মাস চর কুকরি-মুকরি ভ্রমণের আদর্শ সময়। প্রকৃতির সাথে প্রেম ও অন্যরকম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন ভোলার চর কুকরি-মুকরি থেকে। সেখানকার অসাধারণ রূপের প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেন। এই ভ্রমণের ৮০ শতাংশই হলো নৌভ্রমণ। এতে আপনারা নদীর পাড়ে মানুষের জীবকা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন। উপভোগ করতে পারবেন মনোরম প্রকৃতি। এই শীতে আপনাদের ভ্রমণ তালিকায় চর কুকরি-মুকরি কিন্তু স্থান পেতেই পারে।

লেখক: চতুর্থ বর্ষ, বিবিএ ডিপার্টমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।

এসইউ/জেআইএম

Read Entire Article